- রাজনীতি
- মাসিক ব্যবস্থাপনায় এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পিছিয়ে
মাসিক ব্যবস্থাপনায় এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পিছিয়ে
বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস

শিল্পকর্ম: ডলসি ডি’ক্রুজ
আজ বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস। ২০১৪ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে মাসিক এখনও এক সামাজিক ট্যাবু হয়ে রয়েছে। এ নিয়ে আলোচনাও যেন অপবিত্র ও নিষিদ্ধ। অথচ এটি নারী শরীরের সাধারণ শারীরবৃত্তীয় অবস্থা। বিশেষ আয়োজন...
গ্রামে মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যাওয়া আর সড়কপাড়ের ব্রিজ থেকে খালের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া হয় না আয়েশার (১০)। সময়টা শৈশবের দুরন্তপনার হলেও, মাসিক বা রক্তস্রাব শুরু হওয়ায় থমকে গেছে তার এতসব আনন্দ আয়োজন। প্রতি মাসে প্রায় সাত দিন তাকে ঘরবন্দি থাকতে হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর হাই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা এই প্রতিবেদককে বলে, ‘মাসিক হইলে ঘরের বাইরে যাইতে অয় না। নামাজ পড়া যায় না। রান্না করা যায় না, কারণ অপবিত্র অইয়া যাইব।’ ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাক্ষরতার হার ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে জেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে মাসিক শুরু হলে কন্যাশিশুদের স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করেন অভিভাবকরা। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই নয়; খুলনা, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বরগুনা, জামালপুর ও সিলেটেও মাসিক নিয়ে কুসংস্কার ধারণ করা হয়। এসব জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাসিক শুরু হলেই মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাংস্কৃতিকভাবে আজও মাসিক একটি ট্যাবু। এ সময় নারীদের অপবিত্র বলে বিবেচনা করা হয়।
বান্দরবানে মাঠ পর্যায়ে মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন ইউএনডিপির কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা পুলক রাহা। তিনি বলেন, ‘এখনও দেশের ৪০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মাসিক সম্পর্কে অসচেতন। এ সময়ে কী ধরনের স্বাস্থ্যসেবা বা যত্ন নিতে হয়, তাও জানে না।’
মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ। এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষ মিলে আমরা এখন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য কাজ করছি। কিন্তু মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিহ্নিত সমস্যাবলি দূর করায় সফল না হলে সফলভাবে এসডিজির বেশ কয়েকটি লক্ষ্য অর্জন অংশত ব্যাহত হতে পারে। যেমন– এসডিজি ৩ (সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ), এসডিজি ৪ (মানসম্মত শিক্ষা), এসডিজি ৫ (জেন্ডার সমতা), এসডিজি ৬ (নিরাপদ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন), এসডিজি ৮ (শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) এবং এসডিজি ১২ (পরিমিত ভোগ ও উৎপাদন)। এসডিজি অর্জন করতে হলে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।’
মাসিক প্রসঙ্গে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শেহরিন এফ সিদ্দিকা বলেন, ‘মাসিকের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নারীর জরায়ু ও ডিম্বাশয়, যা শুধু নারীর যৌনতা ও সন্তান ধারণের সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়; বরং নারীর সামগ্রিক শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় বিপাকক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করে যেসব হরমোন, তার উৎপাদনের সঙ্গেও সরাসরি জড়িত।’
