এক প্রতিষ্ঠানেই জঙ্গি ২৬ শিক্ষক-কর্মকর্তা

লেকহেড গ্রামার স্কুল

০৯ নভেম্বর ১৭ । ০০:০০

সাহাদাত হোসেন পরশ

জঙ্গি সংশ্নিষ্টতার অভিযোগে বারবার আলোচনায় এসেছে ধানমণ্ডি ও বনানীর লেকহেড গ্রামার স্কুল। হিযবুত তাহ্‌রীর, আনসার আল-ইসলাম (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি), আল কায়দা ইন এরাবিয়ান পেনিনসুলা (একিউএপি), নব্য জেএমবি ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আনসার আল বাইয়্যাত আল মাকদিসের মতো জঙ্গি সংগঠনে জড়িত ছিলেন ওই স্কুলের অন্তত ২৬ শিক্ষক-কর্মকর্তা! সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে লেকহেড গ্রামার স্কুলের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের শিকড় ছড়ানোর নানা বিস্ময়কর তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনটি সরকারের সংশ্নিষ্ট দপ্তরে দাখিল করা হয়েছে। গত

মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট আলোচিত-সমালোচিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন।

হলি আর্টিসান হামলার পর নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিসহ দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উগ্রপন্থি কার্যক্রমে জড়িত থাকার তথ্য উঠে এলেও একটি প্রতিষ্ঠানে এতজনের জঙ্গিবাদে জড়ানোর তথ্য সত্যি বিস্ময়কর বলে মনে করছেন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

এ ব্যাপারে পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি মারুফ হোসেন সরদার সমকালকে বলেন, অনেক দিন ধরেই গোয়েন্দা তথ্য ছিল লেকহেড গ্রামার স্কুলের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট অনেকে জঙ্গিবাদে জড়িত। স্কুলটি বন্ধ হওয়ার পরও তারা যাতে নতুনভাবে পরিচয় গোপন করে কোনো উগ্রবাদী তৎপরতা চালাতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসির) এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, দেশে উচ্চ শিক্ষিত ও ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যমে পড়ূয়া শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট করতে বড় ভূমিকা ছিল লেকহেড গ্রামার স্কুলের। বিশেষ করে হলি আর্টিসান হামলায় জড়িত রোহান ইমতিয়াজ এবং নিবরাস এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে ঝুঁকেছে। এ ছাড়া কল্যাণপুরে অভিযানে নিহত আকিবুজ্জামানের উগ্রবাদে জড়ানোর পেছনে লেকহেডের ভূমিকা ছিল। এমনকি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যারা সিরিয়া ও ইরাকে গিয়েছে তাদের কয়েকজনকেও অর্থায়ন করেছে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িতরা।

সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা মঙ্গলবার সমকালকে বলেন, লেকহেড গ্রামার স্কুল নিয়ে তারা বিভিন্ন সময় নিবিড় তদন্ত করেছেন। তদন্তে দেখা যায়, শুরু থেকে স্কুলটির পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের অনেকেই জঙ্গিবাদকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এমনকি ওই স্কুলের প্রশাসনিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েক ব্যক্তি জঙ্গি দলে যোগ দেয়। মিরপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামও লেকহেড গ্রামার স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিল। এ ছাড়া ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যুক্তরাজ্যে গ্রেফতার রাজীব করিমও লেকহেড গ্রামার স্কুলে এক সময় শিক্ষকতা করত। গোয়েন্দাদের দাবি, রাজীব জড়িত ছিল আল কায়দা ইন এরাবিয়ান পেনিনসুলার (একিউএপি) সঙ্গে, যারা আল কায়দার আদর্শে বিশ্বাসী। রাজীব বর্তমানে ব্রিটেনের কারাগারে বন্দি। তার দুই স্বজনের বিরুদ্ধেও জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা হলেন- রাজীবের ভাই তেহজীব করিম ও তার স্ত্রী সিরাত। তারা দু'জনই লেকহেড গ্রামার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ২০১০ সালে ইয়েমেনে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয়েছিলেন তেহজীব। এমনকি তেহজীবের শ্বশুর এ রশিদ চৌধুরী এক সময় লেকহেড গ্রামার স্কুলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।

গোয়েন্দারা জানান, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর লেকহেড গ্রামার স্কুলের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন জেনিফার আহমেদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মাওলার স্ত্রী। তাদের দু'জনের বিরুদ্ধে হিযবুত তাহ্‌রীরের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গোলাম মাওলা বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন। গোলাম মাওলা ও জেনিফারের পর লেকহেড গ্রামার স্কুল পরিচালনায় আসেন হারুন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক হারুন অর রশিদ ও তার ছেলে রেজোয়ান হারুন। তারা 'বাবা-ছেলে' জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ আছে। রেজোয়ান হারুনের সঙ্গে এবিটির শীর্ষ নেতা কারাবন্দি জসিমুদ্দিন রাহমানি, রেজওয়ানুল আজাদ রানার ভালো সম্পর্ক ছিল। রেজোয়ান হারুন বর্তমানে পলাতক। এবিটিকে দীর্ঘদিন ধরে অর্থ সরবরাহ করে আসছেন তিনি।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে লেকহেড গ্রামার স্কুলের আরও যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন হিযবুত তাহ্‌রীরের জাহিদুর রহমান, জুবায়ের কৌশিক, মনিরুজ্জামান মাসুদ, নাঈম ও মৌমিতা। এ ছাড়া লেকহেড গ্রামার স্কুলের আরও দু'জন শিক্ষক হিযবুত তাহ্‌রীরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যাদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।

এ ছাড়া লেকহেড গ্রামার স্কুলের যেসব শিক্ষক একিউএপি ও আনসার আল বাইয়্যাত আল মাকদিসে জড়িত আছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা হলো- তাসনুভা, রিফাত, মইন উদ্দিন, ফারজাদ হক, রেজওয়ান শরিফ, জুবায়দুর রহমান, সাদ্দাম, রাফায়েল, সাদমান ও আলী হাসান মাহমুদ রিপন।





© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com