ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অগ্রগতিতে দেশবাসী বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওয়ানস্টপ সার্ভিসের রকমফের সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে সময়ের অপচয় কমছে, অন্যদিকে মানুষ এই ব্যস্ত সময়ে সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা করে কাজের গতি সুবিন্যস্ত ও ত্বরান্বিত করতে পারছে। যাকে বলা যায়, ম্যাক্সিমাম আউটপুট ইন মিনিমাম টাইম। কিন্তু ওয়ানস্টপ সার্ভিস পেয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা পাওয়ার ইচ্ছা এত প্রবল হয়ে উঠছে যে, এখন মানুষ আর কোনো কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নয়। এক ক্লিকেই সবকিছুর সমাধান চায়। চাহিবামাত্র সব পেয়ে মানুষের ধৈর্যের মাত্রা আজ তলানিতে এসে পৌঁছেছে। প্রত্যাশিত জিনিস পেতে একটু বিলম্ব হলেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। আমরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এতে অনেক ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক সংঘাত ও বিপর্যয় ঘটছে।

মেশিনও মানুষকে আজকাল যান্ত্রিক করে তুলছে। ডিজিটাল সুবিধার প্রসার ঘটার আগে মানুষের মধ্যে যেভাবে মেলামেশা ছিল; স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে গিয়ে মন উজাড় করে সুখ-দুঃখের আলাপ হতো; এখন এভাবে পারস্পরিক যাতায়াতের তাগিদ ফুরিয়ে আসছে। মানুষ এখন ভিডিও কলের মাধ্যমেই একে অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, দেখা-সাক্ষাতের পাট সেরে নিচ্ছে। অন্তরের টান ক্রমশ কমে আসছে। বিয়ে, গায়ে হলুদ ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানই এখন মানুষের মাঝে দেখা-সাক্ষাতের একমাত্র উপলক্ষ।

ডিজিটাল প্রযুক্তি মানুষের জীবনে যে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছে, তার আরও কয়েকটি দিক সম্পর্কে আলোচনা করতে হয়। গুগলে মহাবিশ্বের অগাধ তথ্য ও জ্ঞানের ভান্ডার সংরক্ষিত। এতে মানুষের বই পড়ার অভ্যাস দ্রুত কমে আসছে। গবেষক বা পড়ুয়ারা গুগলে একটা ক্লিক মারলেই তার প্রত্যাশিত সব তথ্য জানতে পারছেন। কাজেই বই পড়ে এখন আর তথ্য অন্বেষণের কষ্ট বা কালক্ষেপণ করতে হয় না।

ডিজিটাল প্রযুক্তির একটি ভয়ংকর ক্ষতিকারক দিক হলো, এটি আমাদের তরুণ সমাজকে মাদকের চেয়েও ভয়ংকর নেশায় বিপথগামী করছে। ছাত্র-অছাত্র নির্বিশেষে দেশের তরুণ সমাজের এক বৃহৎ অংশ মোবাইল ফোনে অশ্লীল, নীল ছবি দেখে ভিডিওতে মশগুল থেকে রাত পার করে দিচ্ছে। এতে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক দিক দিয়ে তারা ক্রমশ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির চাষ ও সৃজনশীলতার শক্তি ক্ষয় হচ্ছে। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব জাতির জীবনে পড়ছে। শিশুদের মধ্যেও ভিডিও গেম খেলার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লেখাপড়া থেকে গেম খেলার দিকেই তাদের আকর্ষণ বেশি।

সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের আজকাল বিনোদনের একটা প্রধান উৎস মোবাইল ফোনে অশ্লীল ভিডিও দেখে সময়ের অপচয় করা। সস্তা দামে বিভিন্ন অফারে ডাটা কিনে একজন রিকশাচালক মোবাইল ফোনে ইচ্ছামতো রসের ভিডিও দেখে কাজের সময় পার করে দিচ্ছেন। এতে তাঁর নৈতিক স্খলন ঘটার সঙ্গে কর্মক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে সংসারের প্রতি আকর্ষণ কমে আসছে। অনৈতিক সম্পর্কের দিকে মন ধাবিত হওয়ায় অনেক সংসারই ভেঙে যাচ্ছে।

মোদ্দা কথা, ম্যান মেকস দ্য মেশিন। কিন্তু এখন ম্যান কন্ট্রোলড বাই দ্য মেশিন।

ডিজিটাল প্রযুক্তি মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে এক বিস্ময়। এই অর্জনকে মানবকল্যাণে ব্যবহার না করে মানুষ যদি এর খারাপ দিকটা ব্যবহার করে, তাহলে তো এত বড় আবিষ্কারের সুফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হবে। আধুনিক মানুষকেই এর ব্যবহারে আরও সচেতন ও যত্নবান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রের ভূমিকাও সর্বাধিক। আণবিক শক্তি বিদ্যুৎ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা যায়। পক্ষান্তরে আণবিক বোমা কয়েক মিনিটে আমাদের এই গ্রহকে ধ্বংস করে দিতে পারে। শেষ কথা হলো, মানুষের ইচ্ছার ওপরেই সব আবিষ্কারের সুফল-কুফল নির্ভর করে।

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য: লেখক ও গল্পকার; সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়