
আদা আছে?
১০ জুলাই ১৫ । ০০:০০
শাখাওয়াৎ নয়ন

'আদা আছে?'
কথাটি জিজ্ঞেস করাটা আইজ্জা পাগলার অনেক দিনের রোগ। সে আর কোনো কথা বলে না। কেউ জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। গার্লস স্কুল, মহিলা কলেজ ছুটি হওয়ার সময় স্কুল-কলেজের গেটের সামনে হঠাৎ লাফ দিয়ে পড়ে বিকট জোরে চিৎকার করে বলে_
আদা আছে?
বেশিরভাগ মেয়েই পাগলকে ভয় পায়। ভয় তো পাবেই। পাগলের কোনো কাণ্ড জ্ঞান আছে? আইজ্জা পাগলার ভয়ে কারও কারও পিলে চমকে যাওয়ার দশা। মেয়েরা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। হাত থেকে বই-খাতা, মোবাইল পড়ে যায়। এই অপরাধের জন্য আইজ্জা পাগলা বেশ কয়েকবার মারও খেয়েছে। একবার তো গার্লস স্কুলের গেটের সামনে এক মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আইজ্জা পাগলা আর যায় কোথায়? মেয়ের ভাইয়েরা এসে কঠিন মার দিল। সেই মারেই পাগলার একটা চোখ নিবু নিবু হয়ে গেছে। মুখের সামনের দিকে ওপরের পাটির দুটি ও নিচের পাটির একটি দাঁত পড়ে গেছে। ঘটনাটি বিবিসির খবরের মতো চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল। মার খাওয়ার পর অনেক দিন পর্যন্ত আইজ্জা পাগলাকে আর দেখা যায়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই অদ্ভুতভাবে শহরের বখাটে ছেলেরা সবাই আইজ্জা পাগলা হয়ে গেল। কেউ কেউ মেয়েদের সামনে লাফ দিয়ে পড়ে বলে_
আদা আছে?
আবার কেউ কেউ রাতের বেলা যুবতীদের বাড়ির কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে_
আদা আছে?
কয়েক দিনের মধ্যেই রিকশাওয়ালা, বাসের হেলপার, ঠেলাগাড়ির চালকদের মধ্যে 'আদা আছে?' কথাটি খুব জনপ্রিয় হয়ে গেল। রাস্তায়, মার্কেটে 'আদা আছে?' কথাটি সংক্রামক ব্যাধির মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা সিনেমা হলে নায়িকার বিশেষ দৃশ্য এলে পিনপতন নীরবতা ভেঙে বিকট শব্দে কেউ কেউ চিৎকার করে বলে_
আদা আছে?
আদার যন্ত্রণায় মানুষ অস্থির হয়ে গেল। স্কুল-কলেজের মেয়েদের মধ্যে কাকে, কবে, কোথায়, কোন ছেলে 'আদা আছে?' বলেছে, তা গল্পের বিষয় হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। যেসব ছেলে জীবনে কোনো দিন মেয়েদের টিজ করত না, ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাও মেয়েদের দেখলে বলে_
আদা আছে?
এই সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি এলাকায় মারামারি পর্যন্ত হয়ে গেল। হবে না কী করবে? মফস্বলে প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে-বউদের টিজ করলে মারামারি তো হবেই। অবস্থা বেগতিক দেখে স্কুল-কলেজের পক্ষ থেকে মেয়েদের উত্ত্যক্তকারীদের শায়েস্তা করতে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হলো।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশি তৎপরতা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ইতিপূর্বে এসব উত্ত্যক্তকারীকে 'রোমিও কেইস'-এর আসামি বলা হতো। কেমন করে জানি দ্রুতই 'রোমিও কেইস' নামটি বদলে 'আদা কেইস' কথাটি চালু হয়ে গেল। কিন্তু পুলিশের এসব একদম ভালো লাগে না। তাদের একটাই কথা_
খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা রকম সমস্যা সামাল দেওয়াই কঠিন। তার ওপর কোত্থেকে এক আইজ্জা পাগলার 'আদা কেইস' নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব কার ভালো লাগে?
তাই যেটাকে ধরতে পারত, বিসমিল্লাহতেই আচ্ছামতো প্যাঁদানি দিত। তারপর জিজ্ঞেস করত_
বল শালা, তোর বাপের নাম কী?
