
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলমের কৌশলের কাছে হেরেছে নৌকা। মেয়র থাকাকালে জাহাঙ্গীরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেমন ভোটারদের তাঁর দিকে টেনেছে, তেমনি মনোনয়নপত্র দাখিল থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত কৌশল প্রণয়নেও এগিয়ে ছিলেন তিনি।
প্রচারের কৌশলও আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন পেয়েছেন দলের আজীবন বহিষ্কৃত এই নেতা। বিএনপির সমর্থকদের একাংশ নৌকা ঠেকাতে জাহাঙ্গীরের পক্ষ নেন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকা ৬ প্রার্থীর পাওয়া ১ লাখ ১১ হাজার ভোটও ক্ষতি করেছে নৌকার। ভোট কাটাকাটিতে জাহাঙ্গীরের সুবিধা হয়েছে। ভোটের আগের রাতে ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতিও প্রভাব ফেলেছে ফলাফলে।
বিএনপি বর্জন করায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান ফাঁকা মাঠে একতরফা জয় পাবেন বলে ধারণা করা হলেও হয়েছে তার উল্টোটা। তাক লাগিয়ে গত বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে মেয়র পদে জয় পেয়েছেন জাহাঙ্গীর আলমের ‘ডামি প্রার্থী’ হয়ে ভোটে নামা তাঁর মা জায়েদা খাতুন।
নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদার টেবিল ঘড়ির জয়ের প্রধান কারণ অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচন। তবে আরও কিছু বিষয় এবং কৌশলও জয়-পরাজয় নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। ভোটের বিস্তারিত ফলে দেখা যাচ্ছে, নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খান নিজ এলাকা টঙ্গীর অনেক কেন্দ্রে জিততে পারেননি। জাহাঙ্গীরের জয়দেবপুরে হয়েছে শোচনীয় পরাজয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনে কারচুপি করে জয় পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। তবে মেয়র থাকাকালে তিনি এসব উন্নয়ন করেছেন, তা এবারের ভোটে সুফল দিয়েছে। টঙ্গী পৌরসভার ১৮ বছর মেয়র ছিলেন আজমত। তিনি ক্ষমতায় থাকতে যেসব রাস্তা হয়নি, জাহাঙ্গীরের সময় সেগুলো প্রশস্ত ও পুনর্নির্মাণ হয়েছে। জনগণের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের মতো নিবিড় সংযোগ না থাকায় ব্যক্তিগতভাবে ভোট টানতে পারেননি নৌকার প্রার্থী।
অধিকাংশ নারী ভোটকেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন জাহাঙ্গীরের মা। গাজীপুর সিটির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের হাতিমারা স্কুল অ্যান্ড কলেজে পুরুষ কেন্দ্রে নৌকা ১ হাজার ৪০ ভোট পেয়েছে। ঘড়ি পেয়েছে ১ হাজার ৩ ভোট। নারীদের দুই কেন্দ্রেই জয়ী জায়েদা।
করোনাকালে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া শ্রমিকরা বাস করেন, এমন এলাকায়ও একচেটিয়া ভোট পেয়েছে ঘড়ি। টঙ্গীর এরশাদ নগরে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের বাস। এই এলাকার ১০টি ভোটকেন্দ্রের ৮টিতে জয় পেয়েছে ঘড়ি। বাকি দুটির একটিতে ১৪ ভোটে এবং আরেকটি ৩০ ভোটের স্বল্প ব্যবধানে জয় পায় নৌকা।
গাজীপুর আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জাহাঙ্গীর আনুগত্যের কথা বলেছেন বারবার। তাঁর মা মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও একই কথা বলেছেন। এই কৌশলের কারণে আওয়ামী লীগবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হননি তিনি। তাই দলটির কর্মী-সমর্থকদের ভোট পেয়েছেন তাঁর মা। দলটির স্থানীয় নেতাদের অনেকেই ছিলেন জাহাঙ্গীরের পক্ষে। নৌকার ব্যাজ পরলেও গোপনে অনেকে কাজ করেছেন ঘড়ির পক্ষে। আওয়ামী লীগের গাজীপুর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরাই এ কথা বলেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে। তবে কমিটির দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, গাজীপুর নিয়ে কথা বলব না। ভোটের আগে তিনি নৌকার বিশাল জয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
ভোটের প্রচারে জাতীয় রাজনীতির ইস্যু থেকে দূরে ছিলেন জাহাঙ্গীর। বিএনপির বিপক্ষে একটি শব্দও বলেননি মা-ছেলে। তাই বিএনপি সমর্থক অনেক ভোটারের সমর্থন পেয়েছেন জাহাঙ্গীর।
ভোটের দিনেও কৌশলে এগিয়ে ছিলেন জাহাঙ্গীর। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মীরা কেন্দ্র ঘিরে থাকলেও জাহাঙ্গীদের সমর্থকরা ছিলেন নীরব। তাই ঘড়ি জিততে পারে, এ ধারণাও কেউ করেননি। ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের মাত্র কয়েকটিতে জাহাঙ্গীরের মায়ের এজেন্ট ছিলেন। করোনাকালে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ১১ হাজার শিক্ষককে আর্থিক সহায়তা দেন। তাঁদের অনেকেই নির্বাচনে পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন শিক্ষক জানান, এসব পোলিং অফিসার জাহাঙ্গীরের অঘোষিত এজেন্ট ছিলেন।
মাছ প্রতীকে ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট পেয়ে তাক লাগানো গণফ্রন্টের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের এজেন্ট ছিলেন অধিকাংশ কেন্দ্রে। তবে কয়েকটি কেন্দ্রেও এজেন্টরা আতিকুলের পুরো নাম এবং দলের নাম পর্যন্ত বলতে পারেননি। নেতারা বলছেন, মাছের এজেন্টরা ঘড়ির হয়ে কাজ করেছেন।
প্রতিটি ভোটকক্ষে ছিল সিসি ক্যামেরা। এ কারণে ভোটের গোপন কক্ষে বহিরাগতদের প্রবেশ বা ইভিএমে টিপে দেওয়ার সুযোগ ছিল না। মার্কিন ভিসা নীতিও আতঙ্ক তৈরি করে ভোটের কর্মকর্তাদের মধ্যে। তাঁরা সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত যে কোনো নির্বাচনের তুলনায় কঠোর ছিলেন।
মন্তব্য করুন