
গেস্টরুম কালচারের নামে ছাত্রলীগের 'আদালত'
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ১৬ । ০২:২১ | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ১৬ । ১৭:১২
সাব্বির নেওয়াজ

জসীম উদ্দীন হলের গেস্টরুম; এ রকম রুমেই বসে বিচারের নামে 'আদালত'-সমকাল
৪ নভেম্বর শুক্রবার। রাত সাড়ে ৮টা। ঘটনাস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হলের গেস্টরুম। হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সারওয়ার হোসেন চতুর্থ বর্ষের ১৪-১৫ জন সাধারণ শিক্ষার্থীকে ডেকে পাঠালেন। তারা আসার পর তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের কার্যক্রমে অংশ না নেওয়ার অভিযোগ তুললেন তিনি। তারপর ঘোষিত হলো চূড়ান্ত রায়, কক্ষগুলোতে তারা আর থাকতে পারবেন না। তাদের কাকুতি-মিনতিতেও কাজ হলো না। পরদিন ৫ নভেম্বর শনিবারও সারওয়ার আরও কয়েকজন ছাত্রকে একইভাবে গেস্টরুমে 'আদালত' বসিয়ে রুম থেকে 'বহিষ্কার' করলেন। এভাবে সূর্য সেন হলের ছয়টি কক্ষ থেকে চলে যেতে হলো চতুর্থ বর্ষের ৩০ ছাত্রকে! তাদের জায়গা হলো গণরুমে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বহুল আলোচিত গেস্টরুম কালচারেও পরিবর্তন এসেছে।
মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপ চুরি থেকে শুরু করে ছিঁচকে চুরিরও বিচার-আচার হয় হলগুলোর গেস্টরুমে। শাস্তিও দেওয়া হয়। গেস্টরুমের আদেশ-নির্দেশগুলো অবশ্যই মানতে হয় হলের সবাইকে। অনেক সময় ছাত্রনেতাদের কক্ষও ব্যবহৃত হয় এমন কাজে। তাই গেস্টরুমে হোক আর ছাত্রনেতাদের কক্ষে হোক, এ ধরনের বৈঠকে হাজিরা দিয়ে সিদ্ধান্ত শোনা ও মানাকে সাধারণ ছাত্ররা বলে থাকেন 'গেস্টরুম করা'।
গত ৪ ও ৫ নভেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে জানতে সূর্য সেন হলে গিয়ে সমকালের পক্ষ থেকে কথা বলা হয় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। স্বনামে বক্তব্য দিতে তারা কেউ রাজি হননি। তাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের সূর্য সেন হল শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সারওয়ার হোসেন ওই দু'দিনে হলের ৪২৮, ৪৩৩, ৪৩৬, ৪৪১, ৪৪৫ ও ৪৪৭ নম্বর কক্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষের ৩০ জন ছাত্রকে বের করে দিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করে দেন। উচ্ছেদ করা ছাত্রদের হলের গণরুমে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকতে পাঠানো হয়। ছাত্রলীগের হল শাখার শীর্ষ দুই পদের একটির প্রত্যাশী সারওয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসানের অনুসারী। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোবারক হোসেন এর আগে সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। উচ্ছেদ করা ছাত্রদের তিনি একসময় এসব কক্ষে তুলেছিলেন। ওই ছাত্ররা তখন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। পরে কয়েক বছর ধরে রুমগুলোতে থাকলেও এগুলোর বরাদ্দ নেওয়া হয়নি বলে জানান ভুক্তভোগী ছাত্ররা। তারা বলেন, 'চতুর্থ বর্ষে এসে পড়াশোনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় সব প্রোগ্রামে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এখন কই থাকব?' এ বিষয়ে জানতে চাইলে সারওয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, 'তাদের এসব রুম থেকে সরিয়ে অন্য রুমে দেওয়া হয়েছে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল রয়েছে ১৯টি। এগুলোর মধ্যে ছাত্রদের ১৩টি, ছাত্রীদের পাঁচটি এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি। হোস্টেল রয়েছে তিনটি। এগুলোর মধ্যে দুটি ছাত্রদের, অন্যটি ছাত্রীদের। এসব আবাসিক স্থাপনায় ধারণ ক্ষমতা আবাসিক ১১ হাজার ৫৪৯ এবং দ্বৈতাবাসিক ৯ হাজার ২৭৫ জন। নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছাত্রীনিবাসে পিএইচডি এবং এমফিল গবেষণায় নিয়োজিত ছাত্রীরা থাকেন। সেখানে আবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ১৬০ জন। আইবিএ হোস্টেলের আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩৬ জন। ছাত্রীদের হলগুলোতে শিক্ষকদের মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ থাকলেও ছাত্রদের হলে তা একদমই নেই। ছাত্রদের ১৩টি হলে আবাসিক ও দ্বৈতাবাসিক শিক্ষার্থী মিলিয়ে ধারণ ক্ষমতা ১৪ হাজার ২২৭ জন।