দেশের ৮২ শতাংশ স্কুলে মাসিক ব্যবস্থাপনায় যথাযথ সুযোগ নেই বলে ওয়াটার এইডের এক সমীক্ষায় জানা গেছে। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, প্রতি মাসে মাসিকের দিনগুলোয় সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ধীরে ধীরে পড়ালেখায় স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে পড়ে কিশোরীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৯ থেকে ১১ বছরের মধ্যেই মাসিক শুরু হয়ে যায়; কিন্তু প্রাথমিক স্কুলগুলোয় বিষয়টি নিয়ে কোনো কার্যক্রম নেই, এমনকি পাঠ্যপুস্তক কারিকুলামেও কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন জরিপ অনুযায়ী, ৪০ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী তাদের মাসিককালে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। প্রতি ১৮৭ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর জন্য আছে ১টি টয়লেট। অথচ সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী, প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি টয়লেট থাকার কথা। জরিপ অনুসারে, গ্রামীণ এলাকায় ৪৩ শতাংশ স্কুলে উন্নত এবং কার্যকর টয়লেট রয়েছে, যা মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। অন্যদিকে মাত্র ২৪ শতাংশ স্কুলে টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৩২ শতাংশ স্কুলে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শহর এলাকায় ৬৩ শতাংশ স্কুলে উন্নত এবং কার্যকর টয়লেট রয়েছে, যা মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। শহরের ৪৭ শতাংশ স্কুলে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। মাত্র ১০ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া কিশোরী তাদের মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে। ৮৬ শতাংশ কিশোরী পুরোনো কাপড়, ছেঁড়া ন্যাকড়া ব্যবহার করে। এর মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ মেয়ে সঠিক নিয়ম মেনে কাপড় ব্যবহার করে। বাকিরা ঘরের কোনায় কাপড় রাখে, যা সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত করার আগেই পুনরায় ব্যবহার করে তারা। এমনকি বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক নারী যাঁরা ঘরে থাকেন, কর্মজীবী নন, তাঁদের মধ্যে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের প্রবণতা মাত্র ১২ শতাংশ। দীর্ঘদিন অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারের ফলে নারীদের জরায়ুমুখের ক্যান্সার, সংক্রমণ, যৌনাঙ্গে ঘা, চুলকানি, অস্বাভাবিক সাদা স্রাব প্রভৃতি শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। দেশে প্রতি বছর ১৩ হাজার নারী মারা যাচ্ছেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারের কারণে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ‘যথাযথ উপায়ে মাসিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জানা দরকার। এগুলো শুধু নারী ও কিশোরীদের জানলে হবে না বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কমিউনিটির সবারই জানা থাকা দরকার।’
পোশাকশিল্পের চালিকাশক্তির ৮০ শতাংশ নারী। এ খাতে একজন নারী শ্রমিককে একটানা দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়। জেন্ডার বিশেষজ্ঞ মনজুন নাহার বলেন, ‘দীর্ঘ সময় একজন নারীকে কাজ করতে হয়। এ সময়ে ছুটি মিলে না। এমনকি প্রয়োজনীয় ডাক্তার নেই, টয়লেটের সুব্যবস্থা নেই। ৭-৮ দিন ধরে মাসিক হলে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানও চলে যায়। মাসিক চলাকালীন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ পান না বেশিরভাগ নারী কর্মী। অথচ এই নারী শ্রমিকরাই দেশের অন্যতম প্রধান খাত পোশাকশিল্পের মূল চালিকাশক্তি। তাঁদের জন্য সুষ্ঠু মাসিক ব্যবস্থাপনা জরুরি।’
শ্রম আইনে নারী শ্রমিকদের জন্য মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো সুষ্ঠু বর্ণনা নেই। যৌন ও প্রজনন আইনে যেসব নিয়ম-নীতি আছে, তাও অসম্পূর্ণ। ‘মাসিক স্বাস্থ্য’ নিয়ে কোনো আইন নেই।
এদিকে কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতকরণে ২০২১ সাল থেকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নির্ধারিত ২০টি কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভলান্টিয়ার পিয়ার লিডার মডেল সংযুক্ত করে সিরাক-বাংলাদেশ। পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ইউএসএইড সুখী জীবন প্রকল্পের অধীনে সিরাক বাংলাদেশ ২০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করছে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার জেলার এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবাগ্রহণকারী কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ হাজার। এ ছাড়া ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর আশপাশের এলাকা ও বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীর মধ্যেও কৈশোরবান্ধব প্রজনন ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন