
বিশেষ লেখা
ইশতেহার কি আমাদের জন্য
১১ ডিসেম্বর ১৮ । ০০:০০
বিনায়ক সেন

আমরা ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে সময়ের গ্রন্থিগুলো পার হচ্ছি। অনেকটা যেন রজ্জুপথে চলা। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই মহাপতনের দিকে। একটা জাতি এত দীর্ঘ সময় ধরে এ রকম চাপের মধ্যে থেকে সুস্থ থাকতে পারে না। তাই সামগ্রিকভাবে এবারের নির্বাচনটা আর দশটা নির্বাচনের মতো গতানুগতিক নির্বাচন নয়। তার দুটি কারণ। একটি কারণ হচ্ছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অচিরেই পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবার যে সরকার নির্বাচিত হবে, সে সরকারই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপন করবে। কেবল উৎসব উদযাপনই নয়, এর সঙ্গে আরও কিছু দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জও তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেমন- পঞ্চাশ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলাম, পঞ্চাশ বছর পরে এসে আমাদের অর্জনটাই বা কী হলো, আর আমরা সামনের পথটাই বা কীভাবে পাড়ি দেব? এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সময় এসে গেছে।
যেভাবে গত দশটি বছর পার করেছি, সামনের দশটি বছর ততটা নির্বিঘ্নে কাটবে না। সেই অর্থে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এবং এতে যে দলগুলো অংশগ্রহণ করছে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সেই তাগিদটা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে এমডিজির পরে এখন এসডিজি এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজিগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তার একটি হচ্ছে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা; আরেকটি হচ্ছে ২০৩০ সালে অর্থনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিটা গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশি হয়। আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই। অঙ্কের হিসাবে বললেও সেটি ১১ বছর। এই ১১ বছরের মধ্যেই আমাদের দারিদ্র্যমুক্ত এবং বৈষম্য হ্রাসকারী দেশের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে হবে। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও কিন্তু আলাদাভাবে কিছু লক্ষ্য গ্রহণ করেছি। যেমন এর একটি হচ্ছে, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবো।
১. আদি প্রতিশ্রুতি ও তার আজকের অর্থ
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ইশতেহারে কী থাকা উচিত, তা নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হতে পারে। আমি যে আলোচনাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই, সেটা হচ্ছে- আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও অস্তিত্বগতভাবে মানুষের মতোই। তারও সত্তার পরিবর্তন হয়। মানুষের সত্তা যেমন একই রূপ থাকে না; শৈশবে-কৈশোরে, যৌবনে বা বার্ধক্যে তার রূপ বদল হয়। তেমনি রাজনৈতিক দলেরও কিন্তু সত্তার বিবর্তন হয়। এর অর্থ হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও তার মূল নীতিমালাগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হয়। এ ক্ষেত্রে মূল নীতিমালার মধ্যে যেটা মৌলিক, যেটা আমাদের সংবিধানে রয়েছে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এ চারটি নীতি ১৯৭২ সালে যে অর্থ নিয়ে এসেছিল, সে অর্থ আজও তারা সমানভাবে বহন করে কি-না এবং বহন করে থাকলে এর নতুনতর অর্থ কী, সেটা খোঁজার জায়গা হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার। নির্বাচনী ইশতেহারে সে সম্পর্কে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং সুচিন্তিত বক্তব্য থাকা উচিত। যেমন ধরা যাক, আগে সমাজতন্ত্র বলতে যেটা বোঝানো হতো এবং অনেকেই বুঝতেন জাতীয়করণকৃত শিল্প-কলকারখানা, উৎপাদনের উপায়ের ওপর সামাজিক মালিকানা এবং এ জাতীয় পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে যেটা এসেছিল। ধারণাটা যখন এসেছে তখনও কিন্তু বিতর্কটা হয়েছিল, এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী? এবং আমাদের গণপরিষদে একটা দীর্ঘ বিতর্কও হয়েছিল এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় সে অর্থটা কেমন, তা নিয়ে। মার্ক্স কখনও চিন্তা করেননি যে, বৈষম্য বাড়লে সমাজতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হবে আর বৈষম্য কমলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। সেভাবে তিনি সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়ন করেননি। তিনি সমাজতন্ত্রকে একটি নতুন মৌলিক সভ্যতার ধাপ হিসেবে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে একদিকে বাজার পুঁজিবাদকে আশ্রয় করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার আমরা সমাজতন্ত্রের কথাও বলছি। তাহলে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদও থাকছে, আবার সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাও থাকছে। দুটো মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের চেহারাটা কী দাঁড়াচ্ছে? এটা কি সুইডেন বা জার্মানির মতো একটা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি! না কানাডার মতো সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি, নাকি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতে চাচ্ছি, যেখানে ট্রাম্পচালিত সরকার আসে এবং প্রধানত নানা ধরনের ব্যক্তি উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে স্বাস্থ্য খাতের নিশ্চয়তা নেই, হাই স্কুলের পরে শিক্ষার খরচ চালানো নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আবার কানাডা, সুইডেন বা জার্মানির মতো দেশে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের অধিক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়। পুঁজিবাদী ধারার হলেও জনগণকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মৌলিক সুবিধাদি কতটা পরিমাণে দেওয়া হবে এবং কত গভীরে দেওয়া হবে- সেটার ওপরে ভিত্তি করে এক দেশ কিন্তু আরেক দেশ থেকে আলাদা। আমরাও এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারি। বাংলাদেশ যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, তার অর্থটা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিজে মনে করি যে, আমাদের দেশে নিজস্ব ধরনের একটা সামাজিক গণতন্ত্র গড়ে ওঠার বস্তুগত অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। আজকের অবস্থাটা থেকে আমরা যদি একটা সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চাই, তাহলে লক্ষ্যটা নির্দিষ্ট করে বলা দরকার; এবং সেটাকে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
ঠিক তেমনিভাবে আসে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন। ইউরোপের দৃষ্টিকোণ থেকে একসময় ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বোঝানো হতো, ধর্ম এবং রাষ্ট্র পরস্পর বিযুক্ত। ধর্ম হচ্ছে প্রাইভেট স্ম্ফিয়ারের আর রাষ্ট্রকার্য হচ্ছে পাবলিক স্ম্ফিয়ারের। সেই বিযুক্তির ধারণা থেকে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞাটা আমরা পেয়েছি বা নানাভাবে এসেছে, তা হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধর্ম পালনের সমান অধিকার। এ ক্ষেত্রে যেমন একটা স্লোগান প্রচলিত আছে- 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার'।
