- রাজনীতি
- সংলাপ নিয়ে নানা মত বামপন্থিদের
সংলাপ নিয়ে নানা মত বামপন্থিদের

প্রতীকী ছবি
চলমান রাজনীতির আলোচিত ইস্যু সংলাপ নিয়ে ভিন্নমত দেখাচ্ছে বামপন্থি দলগুলো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক বাম দলগুলো বলছে, সংলাপ নিয়ে যে কথাবার্তা চলছে, সেগুলো আসলে মাঠের কথা। আপাতত এই ধরনের সংলাপের কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। সরকারবিরোধী বাম দলগুলো বলছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এ সংলাপ অর্থবহ হবে। এ ছাড়া এর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না তারা। এর আগেও কয়েক দফায় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে এমন ধরনের ‘গুরুত্বহীন’সংলাপ হয়েছে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর দলগুলোর এই সংলাপে রাজনৈতিক সংকট বা জনগণের সংকটের কোনো সুরাহা হয়নি।
গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র আমির হোসেন আমু আগামী জাতীয় নির্বাচন ইস্যু ও চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। এরপর থেকেই রাজনীতির মাঠে সংলাপ নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়। যদিও এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই সংলাপের সম্ভাবনা কার্যত নাকচ করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক নেতা-মন্ত্রী আমুর ওই বক্তব্যকে তাঁর ব্যক্তিগত মত বলেও উড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, এ নিয়ে আওয়ামী লীগ, সরকার কিংবা ১৪ দলের কোনো পর্যায়ে কোনো ধরনের আলোচনাও হয়নি।
১৪ দল শরিকদের মতে, সংলাপের সম্ভাবনা নেই
শরিক বাম দলগুলো বলছে, সংলাপ নিয়ে ১৪ দলের মধ্যে এখনও কোনো আলোচনা ওঠেনি। জোটের সমন্বয়ক এ প্রসঙ্গে যে আলোচনার অবতারণা ঘটিয়েছেন, সেটি অতীতের উদাহরণ টানতে গিয়েই বলেছেন। তারপরও বলা যায়, সংলাপ হবে কি হবে না– সেটি নির্ভর করছে সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপর। অতীতের সংলাপ বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যে সংলাপটা হয়েছিল সেটাও হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে। আওয়ামী লীগ প্রধান সেবারও নিজ উদ্যোগে বিএনপিসহ সব দলকে ডেকে আলোচনায় বসেছিলেন। এবার সে ধরনের কোনো পরিবেশ এখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। ফলে আপাতত এ ধরনের কোনো আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এ ছাড়া আন্দোলনের মাঠে থাকা বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ছাড়া অন্য কোনো শর্ত মানতে রাজি নয়। সরকারের পদত্যাগের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে তারা। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধানের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো পন্থায় নির্বাচন হবে না। সংবিধানে ক্ষমতাসীন সরকারের মাধ্যমে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের কথাই বলা আছে। ক্ষমতাসীন ও সরকারবিরোধী প্রধান দলের এমন ‘অনড়’ অবস্থানের মধ্যে সংলাপে বসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বলেও মত ১৪ দল শরিকদের। তাছাড়া দাবি আদায়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার মতো সক্ষমতা বা সাংগঠনিক দক্ষতাও বিএনপি ও তার জোটের নেই। ফলে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীন দলটি আলোচনায় রাজি হবে– এমনটি মনে করার মতো কোনো কারণও নেই।
১৪ দল শরিক কয়েকজন নেতা বলছেন, তবে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংলাপে বসতে সম্মত হতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখলেও তারা এখন পর্যন্ত সংলাপ ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসেনি।
১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেছেন, আমির হোসেন আমু অতীতের উদাহরণ দিতে গিয়ে কথাটা বলেছেন বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলেছেন বলে মনে হয় না। তবে এই মুহূর্তে যে রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি, তাতে মনে হয় না আপাতত কোনো সংলাপ হবে বা হচ্ছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আমির হোসেন আমু যেটা বলেছেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তাধারা। এ বিষয়ে ১৪ দলে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বাংলাদেশে এমন কোনো রাজনৈতিক সংকটও তৈরি হয়নি যে, সে ব্যাপারে বিদেশিদের পরামর্শ বা মতামত নিতে হবে।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, সংকট নিরসনে সংলাপের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায়, এই ধরনের সংলাপ হবে বলে মনে হয় না। এককথায় বলা যায়, সংলাপের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
সরকারবিরোধী বামদের মতে ‘অপ্রয়োজনীয়’
সরকারবিরোধী বামপন্থি দলগুলোর প্রধান জোট বাম গণতান্ত্রিক জোট বর্তমানে অন্য বাম দল ও জোটের সঙ্গে ‘যুগপৎ আন্দোলনে’ রয়েছে। ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসান ও জনজীবনের সংকট নিরসনের দাবিতে এরই মধ্যে বামপন্থিদের আরেকটি জোট ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা’র সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাসদ ও ঐক্য ন্যাপের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিও পালন করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এরই মধ্যে সরকারের পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বামপন্থি এসব জোট ও দল।
সরকারবিরোধী এই বাম জোট ও দলগুলো বলছে, শাসকগোষ্ঠীর দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হলো কী হলো না, সেটা নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। কেননা অতীতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলকে কয়েকবারই সংলাপ বা আলোচনায় বসতে দেখা গেলেও কোনোটাই ফল বয়ে আনেনি। এতে রাজনৈতিক সংকট যেমন কাটেনি, তেমনি জনগণের সংকটেরও নিরসন হয়নি। ফলে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যকার অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বহীন এসব সংলাপে কোনো সমাধান মিলবে না। শেষ পর্যন্ত রাজনীতির মাঠে গণআন্দোলন ও গণসংগ্রামের মাধ্যমেই সংকট নিরসন করতে হবে।
কয়েকজন বাম নেতা বলেছেন, এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে নিকট অতীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় বহুল আলোচিত মান্নান ভূঁইয়া-আবদুল জলিল সংলাপ, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের মহাসচিব ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংলাপ এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের কথা বলা যায়। শেষ পর্যন্ত কোনো সংলাপই কার্যকর ফল বয়ে আনেনি। তাই আবার এ ধরনের কোনো সংলাপের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয় না।
এ প্রসঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, আমরা বলছি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। এই দাবি নিয়ে সংলাপ হলে, সেটাতে আমরা আগ্রহী। এর বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে সংলাপের কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, সংলাপ আমরা বারবার দেখেই চলেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এদেশে সংলাপ যেগুলো হয়, সেগুলোতে আসলে শাসকগোষ্ঠীর একজন আরেকজনকে প্রতারণা করে। এই সংলাপ করে লাভটা কী? রাজনীতির মাঠের আলোচনা যেটাই হোক না, আমরা এ ধরনের সংলাপের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
মন্তব্য করুন