আদা কেসে ধরা পড়লে বেশিরভাগ ছেলেই পুলিশের কাছে বাবার নাম ঠিকমতো বলতো না। কারণ, আদা কেইসে ধরা পড়া রোমিওদের বাবাকে খবর দিয়ে থানায় এনে মুচলেকা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে হতো। তাই রোমিওরা কম যেত না। পুলিশ বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে দুলাভাই কিংবা মামার নাম বলে দিত। এতেও যে সমস্যা হয়নি তা নয়। কয়েকবার অবিবাহিত মামাদের কাছেও খবর গেছে, যে তার ছেলে রোমিও কেসে ধরা পড়েছে।
স্কুল-কলেজের বাংলা শিক্ষকেরা 'আদা-জল খেয়ে লাগা', 'আদার বেপারি' টাইপের বাগধারা পড়াতে গিয়ে নিজেরাই হেসে ফেলেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, লোকজন দোকানে গিয়ে কিছু কিনুক বা না কিনুক প্রথমেই বলে_
আদা আছে?
সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে যখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে এলো, সবাই যখন ভাবল যে, আইজ্জা পাগলা আর বেঁচে নেই, ঠিক তখনই লোকচক্ষুর অন্তরালে সে একদিন রাতে গহীনাকুলে ফিরে আসে। কিন্তু তার পুরনো অভ্যাস একটুও বদলায়নি।
আইজ্জা পাগলা সালেহার স্বামী আলমের সহপাঠী, একসময়ের বন্ধু। একসঙ্গে 'গুনাই বিবি' যাত্রাপালা করেছে। সালেহার বিয়েতে সে বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিল। তার আসল নাম আজিজ ধুনকি। এই অঞ্চলে যারা লেপ-তোশক বানায়, তাদের বলে 'ধুনকি'। ধুনকি বংশের একজন ভালো ছেলে হিসেবে গ্রামে সবাই তাকে চিনত। আজিজ এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়াও করেছে। টাকা-পয়সা খরচ করে দালাল ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিল। সে যখন প্রথমবার দেশে আসে, আলম তখন বাড়িতে। আজিজ দেখা করতে এলে সালেহা জিজ্ঞেস করে_
ওই দ্যাশে ক্যামনে গ্যালেন, ভাই?
হেইয়া আর জিগাইয়েন না ভাবি। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া যে কী কষ্ট! হুইন্না করবেন কী?
কী রহম?
রাইতের আন্ধারে বন-জঙ্গল পার অইয়া যাইতে অয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ডারে থাহে শিকারি কুত্তা। মাইনষের চোখ ফাঁকি দেওন যায় কিন্তু কুত্তার চোখ কি ফাঁকি দেওন যায়?
তাইলে গ্যালেন ক্যামনে?
মোরা গেছি অন্য পতে।
হেই পতে কুত্তা আছিল না?
না। তয় আরও ভয়ঙ্কর জিনিস আছিল।
হেইডা আবার কী?
কুমির।
কন কী?
হ। ঠিকই কই। জ্যান্ত কুমির। শতে শতে কুমির।
এত কুমির পাইল কুতায়?
হেই জাগায় একটা গাঙ আছে। গাঙের মইধ্যে কুমির ছাইড়া রাখছে।
আপনে হেই গাঙ পার অইয়া গ্যাছেন?
হ।
ডর করে নাই?
না। মোরা কি জানতাম নিহি যে গাঙ ভরা কুমির?
জানতেন না ক্যা?
জানমু ক্যামনে? দালালে লইয়া গ্যাছে রাইতে। তহন রাইত বাজে দুইডা-তিনডা।
তারপর?
তারপর আর কী? গাঙের পাড় যাইয়া ব্যাকটিরে কয়, হাতরাইয়া পার অ।
আপনেরা পার অইতে পারছিলেন?
ব্যাকটি পারে নাই। দলে আছিলাম সতেরো জন। তিনজন দক্ষিণ আফ্রিকা যাইতে পারে নাই।
কই গ্যাছে?
কই যাইব আর? কুমিরের প্যাডে গ্যাছে।
হ্যাগো মইধ্যে মোগো দ্যাশের কেউ আছিল?
হ। একজন আছিল।
আহা রে! আপনের কিছু অয় নাই?
না। আল্লাহর রহমাত আছে।
কথাগুলো বলতে বলতে আজিজের চোখ ছলছল করে ওঠে। চেহারা অন্য রকম হয়ে যায়। পানি খেতে চায়। পানি খেয়ে একটু পরে আবার বলা শুরু করে_
দক্ষিণ আফ্রিকা ঢোহার পর প্রতম বেশ কয় দিন না খাইয়া থাকতে অইছে। তারপর এট্টা কয়লাখনিতে কাম পাই। বেতন-কড়ি ভালোই। তয় অনেক কষ্টের কাম।
দীর্ঘশ্বাস মেশানো গলায় কথাগুলো বলতে বলতে আজিজ সেদিন চলে যায়। তার কিছুদিন পরই সে বিয়ে করেছিল। সে কথা এখনও সালেহার স্পষ্ট মনে আছে। নতুন বউ নিয়ে দাওয়াত খেতে এসে আজিজ বলেছিল_
ভাবিজান, আপনেই কন, মর্জিনা অনেক সোন্দর না?