কিন্তু আমার মনে হয়, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আরেকটু চিন্তা করার সুযোগ আছে। দার্শনিক হাবেরমাস যেমন বলেছেন, 'উই হ্যাভ এনটার্ড ইনটু এ পোস্টসেকুলার এজ'। অর্থাৎ আমরা এখন এক ধর্মনিরপেক্ষতা-উত্তর সমাজে বাস করছি। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষ যে শক্তি, তাকে এখন নতুন করে ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে এক ধরনের সংলাপে যেতে হচ্ছে। এই যে সংলাপে নতুন করে যেতে হচ্ছে, ধর্মীয় শক্তিকে সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় স্বীকার করতে হচ্ছে- এটা কিন্তু নতুন উপলব্ধি। সেটা ইউরোপে বসে ২০০৪ সালে তিনি লিখেছিলেন। কথাটা আমাদের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও সত্য এবং বাংলাদেশের জন্যও সত্য। আমরা এখন শুধু অসাম্প্রদায়িকতা এবং শুধু 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার' এই সংজ্ঞাতে আটকে না থেকে একটু বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করতে পারি- কীভাবে ধর্মীয় ও অন্যান্য শক্তিকে আমরা সামাজিক রূপান্তরের কাজে ও উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে পারি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আমরা যে স্বীকৃতি দিয়েছি, সেটাকে কেউ কেউ বলতে পারেন, এই স্বীকৃতিটা এসেছে ওই ধরনের উপলব্ধি থেকে, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠী সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। কিন্তু এই স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে তারা মূলধারার শিক্ষাস্তরের সঙ্গে কতটুকু পরিমাণে সমান, সেটা নিরূপণের দায়িত্বও আমাদের ওপর বর্তায়। এই নিরূপণে যদি দেখা যায়, দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য রয়ে গেছে, ঘাটতি রয়ে গেছে- তাহলে সেই ঘাটতিগুলো পূরণে আরও যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। সেটাকেই মূলত প্রকৃত স্বীকৃতি বলা যেতে পারে।
আরেকটি বিষয় হলো জাতীয়তাবাদ। সমাজতন্ত্রের মতো এ বিষয়টিকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা যারা ভাবেন, তারা এখন নতুন করে বলুক- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তারা এখন কীভাবে দেখছেন? সেটা কি মুসলিম লীগের সেই মুসলিম বেঙ্গলের পুরনো ধারণার মধ্যেই আটকে আছে, নাকি তাকে আরও সম্প্রসারিত করে নতুনভাবে তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দেখছেন; যে জাতীয়তাবাদের অংশ আদিবাসী থেকে শুরু করে সমতল ও পাহাড়ের সবাই; নাকি যেখানেই বাঙালি আছে, তাদের সবাই এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত? এককথায় প্রতিটি দলের দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানের মূল চারটি আদর্শের বা প্রতিশ্রুতির সমসাময়িক অর্থবহতা সম্পর্কে একটা প্রতিফলন দরকার এই নির্বাচনী ইশতেহারগুলোয়।
২. দারিদ্র্য কমছে, বৈষম্য বাড়ছে
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইশতেহারে আমাদের জন্য প্রত্যাশিত কী কী প্রসঙ্গ আসতে পারে? একটা হচ্ছে, যে অর্থনীতিতে গত এক দশকে কিছু কিছু ইতিবাচক প্রবণতা জন্ম নিয়েছে, তার মধ্যে মোটামুটি স্বীকৃত একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এই যে আজকে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬-সাড়ে ৬ শতাংশ করে বাড়ছে; কোনো কোনো বছর ৭ শতাংশও ছাড়িয়ে যাচ্ছে- এটি ভালো দিক। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ার কথা, দারিদ্র্যও ধীরে ধীরে কমে আসার কথা। বাস্তবে দারিদ্র্য কমছেও। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত করতে পারি, মেয়েদের স্কুলগামিতার হার বাড়ছে, শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। এই যে প্রবৃদ্ধি বাড়া, দারিদ্র্য কমে আসা, মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়া- এর কারণে কতগুলো সামাজিক সূচকেও পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমে আসছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের সূচকে, বিশেষ করে প্রিভেনটিভ হেলথ কেয়ারে এবং শিক্ষাসূচকে আমরা অনেকগুলো ধাপ পার হচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গেই আবার জড়িত হয়ে পড়ছে কতগুলো নেতিবাচক দিক; যেগুলোকে ইতিবাচক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাচ্ছে না। অ্যাঙ্গেলসের একটা কথা ছিল যে, বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়তে থাকলে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রভুত্ব করার সামর্থ্য কমে যায়। আমাদের দেশেও বোধকরি এটা ঘটেছে। 'বঙ্গদেশের কৃষক'-এর শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্র যেমন লিখেছিলেন, 'আজিকালি শোনা যায় দেশের খুব শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।' এই শ্রীবৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্যও সত্য। কিন্তু তারপরই বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন যে, 'কিন্তু এই শ্রীবৃদ্ধি কাহার? আমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, আমি তুমি কি দেশ! হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত- তাহাদের কি শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে?' এই প্রশ্নটা তিনি রেখেছিলেন। এই প্রশ্নটাতে আমাদের টুইস্টটা হচ্ছে, হ্যাঁ এই শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও দারিদ্র্য কমছে। তবে সবার কমছে না, এখনও কিছু চরম দরিদ্র পরিবার রয়ে গেছে হাওর অঞ্চলে বা বিভিন্ন উপদ্রুত উপকূলে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কমছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি যেটা হচ্ছে, বৈষম্য বল্কগ্দাহীনভাবে বাড়ছে। সেটা বাড়ছে সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানেই। গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, বৈষম্য ৪৪ শতাংশ থেকে এখন ৪৮ শতাংশে উপনীত হয়েছে। সাধারণত বলা হয় যে, যখন জিনি কোইফিশিয়েন্ট ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়, তখন আমরা অতি উচ্চ বৈষম্যের স্তরে প্রবেশ করি, যাতে শুধু লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ ও চীন প্রবেশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বৈষম্যের হার ৪৫ শতাংশের মতো। ইউরোপিয়ান অনেক দেশে বৈষম্যের হার আরও কম। সুতরাং যদিও আমরা নিল্ফেম্নান্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছি- তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের প্রবৃদ্ধির অর্জনটা অনেকখানি ম্লান হয়ে যাচ্ছে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে। সে জন্যই ইশতেহারে একটা সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা উচিত, প্রবৃদ্ধি বাড়াব, দারিদ্র্য কমাব; কিন্তু বৈষম্যকে বেশিদূর বাড়তে না দিয়েই। অর্থাৎ বৈষম্যের লাগাম ধরে রেখেই আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াব। এটা একটা মৌলিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যদি বৈষম্যকে এভাবে বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে দুটো কুফল দেখা দেবে। প্রথমত, প্রবৃদ্ধি একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক জিনি সূচকের বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে সামাজিক বৈষম্য। একশ্রেণির সঙ্গে আরেক শ্রেণির বৈষম্য। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। আমি সন্দেহ করি, সাম্প্রতিককালে যে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন- আগামীতে হয়তো আমরা এমন আরও তরুণের আন্দোলন দেখতে পাব- যার পেছনে কাজ করেছে বা করবে এই বৈষম্যের উস্কানি। তার কারণ হচ্ছে, আমরা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধির একটা স্পষ্ট প্রবণতা দেখছি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির সুফলগুলো সবার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। কর্মসংস্থানগুলো গুণগত মানের হয়ে, উপযুক্ত হয়ে তার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন একটা সামান্য ধরনের সামাজিক অস্থিরতা বা নড়াচড়াই বড় ধরনের দুর্বিপাকের আশঙ্কা বয়ে নিয়ে আসছে- এটার মূল কারণ হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান যথাযথ মানের হতে পারছে না। এবং সেইসঙ্গে মানুষে মানুষে যে আয়বৈষম্য, সম্পদে বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য, যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈষম্য- এসব মানুষকে আহত করছে। সেটা নানাভাবে, নানা উপায়ে বহিঃপ্রকাশিত হয়ে পড়ছে। আমাদের মতো দেশে এখনও পর্যন্ত যথার্থ অর্থে একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম দাঁড়ায়নি। যেটা উন্নত বিশ্বে তো বটেই, মাঝারি উন্নত দেশেও আছে। যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই একই ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করছেন। মূলত তারা একই র্যাপিড ম্যাস ট্রান্সপোর্টে চড়ে কাজে যাচ্ছেন। এর ফলে একে অপরের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে যাতায়াত করতে করতে একটা অভিন্ন নাগরিক সমাজ গড়ে উঠছে। অথচ আমাদের দেশে প্রতিটি ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা একেকটি নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য বাঁধা। উচ্চবিত্তরা নিজস্ব গাড়িতে চড়ছেন, মধ্যবিত্ত বাস-রিকশায় চড়ছেন, নিম্নবিত্ত হেঁটে যাচ্ছেন।
সুতরাং বৈষম্যের ব্যাপারে যে কোনো সময়ের নির্বাচনের তুলনায় এবার আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাছে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করি। তাদের ইশতেহারে চ্যালেঞ্জগুলোর তালিকায় সর্বশীর্ষে এই বৈষম্য দূর করার কথা রাখা উচিত। শুধু একটি নীতি নিয়ে এই বৈষম্য দূর করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সকলের জন্য 'সুযোগের সমতা' বৃদ্ধি করা- উন্নত বাসস্থান, উন্নত শিক্ষা, উন্নত কর্মসংস্থান, উন্নত ঋণপ্রাপ্তি প্রভৃতি সুযোগ যাতে কেবল ধনীদেরই মধ্যে সীমিত না থাকে। রাষ্ট্রের পুনর্বণ্টনমূলক নীতিমালাকে, যথা- রাজস্ব-ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে ফলপ্রসূ সম্পত্তি-করের প্রবর্তন করতে হবে।
৩. ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ?
বৈষম্যের পরে আমি যে দ্বিতীয় নেতিবাচক প্রবণতার কথাটি বলছি সেটি হচ্ছে, ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদের আশঙ্কা। আমার ধারণা, আমাদের দেশে ক্রমশ একটা ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ ব্যবস্থা গেড়ে বসছে। মূলত পুঁজিবাদের যে স্বাভাবিক শক্তি, নিজেকে নিজে শোধন করার যে প্রক্রিয়া- সেটা নিয়ন্ত্রিত হয় এই ঝুঁকির মাধ্যমে। পুঁজিবাদ সব সময়ই পুঁজিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ঝুঁকির সামনে ঠেলে দিয়ে। আবার বাজারের বাইরের অনেক বিষয়ও পুঁজিবাদের বিকাশে কাজ করে। যেমন আমি চাইলেই আমার পাশের জমিটা দখল করতে পারি না। আমি চাইলেই ব্যাংকের টাকা নিয়ে সেই টাকা ফেরত না দিয়ে দিনের পর দিন চলতে পারি না। চাইলেই মুনাফা থেকে যে কর-রাজস্ব দেওয়ার কথা, তা পরিশোধ না করে বড় ধরনের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারি না। অনেক উন্নত দেশের জন্যই এসব কথা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে পূর্বে তো বটেই, গত এক দশকেও দেখছি এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। অর্থাৎ পুঁজিপতিদের জন্য এই ঝুঁকিগুলো কমে গেছে। বিশেষ করে বাজারের যে ঝুঁকি, সেটা থাকলেও বাজারবহির্ভূত যে ঝুঁকি- অর্থাৎ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য, ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য তাকে যে ঝুঁকিগুলো বহন করতে হবে, সেগুলো কমে গেছে। তার মানে পুঁজিপতিরা এসব নিয়ম না পালন করে উল্টো এসবকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা অর্জন করে চলেছে। এটাকেই আমরা বলছি ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ। এই ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদেই ক্রনি পুঁজিবাদের জন্ম হয়। এবং ক্রনি পুঁজিবাদের কারণেই তারা এটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছে। কারণ তারা ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে। যার সুবাদে প্রচুর ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করেও অনেকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন বিনিয়োগগুলোর ওপর নানাভাবে এসবের প্রভাব পড়ছে। নতুন ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে, নতুন ঋণের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, আইন না মানার একটা সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। আর এই সবকিছুকেই আমি সামগ্রিকভাবে 'ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ' নামে আখ্যায়িত করছি। এই টার্মটি ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে, পুঁজিবাদের ভেতরে থেকেই পুঁজিবাদের যে অবনতি হচ্ছে, এর মাধ্যমে সেটাকে প্রশ্ন করা সম্ভব। এ রকম ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ যদি চলে, তাহলে সেই ঝুঁকিটা আসলে সমাজকেই বহন করতে হয়। পুঁজিপতি শ্রেণি সেই ঝুঁকি বহন করছে না। অথচ কথা ছিল উল্টোটা হওয়ার, যে পুঁজিপতি শ্রেণি ঝুঁকি নেবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে- এর মধ্য দিয়ে সমাজ এগিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে উল্টো। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ গেড়ে বসছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে চাই শক্ত মেরুদণ্ডের নিয়মনিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জোট। এটা শুধু একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সম্ভবপর নয়। আবার এটা না হলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিকাশের পরবর্তী ধাপে যেতে পারব না।
৪. রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব
এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা কোনো বায়বীয় বিষয় নিয়ে হবে না, এটা হবে সেই নির্বাচনী দর্শনের যে পুনঃসংজ্ঞায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছিলাম, সেটাকে কেন্দ্র করে। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা হতে হবে এই যে, নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেটাকে মোকাবেলা করার জন্যই। আমাদের নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। এর জন্য নতুনভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকাটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। আগে আমরা ভাবতাম, পুঁজিবাদী দেশ হওয়ার অর্থই হচ্ছে আমরা পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সুফলগুলো লাভ করব। কিন্তু এখন দেখা গেছে, এখানে পদে পদে রাষ্ট্রের একটা সহায়ক ভূমিকা রয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র যে সে দায়িত্ব পালন করবে, তার জন্য দরকার তার তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসন। সে যাদের ওপর খবরদারি করবে, সে তাদের বন্ধু হতে পারবে না। রাষ্ট্রকে তাই একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা একটা প্রাথমিক ধাপ, যাতে করে তারা সহসাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে না পারেন। এ ছাড়া মেধাবী তরুণদের সরকারি কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। তবে সেটাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য রাষ্ট্রকে প্রকৃত অর্থেই মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নির্মাণ করতে হবে। এবং এ আমলাতন্ত্র হতে হবে উন্নয়ন আমলাতন্ত্র। শুধু সরকারি দপ্তর বা রাষ্ট্রযন্ত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাসপাতাল- সর্বত্রই। সবখানেই আমরা দেখতে চাই সবচেয়ে যোগ্য মেধাবী নেতৃত্ব। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো উপায়েই এসব করতে হবে। আমরা যদি ছোট মাপের স্বপ্নও দেখে থাকি, বড় মাপের কিছু মানুষকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের সম্মানিত করতে হবে। সেটা না করলে আমাদের ছোট মাপের স্বপ্নও দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।
নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা দূরত্ব বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই দায়িত্ব আছে পরস্পরের কাছাকাছি আসার। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণির এই দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে হবে। এখানে কেবল পার্টির যারা বুদ্ধিজীবী তাদেরকেই নয়, ননপার্টিজান বুদ্ধিজীবীদেরও জায়গা করে দিতে হবে রাষ্ট্রকে। যেভাবেই হোক, এই দূরত্ব বেশি দিন থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়। তাই আমাদের এমন একটা সামাজিক অঙ্গীকার দরকার, যেখানে সব পক্ষের প্রাজ্ঞজনের স্থান আছে। সবাই যাতে বুঝতে পারে, আমি যে রাজনৈতিক মতেরই হই না কেন, আমার একটা আলাদা আদরণীয় স্থান আছে রাষ্ট্রসভায়। এটাই ভারতবর্ষীয় রীতি :রাজন্যবর্গ সব সময়েই পণ্ডিতদের সম্মান করে এসেছেন।
৫. বহুবার বলা তবু অসমাপ্ত যে কাজগুলো
সর্বশেষ যে কথাগুলো বলতে চাই, সে কথাগুলো বহু মানুষ বহুবার বলেছেন; কিন্তু কোনো অব্যাখ্যাত কারণে তা বাস্তবায়িত হতে হতে হয়নি। সেখান থেকে তিনটা কাজের কথা আমি বলতে চাই, যা অসমাপ্ত থেকে গেছে। অথচ এর ব্যাপারে করণীয়গুলো সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই একমত। সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ আমাদের জন্য অবশ্যপালনীয় একটা কাজ। কারণ, জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের দেশ হচ্ছে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ। অষ্টম দেশ রাশিয়া! আর বিকেন্দ্রীকরণের জন্য মোট জনসংখ্যার আকারটাই আসলে প্রধান বিবেচ্য। এমনকি আমরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারও হই, তা সত্ত্বেও সীমিত আকারে হলেও এক-তৃতীয়াংশ বাজেট নিচের দিকের সরকারগুলোকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি। এখন সেটা পুরনো ১৯ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, নাকি ৬৪ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, সেই যৌক্তিক বিভাজনটাও করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, এই বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে প্যারাডক্সটি হচ্ছে, যে সরকারকে আমরা স্থানীয় সরকারে নির্বাচন করছি, তাকে আমরা ক্ষমতায়ন করছি না। যেমন উপজেলা সরকার- নির্বাচন করেছি, ক্ষমতায়ন করিনি। অন্যদিকে যেটি নির্বাচিত এবং ক্ষমতায়িত, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ সরকার- তার ক্ষমতা অতিসংকুচিত। সে সামান্যই অর্জন করতে পারে, কারণ তার হাতে বাজেটের পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু এটা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে বইও লিখেছেন, অনেক সভা-সেমিনারও হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব একটা এগোয়নি। ভারত তাদের সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীতে পরিস্কার করে বলে দিয়েছে যে, সেখানে তিন স্তরের সরকার হবে। আর সেই তিন স্তরের সবচেয়ে নিচের স্তর হলো গ্রাম পঞ্চায়েত। দু-একটা রাজ্য বাদ দিলে এখন সেখানে সর্বত্রই এই তিন স্তরের সরকার চলছে। এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নিয়মিতভাবেই অর্থনৈতিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। স্থানীয় স্বশাসনের এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজস্ব আহরণের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
এর পরের যে চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে, আমাদের গুণগত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। আমাদের দেশের ধনী-গরিবে বৈষম্য শুধু অর্থে নয়, সম্পদে নয়, শিক্ষার গুণেও। কেউ ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, কেউ বাংলা মাধ্যমে পড়ছে, কেউ আবার একেবারে নিম্নমানের স্কুলে পড়ছে। কেউ আবার এ দুই ধারার বাইরে মাদ্রাসায় পড়ছে। কেউ আবার একটা পাঁচমিশালির মধ্যে আছে। দেশের আগামীর সন্তানদের এ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা থাকা উচিত নির্বাচনী ইশতেহারে। যে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে কেমন দেশ চাই? আমরা কি সার্ভিস সেক্টর নেশন হবো নাকি আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং নেশন হবো? এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার যে চিন্তা- তার একটা প্রতিফলন ইশতেহারে থাকবে না, তা তো হয় না। তা ছাড়া যেখানে প্রচলিত শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ, সেখানে অপ্রথাগত বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রভূত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে, চীনের অভিজ্ঞতাও হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। আর শুধু বর্তমানে আটকে না থেকে, ২০৩০ সালে আমাদের কী ধরনের দক্ষতা লাগবে, সেই দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা এখন থেকেই তো করতে হবে।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সবকিছুর মূলে থাকে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে যেমন একজন ব্যক্তিমানুষের জীবনে বিঘ্ন ঘটে, তেমনি জাতীয় জীবনেও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় সব সময়ই যে কোনো আলোচনায় অবকাঠামো, আইন, উন্নয়ন এসব নানা বিষয়ের আড়ালে পড়ে যায় স্বাস্থ্যসেবা। তাই স্বাস্থ্য খাত নিয়েও অবশ্যই ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকা চাই। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু সময়ের দাবি অনুযায়ী যেন সে অগ্রগতি খুবই নগণ্য। গরিব-মধ্যবিত্ত নাগরিকের সুচিকিৎসা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে পরিকল্পনার উপস্থিতি ইশতেহারে থাকা উচিত।
