নানা হিসাবনিকাশের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ঢাকার উপকণ্ঠে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। যথারীতি এই নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নিজ নামে অংশ নেয়নি। তারা এই মুহূর্তে ‘সরকার উৎখাতের আন্দোলনে’ ব্যস্ত। তবে তাদের অনেক নেতা কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং বেশ ক’জন জয়লাভ করেছেন। মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের সঙ্গে সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের। বাংলাদেশে এতদিন উত্তরাধিকারের রাজনীতির সংস্কৃতিতে পিতা বা মাতার আসনে সন্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। এবার তার উল্টোটা ঘটতে দেখা গেল। সন্তানের আসনে মায়ের আবির্ভাব। সন্তান আর মা মিলে আজমত উল্লাকে ১৬ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করেছেন।

জাহাঙ্গীর আলম দল থেকে বহিষ্কৃত হলে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেরি করেননি। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে একটি টিভি অনুষ্ঠানে কথা হয়েছিল। মন্তব্য করেছিলাম– বাংলাদেশের চরম দুর্দিনের কাণ্ডারি ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলে তিনি হয়তো অভিমান করেছিলেন, দলের প্রতিপক্ষ হননি। কারণ, দলের প্রতি তাঁর একটা অঙ্গীকার ও আনুগত্য ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতাকে ঘাতকরা কারাগারে বন্দি করেছিল। তাঁদের পদ-পদবিরও লোভ দেখানো হয়েছিল। তাঁরা কেউ দলের সঙ্গে বেইমানি করেননি। জীবন দিয়ে দলের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার আর আনুগত্য ব্যক্ত করেছিলেন। এমন নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে এখনও আছে, তবে তাঁদের দুরবিন দিয়ে খুঁজতে হবে। এখন যাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, তাঁদের বেশিরভাগই তা করেন স্বার্থসিদ্ধির জন্য; দলের আদর্শের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার খুবই ক্ষীণ।

জায়েদা খাতুনকে অভিনন্দন। একই সঙ্গে অভিনন্দন স্থানীয় ভোটার, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে। তারা প্রমাণ করেছে সবার সহায়তায় যে কোনো পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। অনেকের আশা এবার জাহাঙ্গীর আলম জয় বাংলা বলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে। তারপর কী হবে তা দলীয় সিদ্ধান্ত। একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।

১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে সব সময় প্রশাসক বা মনোনীত চেয়ারম্যান দিয়ে করপোরেশন পরিচালিত হতো। আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি একজন জনবান্ধব রাজনৈতিক নেতা। মানুষের কঠিন সময়ে তিনি সব সময় পাশে এসে দাঁড়ান। যেহেতু স্থানীয় সরকার দলীয়ভাবে হচ্ছে না, সেহেতু মহিউদ্দিন চৌধুরী নির্বাচন করবেন নাগরিক সমাজের ব্যানারে। এই সমাজ গঠিত হলো ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ’ কিছু নাগরিককে নিয়ে। আহ্বায়ক হলেন আমার বন্ধু ড. আবু ইউসুফ আলম (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)। সঙ্গে আমিসহ কয়েকজন ‘নির্দলীয়’ নাগরিক। প্রতিপক্ষ বিএনপির মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। তিনি তখন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।

দেশে তখন বিএনপি সরকার। ঢাকা থেকে খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান এসে মীর নাছিরের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। মীর নাছিরের মার্কা গোলাপ ফুল। অঙ্গীকার– নির্বাচনে বিজয় লাভ করলে চট্টগ্রামকে গার্ডেন সিটি করবেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯২ সালে ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের লাশ টেনেছেন স্ট্রেচারে। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে চট্টগ্রাম মুসলিম হলে হাসপাতাল খোলা হয়েছে। তিনি একটি স্ট্রেচারে একজনের মৃতদেহ বহন করছেন, এমন একটি ছবি ছেপে নিচে লিখলাম– ‘মানুষ মানুষের জন্য’। আমাদের আহ্বানে আওয়ামী লীগসহ সব প্রগতিশীল দল এগিয়ে এলো মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাইতে। ক্লান্তিহীন প্রচারণা। কোনো দলাদলি নেই। নেই কোনো কোন্দল। সে এক অবিস্মরণীয় সময়। অনেকের মনে প্রশ্ন– পারবেন কি মহিউদ্দিন চৌধুরী সরকারি দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করতে? তার ওপর তারেক রহমান নিজে এসে গেছেন।