সালেহা এ রকম একটা প্রশ্নের জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না।
হ। সোন্দর। খুব সোন্দর।
কথাটি বলেই সালেহা হেসে দিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আজিজ বলেছিল_
নাইকোলের ইট্টু হলা দিতে পারবেন? না থাকলে থাউক।
পারমু। কী হারবেন?
দাঁত খোঁচাইমু।
দিতাছি।
দাঁত লইয়া আছি বড় জ্বালায়। কী যে করি? পানি খাইলেও দাঁতের মইধ্যে আটকায়।
সেদিন রাতে সালেহা আলমকে বলেছিল_
দেখছ, আজিজ ভাই মর্জিনারে কত্ত ভালোবাসে!
হ।
হ আবার কী? সত্যিই ভালোবাসে।
হ। বুঝছি তো, নতুন বিয়া করছে তো; যাউক না কয়ডা দিন।
তারপর শুধু কয়েক দিন নয় কয়েকটা বছর কেটেছে। মর্জিনার প্রতি তার ভালোবাসা একটুও কমেনি। বরং আজিজ মর্জিনাকে বিদেশে নিয়ে গেছে। খনি শ্রমিকের চাকরির কারণে মর্জিনাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারত না বলে নিজেকে অপরাধী মনে করত। তার চাকরিটা ছিল একটু অন্য রকমের। কয়লাখনিতে কয়লা ওঠানোর কূপে কাজ করতে হতো। কূপগুলো একেকটা তিনশ' থেকে দুই হাজার ফুট গভীর। সেই গভীর কূপের ভিতরে আজিজের কাজ। রুটিন অনুযায়ী কখনও দিনে কখনও রাতে ডিউটি করত। দিনের পর দিন মাসের পর মাস মাটির নিচে কাজ করে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ইতিপূর্বে কারও শারীরিক, কারও মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আজিজের কোনো সমস্যাই হয়নি। কারণ কাজকে সে পবিত্র এবাদত মনে করত। সবাইকে মজা করে বলত_
মানুষ মরলে তিন হাত মাডির নিচে যায়। মুই বাঁইচ্যা থাইক্যাই তিনশ' হাত মাডির নিচে যাই। মাডির নিচের জীবন কী জিনিস তা বুঝবা, একদিন বুঝবা। হা হা...।
কেউ কেউ পালটা প্রশ্ন করত_
এত নিচে যাও ক্যামনে আজিজ?
কন কী? লিফট আছে না?
মাটির নিচ থেকে বারো ঘণ্টা ডিউটি করে যখন ওপরে উঠত, আজিজ তখন বড় বড় চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পৃথিবীটা দেখত। এত আলো! এত বিশাল আকাশ! এত মানুষ! এত বাতাস! এত্ত কিছু_ সবই ভালো লাগত। যেসব জিনিস আগে তুচ্ছ মনে হতো, তাও ভারি সুন্দর লাগত। চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে করত_
পৃথিবীটা এত সোন্দর! জীবনটা এত সোন্দর! আগে তো বুঝি নাই!
খনিকূপ থেকে আজিজ উঠে আসার পর মর্জিনাকে তার কাছে বেহেশতের হুরপরীদের চেয়েও বেশি সুন্দরী মনে হতো। আজিজ তাকে অপলক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখত, কিন্তু মর্জিনাকে তা বোঝাতে পারত না। তাই বলত_
মর্জিনা, তুমারে যুদি কূপের মইধ্যে একদিন লইয়া যাইতে পারতাম! তাইলেই বুঝতা মর্জিনা।
আজিজ যখনই মর্জিনার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকত, তখনই মর্জিনা বলত_
আফনে এ রহম কইরা মোর দিকে চাইয়া কী দ্যাহেন? মুই কি অত সোন্দর?
