
দেশের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় মেতেছেন প্রার্থী ও তাঁদের কর্মীরা। আচরণবিধিকে উপেক্ষা করে যখন-তখন শোডাউন করছেন প্রার্থীরা। মাঝে মধ্যে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পথসভা করতে দেখা যাচ্ছে। বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লেমিনেটিং পোস্টার সাঁটাচ্ছেন অনেকে। সরকারি কর্মকর্তারাও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। সরকারি জমির ওপর করা হয়েছে নৌকার নির্বাচনী অফিস। আঠা দিয়ে পোস্টার লাগানো হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটিতে। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ জানিয়েও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিকার মিলছে না। তবে খুলনায় গত ৭ দিনে ১৯ জন প্রার্থীকে জরিমানা করা হয়েছে।
সিলেট
সিলেট সিটি নির্বাচনে দুই প্রার্থী এবং এক রেজিস্ট্রারকে শোকজ করে হাত গুটিয়ে বসে আছে নির্বাচন কমিশন। অথচ প্রতিদিনই নগরীতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিলেও সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। নগরীতে মনিটরিং টিম থাকার কথা থাকলেও তা দেখা যাচ্ছে না। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে মনিটরিং টিম মাঠে নেমেছে বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
গত মঙ্গলবার ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সমাবেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশ নেন। তাঁরা নৌকার পক্ষে স্লোগান দেন।
সম্প্রতি নগরীর একটি হোটেলে মতবিনিময় সভায় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বদরুল ইসলাম শোয়েব আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের উপস্থিতিতে তাঁর পক্ষে ভোট চান। এ ঘটনায় সিলেট সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সল কাদের গত ১৪ মে তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।
গত ৩০ মে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন সিলেট রিটার্নিং কর্মকর্তা। নির্বাচন কমিশনের নীতিমালার তোয়াক্কা না করে প্রতীক বরাদ্দের আগে দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রচার চালানোর অভিযোগে তাঁদের শোকজ করা হয়।
এদিকে নগরীতে ব্যানার টানানো হয়েছে এবং লেমিনেশন করে নগরীজুড়ে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। পলিথিন দিয়ে এবং লেমিনেট করে মোড়ানো এসব পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো নগরী।
এ ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সল কাদের সমকালকে বলেন, অনেক প্রার্থী না বুঝে পলিথিন দিয়ে পোস্টার সাঁটিয়েছেন। তাঁরা নগরীজুড়ে অভিযান শুরু করেছেন। তাদের প্রতিটি টিম পাড়া-মহল্লায় মনিটর শুরু করেছে। পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীদের পোস্টার না সরালে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরিশাল
বুধবার রাত ৯টার দিকে ‘নৌকা-নৌকা’ স্লোগান দিয়ে কয়েকশ তরুণের একটি মিছিল নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হল অতিক্রম করে। সদর রোডের দক্ষিণ দিক থেকে আসা মিছিল উত্তর দিকে চলে যায়। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ আসিফ ওয়ালী ইনান। নির্বাচনী আচরণবিধিতে নিষিদ্ধ এরকম মিছিল ও মোটরসাইকেলের শোডাউন এখন বরিশাল নগরীতে নিয়মিত ঘটনা। ক্ষমতাসীন দলের নৌকার কর্মী-সমর্থকরাই প্রায় সব মিছিল-শোডাউন করছেন। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীদের।
গুরুতর অভিযোগ উঠেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩ এসআইর বিরুদ্ধেও।
তাঁরা নৌকার পক্ষালম্বন করে হাতপাখার প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এ অভিযোগ জানিয়ে ৩ এসআইকে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার জন্য পুলিশ কমিশনারে কাছে বৃহস্পতিবার আবেদন করেছে দলটি।
লাঙ্গল প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট অধ্যক্ষ মহসিন উল ইসলাম হাবুল বলেন, নৌকার আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে তাঁরা এ পর্যন্ত ১০টি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। মৌখিকভাবে নিয়মিত জানাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিকার মিলছে না।
জাতীয় পার্টির এই নেতা জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক কয়েকদিন আগে নগরীর রূপাতলীতে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অপসোনিনের কারখানার রেস্ট হাউজে বসে নৌকার নির্বাচনী কার্যক্রম চালান। সাগরদী সেতুর নিচে নৌকার নির্বাচনী কার্যালয় আলোকসজ্জা করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় সরকারি জমির ওপর করা হয়েছে নৌকার নির্বাচনী অফিস। ভাটিখানা এলাকায় সড়কের একাংশ দখল করে নৌকার কর্মিসভা করা হয়। বিভিন্ন কৌশলে প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিক নৌকার নির্বাচনী কার্যালয় করা হযেছে। এগুলোর প্রতিটির আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
হাতপাখার মিডিয়া সেলের সদস্য শরিয়ত উল্লাহ জানান, বিমানবন্দর থানার এসআই অনিল এবং কাউনিয়া থানার এসআই গোবিন্দ ও হরিদাস হাতপাখার প্রচারে অহেতুক প্রতিবন্ধকতা ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার জন্য বৃহস্পতিবার মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে আবেদন করা হয়েছে।
অপরদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে হাতপাখার প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে ধর্মের ব্যবহার ও টাকা ছড়ানোর অভিযোগ দিয়েছেন নৌকার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আফজালুল করীম। হাতপাখার প্রচার মাইকে ধর্মের ব্যবহারের অভিযোগ জানিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আরেকটি অভিযোগ দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আসাদুজ্জামান।
রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টি অনেক অভিযোগ তিনি এ পর্যন্ত পেয়েছেন। এগুলো নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নগদ অর্থ জরিমানা করা হয়েছে। হাতপাখার প্রার্থীর ধর্ম ব্যবহারের বিষয়টি নির্বাচন কমিশন থেকে দেখা হচ্ছে।
রাজশাহী
রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থীদের মধ্যে আচরণবিধির বালাই নেই। অনেক প্রার্থী নিজেই আচরণবিধি ভঙ্গ করছেন, কর্মী-সমর্থকরা তো আছেই। প্রার্থীরা বড় বড় শো ডাউন করছেন। পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুন, প্রচারণা সর্বত্রই লঙ্ঘিত হচ্ছে নির্বাচনী আইন। মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী কেউই আচরণবিধির তোয়াক্কা করছেন না।
নগরীর সব সড়ক, অলিগলিতে পোস্টার সাঁটিয়েছেন প্রার্থীরা। পুরো নগরীতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নৌকার পোস্টার চোখে পড়লেও অন্য তিন প্রার্থীর পোস্টার তেমন চোখে পড়েনি। নৌকার মেয়র প্রার্থীর পক্ষে অনেককেই বিভিন্ন সময় আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে দেখা গেছে। তবে মেয়র প্রার্থীর উপস্থিতিতে আচরণবিধি লঙ্ঘন খুব একটার চোখে পড়েনি। নির্বাচনী পোস্টার লেমিনেটিং ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও নগরীর সর্বত্র নৌকার প্রার্থীর লেমিনেটিং পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। অটোরিকশা ও ইজিবাইকের পেছনেও লাগানো হয়েছে পোস্টার। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও এ নির্বাচনের প্রার্থী শাহাদত আলী শাহুর পোস্টার আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটিতে। একই কাজ করেছেন সংরক্ষিত ১, ২ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী রওশন আরা ইসলাম। লেমিনেটিং পোস্টার লাগানো অবৈধ।
এ বিষয়ে সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি নিজেসহ ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট শহরে ঘুরছি। কোনো অনিয়ম থাকলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। মানুষজন ঘর থেকে বের না হলে জনগণ ভোট বুঝবে কীভাবে? তবে কোনো শো-ডাউনে রাস্তাঘাট বন্ধ হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। এখনও পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা
আচরণবিধি প্রতিপালনে বার বার সতর্ক করা হলেও তা মানছেন না খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কাউন্সিলর প্রার্থীরা। প্রায় প্রতিদিন প্রচারণার নামে শোডাউন, সড়ক আটকে সমাবেশ এবং মিছিল করার ঘটনা ঘটছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় গত ৭ দিনে ১৯ প্রার্থীকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘনের অপরাধে জরিমানা করার পরও আবার বিধি লঙ্ঘন করায় ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও প্রার্থী আনিসুর রহমান বিশ্বাসকে শোকজ করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সেখানে একই অপরাধ বার বার করায় কেন তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করা হবে না–তা জানাতে বলা হয়েছে।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১ জুনের পর থেকে প্রচারণার নামে মিছিল ও শোডাউন শুরু করেন প্রার্থীরা। বিশেষ করে নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদিন বিকেলে নারী কর্মীদের নিয়ে শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো। একইভাবে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভোট চাওয়ার নামে শোডাউন করতে দেখা যায় প্রার্থীদের।
আচরণবিধির ৭-এর ‘খ’ ধারায় রয়েছে, কোনো প্রার্থী পথসভা ও ঘরোয়া সভা করতে চাইলে প্রস্তাবিত সময়ের ২৪ ঘণ্টা আগে তাঁর স্থান এবং সময় সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে, যাতে ওই স্থানে চলাচল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। বাস্তবে ঘটছে তার উল্টোটা। প্রতিদিনই কাউন্সিলর প্রার্থীরা গণসংযোগকালে একাধিক পথসভা করছেন। রাস্তা বন্ধ করে এসব পথসভা করায় আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। বেশিরভাগ কাউন্সিলর প্রার্থী ফুটপাত দখল করে নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করেছেন।
আচরণবিধির ২০-এ বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল, অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন না। এ বিধিও মানছেন না প্রার্থীরা। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে প্রায় প্রত্যেক প্রার্থীই মসজিদের ভেতরে প্রচার চালান। ভোটারদের সঙ্গে কোলাকুলিসহ তাঁদের কাছে ভোট চান।
কেসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন জানান, ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে রয়েছেন। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
মন্তব্য করুন