সবশেষে বলতে চাই, গত পাঁচ বছরের ম্যাক্রো পরিসংখ্যানেও আমরা দেখছি, প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়া সত্ত্বেও এবং দারিদ্র্য কমার পরও কিছু কিছু সূচকে একটা নিম্নগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন ধরুন, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহকে আমরা যদি জিডিপির অনুপাতে প্রকাশ করি, তাহলে দেখা যাবে এটা কমে গেছে। যদি আমরা রফতানি প্রবৃদ্ধি হার দেখি, সেটাও কমে গেছে। এই অবনতিশীল প্রবণতাকে ফেরাতে হবে। একই সঙ্গে বরাবরই আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছিলাম, বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ২০১০-এর দশকে খুব একটা বাড়েনি। সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগের ঘাটতি কিছুটা মেটানো গেলেও তার আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ দিকগুলোর প্রতি নতুন সরকারের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রসঙ্গ থাকলে বলা যাবে যে ইশতেহার আমাদের জন্য। তবে সবকিছুই কালের এবং শ্রেণিস্বার্থের অধীন।
যেভাবে গত দশটি বছর পার করেছি, সামনের দশটি বছর ততটা নির্বিঘ্নে কাটবে না। সেই অর্থে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এবং এতে যে দলগুলো অংশগ্রহণ করছে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সেই তাগিদটা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে এমডিজির পরে এখন এসডিজি এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজিগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তার একটি হচ্ছে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা; আরেকটি হচ্ছে ২০৩০ সালে অর্থনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিটা গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশি হয়। আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই। অঙ্কের হিসাবে বললেও সেটি ১১ বছর। এই ১১ বছরের মধ্যেই আমাদের দারিদ্র্যমুক্ত এবং বৈষম্য হ্রাসকারী দেশের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে হবে। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও কিন্তু আলাদাভাবে কিছু লক্ষ্য গ্রহণ করেছি। যেমন এর একটি হচ্ছে, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবো।
১. আদি প্রতিশ্রুতি ও তার আজকের অর্থ
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ইশতেহারে কী থাকা উচিত, তা নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হতে পারে। আমি যে আলোচনাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই, সেটা হচ্ছে- আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও অস্তিত্বগতভাবে মানুষের মতোই। তারও সত্তার পরিবর্তন হয়। মানুষের সত্তা যেমন একই রূপ থাকে না; শৈশবে-কৈশোরে, যৌবনে বা বার্ধক্যে তার রূপ বদল হয়। তেমনি রাজনৈতিক দলেরও কিন্তু সত্তার বিবর্তন হয়। এর অর্থ হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও তার মূল নীতিমালাগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হয়। এ ক্ষেত্রে মূল নীতিমালার মধ্যে যেটা মৌলিক, যেটা আমাদের সংবিধানে রয়েছে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এ চারটি নীতি ১৯৭২ সালে যে অর্থ নিয়ে এসেছিল, সে অর্থ আজও তারা সমানভাবে বহন করে কি-না এবং বহন করে থাকলে এর নতুনতর অর্থ কী, সেটা খোঁজার জায়গা হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার। নির্বাচনী ইশতেহারে সে সম্পর্কে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং সুচিন্তিত বক্তব্য থাকা উচিত। যেমন ধরা যাক, আগে সমাজতন্ত্র বলতে যেটা বোঝানো হতো এবং অনেকেই বুঝতেন জাতীয়করণকৃত শিল্প-কলকারখানা, উৎপাদনের উপায়ের ওপর সামাজিক মালিকানা এবং এ জাতীয় পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে যেটা এসেছিল। ধারণাটা যখন এসেছে তখনও কিন্তু বিতর্কটা হয়েছিল, এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী? এবং আমাদের গণপরিষদে একটা দীর্ঘ বিতর্কও হয়েছিল এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় সে অর্থটা কেমন, তা নিয়ে। মার্ক্স কখনও চিন্তা করেননি যে, বৈষম্য বাড়লে সমাজতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হবে আর বৈষম্য কমলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। সেভাবে তিনি সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়ন করেননি। তিনি সমাজতন্ত্রকে একটি নতুন মৌলিক সভ্যতার ধাপ হিসেবে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে একদিকে বাজার পুঁজিবাদকে আশ্রয় করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার আমরা সমাজতন্ত্রের কথাও বলছি। তাহলে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদও থাকছে, আবার সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাও থাকছে। দুটো মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের চেহারাটা কী দাঁড়াচ্ছে? এটা কি সুইডেন বা জার্মানির মতো একটা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি! না কানাডার মতো সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি, নাকি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতে চাচ্ছি, যেখানে ট্রাম্পচালিত সরকার আসে এবং প্রধানত নানা ধরনের ব্যক্তি উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে স্বাস্থ্য খাতের নিশ্চয়তা নেই, হাই স্কুলের পরে শিক্ষার খরচ চালানো নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আবার কানাডা, সুইডেন বা জার্মানির মতো দেশে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের অধিক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়। পুঁজিবাদী ধারার হলেও জনগণকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মৌলিক সুবিধাদি কতটা পরিমাণে দেওয়া হবে এবং কত গভীরে দেওয়া হবে- সেটার ওপরে ভিত্তি করে এক দেশ কিন্তু আরেক দেশ থেকে আলাদা। আমরাও এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারি। বাংলাদেশ যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, তার অর্থটা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিজে মনে করি যে, আমাদের দেশে নিজস্ব ধরনের একটা সামাজিক গণতন্ত্র গড়ে ওঠার বস্তুগত অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। আজকের অবস্থাটা থেকে আমরা যদি একটা সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চাই, তাহলে লক্ষ্যটা নির্দিষ্ট করে বলা দরকার; এবং সেটাকে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
ঠিক তেমনিভাবে আসে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন। ইউরোপের দৃষ্টিকোণ থেকে একসময় ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বোঝানো হতো, ধর্ম এবং রাষ্ট্র পরস্পর বিযুক্ত। ধর্ম হচ্ছে প্রাইভেট স্ম্ফিয়ারের আর রাষ্ট্রকার্য হচ্ছে পাবলিক স্ম্ফিয়ারের। সেই বিযুক্তির ধারণা থেকে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞাটা আমরা পেয়েছি বা নানাভাবে এসেছে, তা হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধর্ম পালনের সমান অধিকার। এ ক্ষেত্রে যেমন একটা স্লোগান প্রচলিত আছে- 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার'।