আজিজ কোনো উত্তর দিতে পারত না। মুখে কথা আটকে যেত। শুধু মর্জিনার চোখের দিকে তাকালেই আজিজের এ রকম হয়। বুকের মধ্যে কেমন জানি করে। প্রায় সব কথার শুরুতে ও শেষেই 'মর্জিনা' নামটি উচ্চারণ করা তার প্রিয় অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ছুটির দিনগুলোয় একগাদা বাজার-সদাই করে এনে বলত_
মর্জিনা, অনেক দিন ইট্টুু ভালোমন্দ খাওয়া অয় না। ভালো কইরা রান্না করো তো মর্জিনা। জিল্লুরদের আইতে কইছি মর্জিনা।
ফরিদপুরের ছেলে জিল্লুর আজিজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গভীর রাতে একসঙ্গে কুমির ভরা নদী পার হয়েছে। একসঙ্গে কাজ করে। সবকিছুতেই জিল্লুরের প্রতি তার অনেক ভরসা। জিল্লুরও তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। মর্জিনা এসব দেখে প্রথম প্রথম বলত_
আফনে জিল্লুর ভাই রে এত বিশ্বাস করেন ক্যা? পর মানুষ রে কি এত বিশ্বাস করা ঠিক?
বিদেশে পরকেই আপন কইরা লইতে অয় মর্জিনা। নাইলে কি থাহন যায় মর্জিনা?
মর্জিনা আজিজের যুক্তি মেনে নিত। আজিজ প্রায় সব ছুটির দিনই খাওয়া-দাওয়া শেষে সঙ্গীদের নিয়ে তাসের আড্ডায় বসত। খেলা শেষ করার জন্য মর্জিনা তাড়া দিলে সে হা হা করে হেসে বলত_
মর্জিনা, এ রহম করো ক্যা? আর এক সেট মর্জিনা। এইটাই শ্যাষ মোনাজাত, মর্জিনা।
'শ্যাষ মোনাজাত' কথাটি বলেই মর্জিনাকে বলত_
মর্জিনা, এক কাপ চা দিবা নাকি, মর্জিনা?
এভাবে কমছে কম তিন-চার কিস্তি চা না খেয়ে তাসের আড্ডা ভাঙত না। যতবার চা দেওয়া হতো, ততবারই জিল্লুর হাসিমুখে বলত_
ভাবি যে চায়ের মইধ্যে কী জিনিস দেয়, এত দিনেও বুঝতে পারলাম না। ভাবি, ঘরে কি আদা আছে? চায়ের মইধ্যে আমার আবার একটু আদা খাওয়ার বদ অভ্যাস আছে।
মর্জিনা আদা দিয়েই জিল্লুরকে চা বানিয়ে দিত। বিয়ের মাত্র বছর দেড়েকের মাথায় এক রাতে আজিজ ডিউটিতে গেলে মর্জিনা জিল্লুরের সঙ্গে পালিয়ে যায়। সেই থেকে আজিজের মাথায় গণ্ডগোল। তখন থেকেই গ্রামের লোকজন বলাবলি করত_
আইজ্জা তিনশ' হাত মাডির গভীরে যাইতে পারলেও মর্জিনার মনের গভীরে যাইতে পারে নাই।
চাকরি থেকে আজিজ কিছু টাকাপয়সা পেয়েছিল। তার বাবা ও ভাইয়েরা ঠিকমতো চিকিৎসা না করে 'বউ পাগলা মানুষ কয় দিন গ্যালে এ্যামনেই ঠিক অইয়া যাইব' টাইপের কারণ দেখিয়ে টাকা-পয়সাগুলো খেয়ে ফেলে। এক সময় আজিজের অসুস্থতা আরও বেড়ে গেলে বাড়ি থেকে তাকে বের করে দেয়। প্রায় চোখের সামনেই একজন আজিজ ধুনকি 'আইজ্জা পাগলা' হয়ে গেল। আজকাল মাঝেমধ্যেই সে সালেহার বাড়ির সামনে রাস্তায় ছাতিমগাছটির নিচে দিন-রাত শুয়ে-বসে থাকে। নীরবে কাঁদে। কিছুদিন হলো তার সঙ্গে একটি রুগ্ণ, হাড্ডিসার কুকুর জুটেছে। গভীর রাতে আশপাশে কোনো কিছুর উপস্থিতি টের পেলেই আইজ্জা পাগলা বিকট শব্দে 'আদা আছে' বলে চিৎকার করে। কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে। গহীনাকুল গ্রামের ঘুমন্ত মানুষজন জেগে ওঠে। মেয়েদের দেখলেই যে আইজ্জা পাগলা বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে_
আদা আছে?
কিন্তু সেই আইজ্জা পাগলা সালেহাকে দেখলে কিছুই বলে না। তার নিবু নিবু চোখেই অপলক চেয়ে থাকে। সালেহাও তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, মানুষের জীবনটা কেমন? মানুষের জীবন কি শুধু তার নিজের কর্মফল? নাকি অনেকের সঙ্গে বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার ফলাফল? বউয়ের জন্য আজিজ পাগল হয়ে গেছে। আলমও তো সালেহাকে ফেলে গত পাঁচ-পাঁচটা বছর নিরুদ্দেশ। সে-ও কি তাহলে একদিন পাগল হয়ে যাবে? হ
কথাটি জিজ্ঞেস করাটা আইজ্জা পাগলার অনেক দিনের রোগ। সে আর কোনো কথা বলে না। কেউ জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। গার্লস স্কুল, মহিলা কলেজ ছুটি হওয়ার সময় স্কুল-কলেজের গেটের সামনে হঠাৎ লাফ দিয়ে পড়ে বিকট জোরে চিৎকার করে বলে_
আদা আছে?
