চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে– এমন বক্তব্য থেকে সরে এলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু। সংলাপের সম্ভাবনা নিয়ে ওই বক্তব্য দেওয়ার এক দিন পরই গতকাল বুধবার তিনি বললেন, নির্বাচন ইস্যুতে কাউকে আলোচনার জন্য আহ্বান করা হয়নি, এমন সুযোগও নেই। সংবিধান অনুযায়ীই আগামী নির্বাচন হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশে এমন কোনো রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়নি– যাতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ অবশ্য আমির হোসেন আমুর বক্তব্যকে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে সরকার, আওয়ামী লীগ কিংবা ১৪ দলে কোনো আলোচনাই হয়নি। এমন বক্তব্যের মধ্যেই একই দিন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জনগণের ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে হলে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। গণতন্ত্র চাইলে আলোচনার বিকল্প কিছু নেই।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ১৪ দলের এক সমাবেশে আমির হোসেন আমু সংলাপ নিয়ে বলেছিলেন, আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আলোচনার দ্বার খোলা। প্রয়োজনে অতীতের মতো জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের মধ্যস্থতায়ও সেই আলোচনা হতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমন্বয়কের এমন বক্তব্য নিয়ে রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের প্রতিনিধি তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আবারও আলোচনা হচ্ছে কিনা– এমন সম্ভাবনা নিয়েও নানা গুঞ্জন ছড়ায়। এ অবস্থায় গতকাল বুধবার আমুসহ সরকারের মন্ত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এলো।   

আলোচনায় আহ্বান করার সুযোগ নেই : আমু
বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় আমির হোসেন আমু এমপি বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আলোচনার জন্য কাউকে বলা হয়নি। কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি, কাউকে আহ্বানও করা হয়নি। কাউকে আহ্বান করার সুযোগও নেই। এটি আওয়ামী লীগের বাড়ির দাওয়াত নয় যে, দাওয়াত করে এনে খাওয়াব।

এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলীয়প্রধানের উপস্থিতিতে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমু আরও বলেন, নির্বাচন নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে বারবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। সেই নির্বাচনে জাতিসংঘ থেকে তারানকোকে (জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো) পাঠানো হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে বৈঠকে আমরা তাদের সামনে প্রমাণ করেছিলাম, নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। একটি দেশের জন্য সাংবিধানিক শূন্যতা কাম্য হতে পারে না।

বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘সেই দিনও তোমরা আলোচনায় পরাজিত হয়েছিলে। তার মাধ্যমে আমাদের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছিল। ধারাবাহিকভাবে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি জায়গায় আনতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আজও নির্বাচন হবে সংবিধানের ভিত্তিতে। দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে দেওয়া যাবে না।’

১৪ দলের সমন্বয়ক বলেন, ‘১৪ দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, সেটা তিনি করবেন। নির্বাচন হবে সংবিধানের ভিত্তিতে। সবাইকে সে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে আগামীতে ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, সেটা জনগণ নির্ধারণ করবে। সেই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে বলা যায়; কিন্তু আলোচনার জন্য নয়।’

নাকচ করেছেন ওবায়দুল কাদের
বুধবার সকালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আগামী নির্বাচন ঘিরে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আমাদের নিজেদের সমস্যা আমরা নিজেরা আলোচনা করব। প্রয়োজন হলে নিজেরাই সমাধান করব।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতার কথা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন বাইরের বিষয়টা কেন বারবার আসে? জাতিসংঘ কেন মধ্যস্থতা করবে? এখানে জাতিসংঘ মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপ করবে– এমন কোনো রাজনৈতিক সংকট এই স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত হয়নি।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, সংকটের সমাধান হলো আমাদের সংবিধান। সংবিধানই যদি কোনো দেশে সমাধান না দিতে পারে, তাহলে সেদেশে গণতন্ত্র হবে কী করে? বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন অনেক পরিপূর্ণ হয়েছে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে চলছে। কাজেই এখানে বাইরের কোনো মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপের দরকার নেই।
বিগত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের জন্য বিভিন্ন দলকে আহ্বান করেছিলেন বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা আরও গণতান্ত্রিক হয়েছে। গণতন্ত্র রাতারাতি প্রতিষ্ঠা পায় না। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সময় লাগে। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিএনপি নেতারা আমাদের নেত্রীকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে আমরা কী আলোচনা করব? তারা আজ নালিশের রাজনীতি করছে। কী পেয়েছে? তারা আমেরিকায় নালিশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে নালিশ করে তারা কী পেয়েছে? পেয়েছে ঘোড়ার ডিম। এখন তারা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধান চায়। এই তত্ত্বাবধানে আবার নতুন সূত্র তুলে ধরছে।

আমুর বক্তব্য ব্যক্তিগত : তথ্যমন্ত্রী
একই দিন সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নিয়ে আমির হোসেন আমুর বক্তব্যটি সম্পূর্ণভাবে তাঁর ব্যক্তিগত। এটি সরকার বা আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের বক্তব্য নয়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ বা সরকার, এমনকি ১৪ দলের মধ্যেও কোনো আলোচনা হয়নি।
তিনি বলেন, তবে আমির হোসেন আমুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন ‘আসলে গণমাধ্যমে যেভাবে এসেছে তিনি ঠিক সেভাবে বলেননি।’ যেভাবেই আসুক, এটি তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত।
বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় কী লাভ হবে– সেই প্রশ্ন তুলে তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিএনপির সঙ্গে অতীতে আলোচনার অভিজ্ঞতায় বলা যায়, এই সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল, যারা নির্বাচন প্রতিহত করতে চায়। যারা নির্বাচন ঠেকাতে চায়, তাদের সাথে আলোচনা করে কী হবে– সেটি হচ্ছে বড় প্রশ্ন।
বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কি আর কোনো সুযোগ নেই– এমন প্রশ্নে হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপির যদি নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ থাকে সেটি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। নির্বাচন আয়োজক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন যদি আমাদের ডাকে আমরা নির্বাচন কমিশনে যাব।

গণতন্ত্র চাইলে আলোচনার বিকল্প নেই : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বুধবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের সদরদপ্তরে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৩ উদযাপন’ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, জনগণের ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে হলে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাই আলোচনার বিকল্প কিছু নেই। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি জনপ্রিয় দল। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে জনগণের ক্ষমতায় চলতে হবে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের আলোচনা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। তারা যেটা বলেছে, সেটাই যথেষ্ট। তারাই মনিটর করছে। আমরা এটুকু মনে করি, রাষ্ট্রদূতরা যাতে তাঁদের শিষ্টাচার মেনে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।




বিষয় : দুই মন্ত্রীর একই সুর অন্যজনের ভিন্নমত সংলাপ নিয়ে বিতর্ক

মন্তব্য করুন