
বর্তমান সরকার পূর্বসূরিদের তুলনায় অন্যান্য জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর মতো সামাজিক সুরক্ষায়ও যে অন্তত বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে– এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ ধারা অক্ষুণ্ন আছে বলে মনে হয় না। সোমবার সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি বাজেটের চেয়ে ১৩ হাজার কোটির কিছু বেশি বরাদ্দ হলেও শতাংশের হিসাবে তা বরং কমে গেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫২ শতাংশ, যেখানে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তা ছিল যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ ও ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ
আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, শুভংকরের ফাঁকিটা এখানেই শেষ নয়। সামাজিক সুরক্ষায় বর্ধিত বরাদ্দ দেখানোর স্বার্থে বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক খাতের বরাদ্দও এতে যুক্ত করা হয়েছে। যেমন, এর ৩০ দশমিক ৫৯ শতাংশই ব্যয় হবে সরকারি চাকরিজীবী ও তাঁদের পরিবারের পেনশন এবং সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম বাবদ। এমনকি কৃষিতে ভর্তুকির জন্য রাখা ২১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, এসএমই খাতের জন্য সুদে ভর্তুকি বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা, সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণসহ ছোটখাটো অবকাঠামো নির্মাণের টাকাও সামাজিক সুরক্ষা খাতে দেখানো হয়েছে। এ কারণে, গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হানের মতে, সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দের ৬০ শতাংশই যাবে অন্যান্য কার্যক্রমে; মাত্র ৪০ শতাংশ থাকবে প্রকৃত দরিদ্রদের জন্য।
অর্থ বিভাগের যুক্তি হচ্ছে, ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের। তাই এসব কর্মচারীর পেনশন সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় দেখানো হয়। কিন্তু এ পেনশন তো সরকারি কর্মচারীরা চাকরির শর্ত হিসেবেই পান। আমরা জানি, প্রতি মাসে সরকারি কর্মীদের বেতনের একটা অংশ কেটে রাখা হয়। এর সঙ্গে ওই টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রাপ্ত লভ্যাংশ যুক্ত করে চাকরিজীবন শেষে পেনশন হিসেবে দেওয়া হয়। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীদের পরিশ্রমলব্ধ টাকাই পেনশন হিসেবে তাঁরা পান। এর সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচির কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
সামাজিক সুরক্ষা হলো সমাজের সবচেয়ে অক্ষম ও অবহেলিত মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা; যার মাধ্যমে ওইসব মানুষ বেঁচে থাকার আশা পায়। এটা রাষ্ট্রীয় অনুদান হলেও, একটা বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রে এমন বরাদ্দ দরিদ্রদের অধিকার। অর্থাৎ এ অর্থ শুধু দরিদ্রদের পেছনেই ব্যয় হওয়ার কথা। ঠিক এ কারণেই সঞ্চয়পত্রের সুদ খাতে বরাদ্দ বা কৃষি ও অন্য কোনো খাতের ভর্তুকি সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ বলে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ সঞ্চয়পত্রের সুদ হলো এ খাতে বিনিয়োগকারীর ন্যায্য পাওনা; আর ভর্তুকি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অনুদান হলেও এর ভোক্তা– বিশেষত বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার কারণে যতটুকু সমাজের অসচ্ছল মানুষ, তার চেয়ে অনেক বেশি সচ্ছল।
আমাদের প্রত্যাশা, সরকার বিষয়টি অনুধাবন করে উপযুক্ত সংশোধনের পথে হাঁটবে।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
মন্তব্য করুন