গেস্টরুম কালচার: প্রতিটি হলেই একটি গেস্টরুম রয়েছে। হলের আবাসিক কিংবা দ্বৈতাবাসিক ছাত্রের সঙ্গে দেখা করতে কোনো অতিথি এলে তাকে সেখানে বসতে দেওয়া হয়। ছাত্ররা এখানে নিয়মিত সংবাদপত্র পড়েন। তবে এই রুমের আরেকটি ব্যবহার আছে, যা পুরোপুরি রাজনৈতিক। আবাসিক হলগুলোর গেস্টরুমগুলো ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে। নির্দিষ্ট রাতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার, সৌজন্যতা বোধ, সিনিয়রদের সালাম দেওয়া বা না দেওয়া, গ্রুপের নিয়ম-কানুন মানা বা না মানা ইত্যাদি বিষয়ে বিচার-সালিশের জন্য সিনিয়র নেতারা এখানে জড়ো হয়ে আড্ডার মধ্য দিয়ে যে কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তাই 'গেস্টরুম কালচার' নামে বহুল পরিচিত। বর্তমানে ঢাবির প্রতিটি হলেই ছাত্রলীগের অঞ্চলভিত্তিক পাঁচ-ছয়টি গ্রুপ নিজ নিজ কর্মীদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা জানান, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ঠাণ্ডাজনিত নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের হলের প্রথম বর্ষের ছাত্র হাফিজুর মোল্লা। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন এসএম হলের বারান্দায় বসবাস করায় ও শীতের সময় কনকনে ঠাণ্ডায় গভীর রাত পর্যন্ত হল শাখা ছাত্রলীগের গেস্টরুম কালচারের শিকার হওয়ায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি। হল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, পরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। গ্রামে চলে যাওয়ায় যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তার মৃত্যু হয়েছে।
গত বছর মার্চেও সূর্য সেন হলে গেস্টরুম কালচারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে চারজন গুরুতর আহত হন। ঘটনার রাতে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা মিনি গেস্টরুম নেওয়ার জন্য প্রথম বর্ষের চার ছাত্রকে ২২৬-ক নম্বর রুম থেকে ২২৭ নম্বর রুমে ডাকেন। ওই সময় পরীক্ষা থাকায় প্রথম বর্ষের ওই শিক্ষার্থীরা গেস্টরুমে আসতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা তাদের রড ও চাপাতি নিয়ে হামলা করে। একই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলে অপর একটি ঘটনায় আহত হন বেশ কয়েকজন। প্রথম বর্ষের তোফায়েল আহমেদ সংগঠনের কর্মসূচি থেকে ছুটি নিয়ে হলে আসার জের ধরে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রবিনকে মারধর করেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের সোহেল রানা। এ ঘটনায় সেই রাতে গেস্টরুম বর্জন করেন হলের ১১০ ও ১১১ নম্বর কক্ষের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। পরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই দুই রুমে রাত ১১টার দিকে তালা লাগিয়ে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রচণ্ড মারধর করা হয় প্রথম বর্ষের ওই শিক্ষার্থীদের।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর ছাত্রলীগের হল কমিটিতে পদ না নেওয়ায় ও সংগঠনের কর্মসূচিতে উপস্থিত না হওয়ায় রাতের আঁধারে সূর্য সেন হলের গেস্টরুমে দুই শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম ও মোস্তাফিজুর রহমানকে 'শিবির কর্মী সন্দেহে' ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়। তারা দু'জনই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। ওই ঘটনায় হল প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সেটি কখনও আলোর মুখ দেখেনি। এভাবে প্রতিটি হলের গেস্টরুম করাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই নির্যাতনের খবরও শোনা যায়।