মাসটা জানুয়ারি। বাইরে কনকনে শীত। কারও বিশ্রাম নেই। নির্বাচনের দিন সারা শহর নাগরিক সমাজের কর্মীদের দখলে। ভোট শেষে গণনা শুরু হলো। রাত যত গভীর হয় ততই উৎকণ্ঠা। এত ধীরগতি কেন? গণনা হচ্ছিল চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম জিমনেশিয়ামে। মানুষের মনে সন্দেহ। কী হচ্ছে ভেতরে। বাইরে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত। খুলে গেল জিমনেশিয়ামের দরজা। অনেকটা যেন জনগণকে আহ্বান জানানো হলো, আসুন ভেতরে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে; যাতে আমরা বলতে পারি উচ্ছৃঙ্খল জনগণের কারণে ভোট গণনা পণ্ড হওয়ায় এই নির্বাচন বাতিল। মাইক হাতে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জনগণকে হাতজোড় করে অনুরোধ করি ধৈর্য ধরতে।

ভোরের আজানের সময় রিটার্নিং অফিসার ঘোষণা করলেন– মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৬ হাজার ভোটে বিজয় লাভ করেছেন। বিকেলে নবনির্বাচিত মেয়রের বাসায় গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করি, তিনি যেন মীর নাছিরের বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসেন। আমাকে যেতে অনুরোধ করলে আমি তাঁকে একা যেতে বলি। তিনি তা-ই করেছিলেন। সবাই জানতে চায়, কোথায় গেলেন মেয়র সাহেব? উত্তরে বলি, জানি না। সেই ভোরেই তারেক রহমান ঢাকার উদ্দেশে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন।

২০০০ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে এই অজুহাতে– আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মহিউদ্দিন চৌধুরী নির্বাচিত। ২০০৫ সালের নির্বাচনের সময় বিএনপি ক্ষমতায়। আবার মীর নাছির বিএনপির প্রার্থী। আবার নাগরিক সমাজের প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরী। আবার বিপুল ভোটে জয়।

২০১০ সালের চিত্রটা ঠিক উল্টো। এক-এগারোর সময় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে আটক করা হয়। প্রায় এক বছর কারাবাস। এরই মধ্যে তাঁর কন্যা টুম্পা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। কারাগারে যাওয়ার আগে মহিউদ্দিন চৌধুরী করপোরেশনের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন ওয়ার্ড কমিশনার মোহাম্মদ মনজুর আলমের কাছে। মহিউদ্দিন চৌধুরী কারামুক্ত হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে দেখা গেছে নানা রকমের কোন্দল। ওদিকে বিএনপিও জুতসই প্রার্থী পাচ্ছিল না। তারা হাত করল মনজুর আলমকে। এই মনজুর আলমকে একদিন মহিউদ্দিন চৌধুরী হাত ধরে নগর রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন। নিজ খরচে মুজিব কোট বানিয়ে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ডাকসাইটে নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী সেই মনজুর আলমের কাছে ৯৫ হাজার ভোটে পরাজিত হলেন। তা নিশ্চিত করেছিলেন আওয়ামী লীগেরই কৃপাধন্য ব্যক্তিরা। গাজীপুরের নির্বাচনের সঙ্গে চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।

এখন সব এলাকায় আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগই। আওয়ামী লীগে সংহতি থাকলে, দলে শৃঙ্খলা থাকলে তাকে কোনো নির্বাচনে পরাজিত করা অনেকটা অসম্ভব। একসময় মানুষ বলত– একটি কলাগাছকে দলের মার্কা নৌকা দিলে দলের সবাই সেখানে ভোট দেবে। সেই দিন এখন তিরোহিত। স্বার্থের ডালি নিয়ে এখন চারদিকে এত আওয়ামী লীগ কিলবিল করছে যে মনে হয়, এরা তো মানুষ না উইপোকা! সাবধান হওয়ার এখনই সময়। আর ক’মাস পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। একজন শেখ হাসিনা আর কত দেশ এবং দলকে টেনে নিয়ে যাবেন?

আবদুল মান্নান: বিশ্লেষক ও গবেষক