বেশিরভাগ মেয়েই পাগলকে ভয় পায়। ভয় তো পাবেই। পাগলের কোনো কাণ্ড জ্ঞান আছে? আইজ্জা পাগলার ভয়ে কারও কারও পিলে চমকে যাওয়ার দশা। মেয়েরা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। হাত থেকে বই-খাতা, মোবাইল পড়ে যায়। এই অপরাধের জন্য আইজ্জা পাগলা বেশ কয়েকবার মারও খেয়েছে। একবার তো গার্লস স্কুলের গেটের সামনে এক মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আইজ্জা পাগলা আর যায় কোথায়? মেয়ের ভাইয়েরা এসে কঠিন মার দিল। সেই মারেই পাগলার একটা চোখ নিবু নিবু হয়ে গেছে। মুখের সামনের দিকে ওপরের পাটির দুটি ও নিচের পাটির একটি দাঁত পড়ে গেছে। ঘটনাটি বিবিসির খবরের মতো চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল। মার খাওয়ার পর অনেক দিন পর্যন্ত আইজ্জা পাগলাকে আর দেখা যায়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই অদ্ভুতভাবে শহরের বখাটে ছেলেরা সবাই আইজ্জা পাগলা হয়ে গেল। কেউ কেউ মেয়েদের সামনে লাফ দিয়ে পড়ে বলে_
আদা আছে?
আবার কেউ কেউ রাতের বেলা যুবতীদের বাড়ির কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে_
আদা আছে?
কয়েক দিনের মধ্যেই রিকশাওয়ালা, বাসের হেলপার, ঠেলাগাড়ির চালকদের মধ্যে 'আদা আছে?' কথাটি খুব জনপ্রিয় হয়ে গেল। রাস্তায়, মার্কেটে 'আদা আছে?' কথাটি সংক্রামক ব্যাধির মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা সিনেমা হলে নায়িকার বিশেষ দৃশ্য এলে পিনপতন নীরবতা ভেঙে বিকট শব্দে কেউ কেউ চিৎকার করে বলে_
আদা আছে?
আদার যন্ত্রণায় মানুষ অস্থির হয়ে গেল। স্কুল-কলেজের মেয়েদের মধ্যে কাকে, কবে, কোথায়, কোন ছেলে 'আদা আছে?' বলেছে, তা গল্পের বিষয় হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। যেসব ছেলে জীবনে কোনো দিন মেয়েদের টিজ করত না, ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাও মেয়েদের দেখলে বলে_
আদা আছে?
এই সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি এলাকায় মারামারি পর্যন্ত হয়ে গেল। হবে না কী করবে? মফস্বলে প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে-বউদের টিজ করলে মারামারি তো হবেই। অবস্থা বেগতিক দেখে স্কুল-কলেজের পক্ষ থেকে মেয়েদের উত্ত্যক্তকারীদের শায়েস্তা করতে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হলো।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশি তৎপরতা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ইতিপূর্বে এসব উত্ত্যক্তকারীকে 'রোমিও কেইস'-এর আসামি বলা হতো। কেমন করে জানি দ্রুতই 'রোমিও কেইস' নামটি বদলে 'আদা কেইস' কথাটি চালু হয়ে গেল। কিন্তু পুলিশের এসব একদম ভালো লাগে না। তাদের একটাই কথা_
খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা রকম সমস্যা সামাল দেওয়াই কঠিন। তার ওপর কোত্থেকে এক আইজ্জা পাগলার 'আদা কেইস' নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব কার ভালো লাগে?
তাই যেটাকে ধরতে পারত, বিসমিল্লাহতেই আচ্ছামতো প্যাঁদানি দিত। তারপর জিজ্ঞেস করত_
বল শালা, তোর বাপের নাম কী?