গেস্টরুমের ভালো দিক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলেই অতীতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় বছরের পর বছর সিনিয়ররা তাদের জুনিয়রদের বিভিন্ন নিয়ম-কানুনের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা তাদের জুনিয়রদের নিয়ে একসঙ্গে গেস্টরুমে জড়ো হতেন বা এখনও হন। পারস্পরিক আলোচনায় নিজ নিজ ছাত্র সংগঠনের নীতি, আদর্শ ইত্যাদি ছাড়াও সাংস্কৃতিক আচরণ ও আদর্শবোধ উঠে আসে। কনিষ্ঠ কারও কোনো সমস্যা থাকলে জ্যেষ্ঠরা তা শুনে সমাধান করার চেষ্টা করেন। সংগঠনের কর্মীদের ভেতরের দ্বন্দ্ব, মারামারি ও সংঘর্ষের ঘটনা মীমাংসাও হয় এই গেস্টরুমে বসে। কখনও কখনও মুক্তবুদ্ধির চর্চা, পারস্পরিক যোগাযোগ, কুশল বিনিময় ও ভাবের আদান-প্রদানও হয়ে থাকে গেস্টরুমের আড্ডাগুলোতে। কিছু দিন আগে ঢাবির হলগুলোতে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পাঠের আয়োজন করেছিল। সে সময় আত্মজীবনী পাঠ শেষে মৌখিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে মনোযোগী ছাত্রদের পুরস্কৃতও করা হয়। এর বাইরেও ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, সরকারের ঘোষণা করা ভিশন ২০২১ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। আড্ডার মধ্য দিয়ে হলের জুনিয়রদের তাদের সিনিয়রদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এক কথায় হল জীবনের সামাজিকীকরণে গেস্টরুম সংস্কৃতি নবীন ছাত্রের জন্য অনেকটা সহায়ক।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য: সূর্য সেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল গেস্টরুম কালচারের কথা স্বীকার করে সমকালকে বলেন, 'গেস্টরুম কালচার আছে। তবে একটি হলে একজন ছাত্রের প্রাণ যাওয়ার পর আমরা প্রভোস্টরা এ বিষয়ে সচেতন হয়েছি।' তিনি বলেন, 'প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের যেসব ছাত্রনেতা হলে তোলেন, তারা মনে করেন এ ছাত্ররা তাদের পক্ষেই স্লোগান দেবে। নেতারা তাদের সেভাবেই ব্যবহার করতে চান।' তিনি আরও বলেন, 'তবে গেস্টরুম কালচার থাকলেও হলে অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই। আশির দশকে আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন হলগুলোতে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। আজ সে পরিবেশ অনেক বদলে গেছে। ছাত্রদের পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থা করা গেলে এ সমস্যাও কেটে যাবে।'
কবি জসীমউদ্দীন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. রহমতউল্লাহ অবশ্য সমকালকে বলেন, 'কবি জসীমউদ্দীন হলে ছাত্রলীগের কোনো গেস্টরুম আছে বলে আমার জানা নেই। গেস্টরুম কালচার বলেও কিছু আছে বলে জানি না আমি। এই হলে ডিবেটিং সোসাইটি আছে, বাঁধন আছে। তাদের কার্যালয়ও আছে। তবে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কালচার, ম্যানার শেখানো হয়_ এমন কোনো রুমের কথা আমার জানা নেই।'
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান সমকালকে বলেন, 'প্রথম বর্ষের ছাত্রদের তো আমরা সিট দিতে পারছি না। স্বাভাবিকভাবেই তারা হলে উঠতে ছাত্রনেতাদের কাছে যাচ্ছে। তাদের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছে। তবে গেস্টরুম কালচার আমরা একেবারেই অ্যালাউ করি না। অবশ্য সব ক্ষেত্রে যে সফল হই, তা বলা যাবে না।' প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক রেজা আকাশ
© সমকাল ২০০৫ - ২০২২
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com