আদা কেসে ধরা পড়লে বেশিরভাগ ছেলেই পুলিশের কাছে বাবার নাম ঠিকমতো বলতো না। কারণ, আদা কেইসে ধরা পড়া রোমিওদের বাবাকে খবর দিয়ে থানায় এনে মুচলেকা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে হতো। তাই রোমিওরা কম যেত না। পুলিশ বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে দুলাভাই কিংবা মামার নাম বলে দিত। এতেও যে সমস্যা হয়নি তা নয়। কয়েকবার অবিবাহিত মামাদের কাছেও খবর গেছে, যে তার ছেলে রোমিও কেসে ধরা পড়েছে।
স্কুল-কলেজের বাংলা শিক্ষকেরা 'আদা-জল খেয়ে লাগা', 'আদার বেপারি' টাইপের বাগধারা পড়াতে গিয়ে নিজেরাই হেসে ফেলেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, লোকজন দোকানে গিয়ে কিছু কিনুক বা না কিনুক প্রথমেই বলে_
আদা আছে?
সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে যখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে এলো, সবাই যখন ভাবল যে, আইজ্জা পাগলা আর বেঁচে নেই, ঠিক তখনই লোকচক্ষুর অন্তরালে সে একদিন রাতে গহীনাকুলে ফিরে আসে। কিন্তু তার পুরনো অভ্যাস একটুও বদলায়নি।
আইজ্জা পাগলা সালেহার স্বামী আলমের সহপাঠী, একসময়ের বন্ধু। একসঙ্গে 'গুনাই বিবি' যাত্রাপালা করেছে। সালেহার বিয়েতে সে বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিল। তার আসল নাম আজিজ ধুনকি। এই অঞ্চলে যারা লেপ-তোশক বানায়, তাদের বলে 'ধুনকি'। ধুনকি বংশের একজন ভালো ছেলে হিসেবে গ্রামে সবাই তাকে চিনত। আজিজ এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়াও করেছে। টাকা-পয়সা খরচ করে দালাল ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিল। সে যখন প্রথমবার দেশে আসে, আলম তখন বাড়িতে। আজিজ দেখা করতে এলে সালেহা জিজ্ঞেস করে_
ওই দ্যাশে ক্যামনে গ্যালেন, ভাই?
হেইয়া আর জিগাইয়েন না ভাবি। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া যে কী কষ্ট! হুইন্না করবেন কী?
কী রহম?
রাইতের আন্ধারে বন-জঙ্গল পার অইয়া যাইতে অয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ডারে থাহে শিকারি কুত্তা। মাইনষের চোখ ফাঁকি দেওন যায় কিন্তু কুত্তার চোখ কি ফাঁকি দেওন যায়?
তাইলে গ্যালেন ক্যামনে?
মোরা গেছি অন্য পতে।
হেই পতে কুত্তা আছিল না?
না। তয় আরও ভয়ঙ্কর জিনিস আছিল।
হেইডা আবার কী?
কুমির।
কন কী?
হ। ঠিকই কই। জ্যান্ত কুমির। শতে শতে কুমির।
এত কুমির পাইল কুতায়?
হেই জাগায় একটা গাঙ আছে। গাঙের মইধ্যে কুমির ছাইড়া রাখছে।
আপনে হেই গাঙ পার অইয়া গ্যাছেন?
হ।
ডর করে নাই?
না। মোরা কি জানতাম নিহি যে গাঙ ভরা কুমির?
জানতেন না ক্যা?
জানমু ক্যামনে? দালালে লইয়া গ্যাছে রাইতে। তহন রাইত বাজে দুইডা-তিনডা।
তারপর?
তারপর আর কী? গাঙের পাড় যাইয়া ব্যাকটিরে কয়, হাতরাইয়া পার অ।
আপনেরা পার অইতে পারছিলেন?
ব্যাকটি পারে নাই। দলে আছিলাম সতেরো জন। তিনজন দক্ষিণ আফ্রিকা যাইতে পারে নাই।
কই গ্যাছে?
কই যাইব আর? কুমিরের প্যাডে গ্যাছে।
হ্যাগো মইধ্যে মোগো দ্যাশের কেউ আছিল?
হ। একজন আছিল।
আহা রে! আপনের কিছু অয় নাই?
না। আল্লাহর রহমাত আছে।
কথাগুলো বলতে বলতে আজিজের চোখ ছলছল করে ওঠে। চেহারা অন্য রকম হয়ে যায়। পানি খেতে চায়। পানি খেয়ে একটু পরে আবার বলা শুরু করে_
দক্ষিণ আফ্রিকা ঢোহার পর প্রতম বেশ কয় দিন না খাইয়া থাকতে অইছে। তারপর এট্টা কয়লাখনিতে কাম পাই। বেতন-কড়ি ভালোই। তয় অনেক কষ্টের কাম।
দীর্ঘশ্বাস মেশানো গলায় কথাগুলো বলতে বলতে আজিজ সেদিন চলে যায়। তার কিছুদিন পরই সে বিয়ে করেছিল। সে কথা এখনও সালেহার স্পষ্ট মনে আছে। নতুন বউ নিয়ে দাওয়াত খেতে এসে আজিজ বলেছিল_
ভাবিজান, আপনেই কন, মর্জিনা অনেক সোন্দর না?
সালেহা এ রকম একটা প্রশ্নের জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না।
হ। সোন্দর। খুব সোন্দর।
কথাটি বলেই সালেহা হেসে দিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আজিজ বলেছিল_
নাইকোলের ইট্টু হলা দিতে পারবেন? না থাকলে থাউক।
পারমু। কী হারবেন?
দাঁত খোঁচাইমু।
দিতাছি।
দাঁত লইয়া আছি বড় জ্বালায়। কী যে করি? পানি খাইলেও দাঁতের মইধ্যে আটকায়।
সেদিন রাতে সালেহা আলমকে বলেছিল_
দেখছ, আজিজ ভাই মর্জিনারে কত্ত ভালোবাসে!
হ।
হ আবার কী? সত্যিই ভালোবাসে।
হ। বুঝছি তো, নতুন বিয়া করছে তো; যাউক না কয়ডা দিন।
তারপর শুধু কয়েক দিন নয় কয়েকটা বছর কেটেছে। মর্জিনার প্রতি তার ভালোবাসা একটুও কমেনি। বরং আজিজ মর্জিনাকে বিদেশে নিয়ে গেছে। খনি শ্রমিকের চাকরির কারণে মর্জিনাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারত না বলে নিজেকে অপরাধী মনে করত। তার চাকরিটা ছিল একটু অন্য রকমের। কয়লাখনিতে কয়লা ওঠানোর কূপে কাজ করতে হতো। কূপগুলো একেকটা তিনশ' থেকে দুই হাজার ফুট গভীর। সেই গভীর কূপের ভিতরে আজিজের কাজ। রুটিন অনুযায়ী কখনও দিনে কখনও রাতে ডিউটি করত। দিনের পর দিন মাসের পর মাস মাটির নিচে কাজ করে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ইতিপূর্বে কারও শারীরিক, কারও মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আজিজের কোনো সমস্যাই হয়নি। কারণ কাজকে সে পবিত্র এবাদত মনে করত। সবাইকে মজা করে বলত_
মানুষ মরলে তিন হাত মাডির নিচে যায়। মুই বাঁইচ্যা থাইক্যাই তিনশ' হাত মাডির নিচে যাই। মাডির নিচের জীবন কী জিনিস তা বুঝবা, একদিন বুঝবা। হা হা...।
কেউ কেউ পালটা প্রশ্ন করত_
এত নিচে যাও ক্যামনে আজিজ?
কন কী? লিফট আছে না?
মাটির নিচ থেকে বারো ঘণ্টা ডিউটি করে যখন ওপরে উঠত, আজিজ তখন বড় বড় চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পৃথিবীটা দেখত। এত আলো! এত বিশাল আকাশ! এত মানুষ! এত বাতাস! এত্ত কিছু_ সবই ভালো লাগত। যেসব জিনিস আগে তুচ্ছ মনে হতো, তাও ভারি সুন্দর লাগত। চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে করত_
পৃথিবীটা এত সোন্দর! জীবনটা এত সোন্দর! আগে তো বুঝি নাই!
খনিকূপ থেকে আজিজ উঠে আসার পর মর্জিনাকে তার কাছে বেহেশতের হুরপরীদের চেয়েও বেশি সুন্দরী মনে হতো। আজিজ তাকে অপলক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখত, কিন্তু মর্জিনাকে তা বোঝাতে পারত না। তাই বলত_
মর্জিনা, তুমারে যুদি কূপের মইধ্যে একদিন লইয়া যাইতে পারতাম! তাইলেই বুঝতা মর্জিনা।
আজিজ যখনই মর্জিনার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকত, তখনই মর্জিনা বলত_
আফনে এ রহম কইরা মোর দিকে চাইয়া কী দ্যাহেন? মুই কি অত সোন্দর?
আজিজ কোনো উত্তর দিতে পারত না। মুখে কথা আটকে যেত। শুধু মর্জিনার চোখের দিকে তাকালেই আজিজের এ রকম হয়। বুকের মধ্যে কেমন জানি করে। প্রায় সব কথার শুরুতে ও শেষেই 'মর্জিনা' নামটি উচ্চারণ করা তার প্রিয় অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ছুটির দিনগুলোয় একগাদা বাজার-সদাই করে এনে বলত_
মর্জিনা, অনেক দিন ইট্টুু ভালোমন্দ খাওয়া অয় না। ভালো কইরা রান্না করো তো মর্জিনা। জিল্লুরদের আইতে কইছি মর্জিনা।
ফরিদপুরের ছেলে জিল্লুর আজিজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গভীর রাতে একসঙ্গে কুমির ভরা নদী পার হয়েছে। একসঙ্গে কাজ করে। সবকিছুতেই জিল্লুরের প্রতি তার অনেক ভরসা। জিল্লুরও তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। মর্জিনা এসব দেখে প্রথম প্রথম বলত_
আফনে জিল্লুর ভাই রে এত বিশ্বাস করেন ক্যা? পর মানুষ রে কি এত বিশ্বাস করা ঠিক?
বিদেশে পরকেই আপন কইরা লইতে অয় মর্জিনা। নাইলে কি থাহন যায় মর্জিনা?
মর্জিনা আজিজের যুক্তি মেনে নিত। আজিজ প্রায় সব ছুটির দিনই খাওয়া-দাওয়া শেষে সঙ্গীদের নিয়ে তাসের আড্ডায় বসত। খেলা শেষ করার জন্য মর্জিনা তাড়া দিলে সে হা হা করে হেসে বলত_
মর্জিনা, এ রহম করো ক্যা? আর এক সেট মর্জিনা। এইটাই শ্যাষ মোনাজাত, মর্জিনা।
'শ্যাষ মোনাজাত' কথাটি বলেই মর্জিনাকে বলত_
মর্জিনা, এক কাপ চা দিবা নাকি, মর্জিনা?
এভাবে কমছে কম তিন-চার কিস্তি চা না খেয়ে তাসের আড্ডা ভাঙত না। যতবার চা দেওয়া হতো, ততবারই জিল্লুর হাসিমুখে বলত_
ভাবি যে চায়ের মইধ্যে কী জিনিস দেয়, এত দিনেও বুঝতে পারলাম না। ভাবি, ঘরে কি আদা আছে? চায়ের মইধ্যে আমার আবার একটু আদা খাওয়ার বদ অভ্যাস আছে।
মর্জিনা আদা দিয়েই জিল্লুরকে চা বানিয়ে দিত। বিয়ের মাত্র বছর দেড়েকের মাথায় এক রাতে আজিজ ডিউটিতে গেলে মর্জিনা জিল্লুরের সঙ্গে পালিয়ে যায়। সেই থেকে আজিজের মাথায় গণ্ডগোল। তখন থেকেই গ্রামের লোকজন বলাবলি করত_
আইজ্জা তিনশ' হাত মাডির গভীরে যাইতে পারলেও মর্জিনার মনের গভীরে যাইতে পারে নাই।
চাকরি থেকে আজিজ কিছু টাকাপয়সা পেয়েছিল। তার বাবা ও ভাইয়েরা ঠিকমতো চিকিৎসা না করে 'বউ পাগলা মানুষ কয় দিন গ্যালে এ্যামনেই ঠিক অইয়া যাইব' টাইপের কারণ দেখিয়ে টাকা-পয়সাগুলো খেয়ে ফেলে। এক সময় আজিজের অসুস্থতা আরও বেড়ে গেলে বাড়ি থেকে তাকে বের করে দেয়। প্রায় চোখের সামনেই একজন আজিজ ধুনকি 'আইজ্জা পাগলা' হয়ে গেল। আজকাল মাঝেমধ্যেই সে সালেহার বাড়ির সামনে রাস্তায় ছাতিমগাছটির নিচে দিন-রাত শুয়ে-বসে থাকে। নীরবে কাঁদে। কিছুদিন হলো তার সঙ্গে একটি রুগ্ণ, হাড্ডিসার কুকুর জুটেছে। গভীর রাতে আশপাশে কোনো কিছুর উপস্থিতি টের পেলেই আইজ্জা পাগলা বিকট শব্দে 'আদা আছে' বলে চিৎকার করে। কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে। গহীনাকুল গ্রামের ঘুমন্ত মানুষজন জেগে ওঠে। মেয়েদের দেখলেই যে আইজ্জা পাগলা বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে_
আদা আছে?
কিন্তু সেই আইজ্জা পাগলা সালেহাকে দেখলে কিছুই বলে না। তার নিবু নিবু চোখেই অপলক চেয়ে থাকে। সালেহাও তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, মানুষের জীবনটা কেমন? মানুষের জীবন কি শুধু তার নিজের কর্মফল? নাকি অনেকের সঙ্গে বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার ফলাফল? বউয়ের জন্য আজিজ পাগল হয়ে গেছে। আলমও তো সালেহাকে ফেলে গত পাঁচ-পাঁচটা বছর নিরুদ্দেশ। সে-ও কি তাহলে একদিন পাগল হয়ে যাবে? হ
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com