কিন্তু আমার মনে হয়, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আরেকটু চিন্তা করার সুযোগ আছে। দার্শনিক হাবেরমাস যেমন বলেছেন, 'উই হ্যাভ এনটার্ড ইনটু এ পোস্টসেকুলার এজ'। অর্থাৎ আমরা এখন এক ধর্মনিরপেক্ষতা-উত্তর সমাজে বাস করছি। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষ যে শক্তি, তাকে এখন নতুন করে ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে এক ধরনের সংলাপে যেতে হচ্ছে। এই যে সংলাপে নতুন করে যেতে হচ্ছে, ধর্মীয় শক্তিকে সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় স্বীকার করতে হচ্ছে- এটা কিন্তু নতুন উপলব্ধি। সেটা ইউরোপে বসে ২০০৪ সালে তিনি লিখেছিলেন। কথাটা আমাদের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও সত্য এবং বাংলাদেশের জন্যও সত্য। আমরা এখন শুধু অসাম্প্রদায়িকতা এবং শুধু 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার' এই সংজ্ঞাতে আটকে না থেকে একটু বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করতে পারি- কীভাবে ধর্মীয় ও অন্যান্য শক্তিকে আমরা সামাজিক রূপান্তরের কাজে ও উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে পারি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আমরা যে স্বীকৃতি দিয়েছি, সেটাকে কেউ কেউ বলতে পারেন, এই স্বীকৃতিটা এসেছে ওই ধরনের উপলব্ধি থেকে, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠী সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। কিন্তু এই স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে তারা মূলধারার শিক্ষাস্তরের সঙ্গে কতটুকু পরিমাণে সমান, সেটা নিরূপণের দায়িত্বও আমাদের ওপর বর্তায়। এই নিরূপণে যদি দেখা যায়, দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য রয়ে গেছে, ঘাটতি রয়ে গেছে- তাহলে সেই ঘাটতিগুলো পূরণে আরও যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। সেটাকেই মূলত প্রকৃত স্বীকৃতি বলা যেতে পারে।
আরেকটি বিষয় হলো জাতীয়তাবাদ। সমাজতন্ত্রের মতো এ বিষয়টিকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা যারা ভাবেন, তারা এখন নতুন করে বলুক- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তারা এখন কীভাবে দেখছেন? সেটা কি মুসলিম লীগের সেই মুসলিম বেঙ্গলের পুরনো ধারণার মধ্যেই আটকে আছে, নাকি তাকে আরও সম্প্রসারিত করে নতুনভাবে তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দেখছেন; যে জাতীয়তাবাদের অংশ আদিবাসী থেকে শুরু করে সমতল ও পাহাড়ের সবাই; নাকি যেখানেই বাঙালি আছে, তাদের সবাই এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত? এককথায় প্রতিটি দলের দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানের মূল চারটি আদর্শের বা প্রতিশ্রুতির সমসাময়িক অর্থবহতা সম্পর্কে একটা প্রতিফলন দরকার এই নির্বাচনী ইশতেহারগুলোয়।
২. দারিদ্র্য কমছে, বৈষম্য বাড়ছে
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইশতেহারে আমাদের জন্য প্রত্যাশিত কী কী প্রসঙ্গ আসতে পারে? একটা হচ্ছে, যে অর্থনীতিতে গত এক দশকে কিছু কিছু ইতিবাচক প্রবণতা জন্ম নিয়েছে, তার মধ্যে মোটামুটি স্বীকৃত একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এই যে আজকে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬-সাড়ে ৬ শতাংশ করে বাড়ছে; কোনো কোনো বছর ৭ শতাংশও ছাড়িয়ে যাচ্ছে- এটি ভালো দিক। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ার কথা, দারিদ্র্যও ধীরে ধীরে কমে আসার কথা। বাস্তবে দারিদ্র্য কমছেও। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত করতে পারি, মেয়েদের স্কুলগামিতার হার বাড়ছে, শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। এই যে প্রবৃদ্ধি বাড়া, দারিদ্র্য কমে আসা, মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়া- এর কারণে কতগুলো সামাজিক সূচকেও পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমে আসছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের সূচকে, বিশেষ করে প্রিভেনটিভ হেলথ কেয়ারে এবং শিক্ষাসূচকে আমরা অনেকগুলো ধাপ পার হচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গেই আবার জড়িত হয়ে পড়ছে কতগুলো নেতিবাচক দিক; যেগুলোকে ইতিবাচক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাচ্ছে না। অ্যাঙ্গেলসের একটা কথা ছিল যে, বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়তে থাকলে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রভুত্ব করার সামর্থ্য কমে যায়। আমাদের দেশেও বোধকরি এটা ঘটেছে। 'বঙ্গদেশের কৃষক'-এর শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্র যেমন লিখেছিলেন, 'আজিকালি শোনা যায় দেশের খুব শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।' এই শ্রীবৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্যও সত্য। কিন্তু তারপরই বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন যে, 'কিন্তু এই শ্রীবৃদ্ধি কাহার? আমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, আমি তুমি কি দেশ! হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত- তাহাদের কি শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে?' এই প্রশ্নটা তিনি রেখেছিলেন। এই প্রশ্নটাতে আমাদের টুইস্টটা হচ্ছে, হ্যাঁ এই শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও দারিদ্র্য কমছে। তবে সবার কমছে না, এখনও কিছু চরম দরিদ্র পরিবার রয়ে গেছে হাওর অঞ্চলে বা বিভিন্ন উপদ্রুত উপকূলে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কমছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি যেটা হচ্ছে, বৈষম্য বল্কগ্দাহীনভাবে বাড়ছে। সেটা বাড়ছে সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানেই। গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, বৈষম্য ৪৪ শতাংশ থেকে এখন ৪৮ শতাংশে উপনীত হয়েছে। সাধারণত বলা হয় যে, যখন জিনি কোইফিশিয়েন্ট ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়, তখন আমরা অতি উচ্চ বৈষম্যের স্তরে প্রবেশ করি, যাতে শুধু লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ ও চীন প্রবেশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বৈষম্যের হার ৪৫ শতাংশের মতো। ইউরোপিয়ান অনেক দেশে বৈষম্যের হার আরও কম। সুতরাং যদিও আমরা নিল্ফেম্নান্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছি- তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের প্রবৃদ্ধির অর্জনটা অনেকখানি ম্লান হয়ে যাচ্ছে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে। সে জন্যই ইশতেহারে একটা সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা উচিত, প্রবৃদ্ধি বাড়াব, দারিদ্র্য কমাব; কিন্তু বৈষম্যকে বেশিদূর বাড়তে না দিয়েই। অর্থাৎ বৈষম্যের লাগাম ধরে রেখেই আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াব। এটা একটা মৌলিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যদি বৈষম্যকে এভাবে বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে দুটো কুফল দেখা দেবে। প্রথমত, প্রবৃদ্ধি একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক জিনি সূচকের বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে সামাজিক বৈষম্য। একশ্রেণির সঙ্গে আরেক শ্রেণির বৈষম্য। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। আমি সন্দেহ করি, সাম্প্রতিককালে যে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন- আগামীতে হয়তো আমরা এমন আরও তরুণের আন্দোলন দেখতে পাব- যার পেছনে কাজ করেছে বা করবে এই বৈষম্যের উস্কানি। তার কারণ হচ্ছে, আমরা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধির একটা স্পষ্ট প্রবণতা দেখছি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির সুফলগুলো সবার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। কর্মসংস্থানগুলো গুণগত মানের হয়ে, উপযুক্ত হয়ে তার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন একটা সামান্য ধরনের সামাজিক অস্থিরতা বা নড়াচড়াই বড় ধরনের দুর্বিপাকের আশঙ্কা বয়ে নিয়ে আসছে- এটার মূল কারণ হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান যথাযথ মানের হতে পারছে না। এবং সেইসঙ্গে মানুষে মানুষে যে আয়বৈষম্য, সম্পদে বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য, যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈষম্য- এসব মানুষকে আহত করছে। সেটা নানাভাবে, নানা উপায়ে বহিঃপ্রকাশিত হয়ে পড়ছে। আমাদের মতো দেশে এখনও পর্যন্ত যথার্থ অর্থে একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম দাঁড়ায়নি। যেটা উন্নত বিশ্বে তো বটেই, মাঝারি উন্নত দেশেও আছে। যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই একই ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করছেন। মূলত তারা একই র্যাপিড ম্যাস ট্রান্সপোর্টে চড়ে কাজে যাচ্ছেন। এর ফলে একে অপরের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে যাতায়াত করতে করতে একটা অভিন্ন নাগরিক সমাজ গড়ে উঠছে। অথচ আমাদের দেশে প্রতিটি ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা একেকটি নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য বাঁধা। উচ্চবিত্তরা নিজস্ব গাড়িতে চড়ছেন, মধ্যবিত্ত বাস-রিকশায় চড়ছেন, নিম্নবিত্ত হেঁটে যাচ্ছেন।
সুতরাং বৈষম্যের ব্যাপারে যে কোনো সময়ের নির্বাচনের তুলনায় এবার আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাছে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করি। তাদের ইশতেহারে চ্যালেঞ্জগুলোর তালিকায় সর্বশীর্ষে এই বৈষম্য দূর করার কথা রাখা উচিত। শুধু একটি নীতি নিয়ে এই বৈষম্য দূর করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সকলের জন্য 'সুযোগের সমতা' বৃদ্ধি করা- উন্নত বাসস্থান, উন্নত শিক্ষা, উন্নত কর্মসংস্থান, উন্নত ঋণপ্রাপ্তি প্রভৃতি সুযোগ যাতে কেবল ধনীদেরই মধ্যে সীমিত না থাকে। রাষ্ট্রের পুনর্বণ্টনমূলক নীতিমালাকে, যথা- রাজস্ব-ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে ফলপ্রসূ সম্পত্তি-করের প্রবর্তন করতে হবে।
৩. ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ?
বৈষম্যের পরে আমি যে দ্বিতীয় নেতিবাচক প্রবণতার কথাটি বলছি সেটি হচ্ছে, ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদের আশঙ্কা। আমার ধারণা, আমাদের দেশে ক্রমশ একটা ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ ব্যবস্থা গেড়ে বসছে। মূলত পুঁজিবাদের যে স্বাভাবিক শক্তি, নিজেকে নিজে শোধন করার যে প্রক্রিয়া- সেটা নিয়ন্ত্রিত হয় এই ঝুঁকির মাধ্যমে। পুঁজিবাদ সব সময়ই পুঁজিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ঝুঁকির সামনে ঠেলে দিয়ে। আবার বাজারের বাইরের অনেক বিষয়ও পুঁজিবাদের বিকাশে কাজ করে। যেমন আমি চাইলেই আমার পাশের জমিটা দখল করতে পারি না। আমি চাইলেই ব্যাংকের টাকা নিয়ে সেই টাকা ফেরত না দিয়ে দিনের পর দিন চলতে পারি না। চাইলেই মুনাফা থেকে যে কর-রাজস্ব দেওয়ার কথা, তা পরিশোধ না করে বড় ধরনের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারি না। অনেক উন্নত দেশের জন্যই এসব কথা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে পূর্বে তো বটেই, গত এক দশকেও দেখছি এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। অর্থাৎ পুঁজিপতিদের জন্য এই ঝুঁকিগুলো কমে গেছে। বিশেষ করে বাজারের যে ঝুঁকি, সেটা থাকলেও বাজারবহির্ভূত যে ঝুঁকি- অর্থাৎ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য, ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য তাকে যে ঝুঁকিগুলো বহন করতে হবে, সেগুলো কমে গেছে। তার মানে পুঁজিপতিরা এসব নিয়ম না পালন করে উল্টো এসবকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা অর্জন করে চলেছে। এটাকেই আমরা বলছি ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ। এই ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদেই ক্রনি পুঁজিবাদের জন্ম হয়। এবং ক্রনি পুঁজিবাদের কারণেই তারা এটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছে। কারণ তারা ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে। যার সুবাদে প্রচুর ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করেও অনেকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন বিনিয়োগগুলোর ওপর নানাভাবে এসবের প্রভাব পড়ছে। নতুন ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে, নতুন ঋণের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, আইন না মানার একটা সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। আর এই সবকিছুকেই আমি সামগ্রিকভাবে 'ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ' নামে আখ্যায়িত করছি। এই টার্মটি ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে, পুঁজিবাদের ভেতরে থেকেই পুঁজিবাদের যে অবনতি হচ্ছে, এর মাধ্যমে সেটাকে প্রশ্ন করা সম্ভব। এ রকম ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ যদি চলে, তাহলে সেই ঝুঁকিটা আসলে সমাজকেই বহন করতে হয়। পুঁজিপতি শ্রেণি সেই ঝুঁকি বহন করছে না। অথচ কথা ছিল উল্টোটা হওয়ার, যে পুঁজিপতি শ্রেণি ঝুঁকি নেবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে- এর মধ্য দিয়ে সমাজ এগিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে উল্টো। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ গেড়ে বসছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে চাই শক্ত মেরুদণ্ডের নিয়মনিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জোট। এটা শুধু একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সম্ভবপর নয়। আবার এটা না হলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিকাশের পরবর্তী ধাপে যেতে পারব না।
৪. রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব
এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা কোনো বায়বীয় বিষয় নিয়ে হবে না, এটা হবে সেই নির্বাচনী দর্শনের যে পুনঃসংজ্ঞায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছিলাম, সেটাকে কেন্দ্র করে। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা হতে হবে এই যে, নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেটাকে মোকাবেলা করার জন্যই। আমাদের নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। এর জন্য নতুনভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকাটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। আগে আমরা ভাবতাম, পুঁজিবাদী দেশ হওয়ার অর্থই হচ্ছে আমরা পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সুফলগুলো লাভ করব। কিন্তু এখন দেখা গেছে, এখানে পদে পদে রাষ্ট্রের একটা সহায়ক ভূমিকা রয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র যে সে দায়িত্ব পালন করবে, তার জন্য দরকার তার তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসন। সে যাদের ওপর খবরদারি করবে, সে তাদের বন্ধু হতে পারবে না। রাষ্ট্রকে তাই একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা একটা প্রাথমিক ধাপ, যাতে করে তারা সহসাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে না পারেন। এ ছাড়া মেধাবী তরুণদের সরকারি কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। তবে সেটাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য রাষ্ট্রকে প্রকৃত অর্থেই মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নির্মাণ করতে হবে। এবং এ আমলাতন্ত্র হতে হবে উন্নয়ন আমলাতন্ত্র। শুধু সরকারি দপ্তর বা রাষ্ট্রযন্ত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাসপাতাল- সর্বত্রই। সবখানেই আমরা দেখতে চাই সবচেয়ে যোগ্য মেধাবী নেতৃত্ব। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো উপায়েই এসব করতে হবে। আমরা যদি ছোট মাপের স্বপ্নও দেখে থাকি, বড় মাপের কিছু মানুষকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের সম্মানিত করতে হবে। সেটা না করলে আমাদের ছোট মাপের স্বপ্নও দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।
নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা দূরত্ব বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই দায়িত্ব আছে পরস্পরের কাছাকাছি আসার। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণির এই দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে হবে। এখানে কেবল পার্টির যারা বুদ্ধিজীবী তাদেরকেই নয়, ননপার্টিজান বুদ্ধিজীবীদেরও জায়গা করে দিতে হবে রাষ্ট্রকে। যেভাবেই হোক, এই দূরত্ব বেশি দিন থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়। তাই আমাদের এমন একটা সামাজিক অঙ্গীকার দরকার, যেখানে সব পক্ষের প্রাজ্ঞজনের স্থান আছে। সবাই যাতে বুঝতে পারে, আমি যে রাজনৈতিক মতেরই হই না কেন, আমার একটা আলাদা আদরণীয় স্থান আছে রাষ্ট্রসভায়। এটাই ভারতবর্ষীয় রীতি :রাজন্যবর্গ সব সময়েই পণ্ডিতদের সম্মান করে এসেছেন।
৫. বহুবার বলা তবু অসমাপ্ত যে কাজগুলো
সর্বশেষ যে কথাগুলো বলতে চাই, সে কথাগুলো বহু মানুষ বহুবার বলেছেন; কিন্তু কোনো অব্যাখ্যাত কারণে তা বাস্তবায়িত হতে হতে হয়নি। সেখান থেকে তিনটা কাজের কথা আমি বলতে চাই, যা অসমাপ্ত থেকে গেছে। অথচ এর ব্যাপারে করণীয়গুলো সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই একমত। সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ আমাদের জন্য অবশ্যপালনীয় একটা কাজ। কারণ, জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের দেশ হচ্ছে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ। অষ্টম দেশ রাশিয়া! আর বিকেন্দ্রীকরণের জন্য মোট জনসংখ্যার আকারটাই আসলে প্রধান বিবেচ্য। এমনকি আমরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারও হই, তা সত্ত্বেও সীমিত আকারে হলেও এক-তৃতীয়াংশ বাজেট নিচের দিকের সরকারগুলোকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি। এখন সেটা পুরনো ১৯ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, নাকি ৬৪ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, সেই যৌক্তিক বিভাজনটাও করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, এই বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে প্যারাডক্সটি হচ্ছে, যে সরকারকে আমরা স্থানীয় সরকারে নির্বাচন করছি, তাকে আমরা ক্ষমতায়ন করছি না। যেমন উপজেলা সরকার- নির্বাচন করেছি, ক্ষমতায়ন করিনি। অন্যদিকে যেটি নির্বাচিত এবং ক্ষমতায়িত, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ সরকার- তার ক্ষমতা অতিসংকুচিত। সে সামান্যই অর্জন করতে পারে, কারণ তার হাতে বাজেটের পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু এটা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে বইও লিখেছেন, অনেক সভা-সেমিনারও হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব একটা এগোয়নি। ভারত তাদের সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীতে পরিস্কার করে বলে দিয়েছে যে, সেখানে তিন স্তরের সরকার হবে। আর সেই তিন স্তরের সবচেয়ে নিচের স্তর হলো গ্রাম পঞ্চায়েত। দু-একটা রাজ্য বাদ দিলে এখন সেখানে সর্বত্রই এই তিন স্তরের সরকার চলছে। এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নিয়মিতভাবেই অর্থনৈতিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। স্থানীয় স্বশাসনের এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজস্ব আহরণের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
এর পরের যে চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে, আমাদের গুণগত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। আমাদের দেশের ধনী-গরিবে বৈষম্য শুধু অর্থে নয়, সম্পদে নয়, শিক্ষার গুণেও। কেউ ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, কেউ বাংলা মাধ্যমে পড়ছে, কেউ আবার একেবারে নিম্নমানের স্কুলে পড়ছে। কেউ আবার এ দুই ধারার বাইরে মাদ্রাসায় পড়ছে। কেউ আবার একটা পাঁচমিশালির মধ্যে আছে। দেশের আগামীর সন্তানদের এ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা থাকা উচিত নির্বাচনী ইশতেহারে। যে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে কেমন দেশ চাই? আমরা কি সার্ভিস সেক্টর নেশন হবো নাকি আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং নেশন হবো? এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার যে চিন্তা- তার একটা প্রতিফলন ইশতেহারে থাকবে না, তা তো হয় না। তা ছাড়া যেখানে প্রচলিত শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ, সেখানে অপ্রথাগত বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রভূত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে, চীনের অভিজ্ঞতাও হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। আর শুধু বর্তমানে আটকে না থেকে, ২০৩০ সালে আমাদের কী ধরনের দক্ষতা লাগবে, সেই দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা এখন থেকেই তো করতে হবে।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সবকিছুর মূলে থাকে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে যেমন একজন ব্যক্তিমানুষের জীবনে বিঘ্ন ঘটে, তেমনি জাতীয় জীবনেও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় সব সময়ই যে কোনো আলোচনায় অবকাঠামো, আইন, উন্নয়ন এসব নানা বিষয়ের আড়ালে পড়ে যায় স্বাস্থ্যসেবা। তাই স্বাস্থ্য খাত নিয়েও অবশ্যই ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকা চাই। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু সময়ের দাবি অনুযায়ী যেন সে অগ্রগতি খুবই নগণ্য। গরিব-মধ্যবিত্ত নাগরিকের সুচিকিৎসা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে পরিকল্পনার উপস্থিতি ইশতেহারে থাকা উচিত।
সবশেষে বলতে চাই, গত পাঁচ বছরের ম্যাক্রো পরিসংখ্যানেও আমরা দেখছি, প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়া সত্ত্বেও এবং দারিদ্র্য কমার পরও কিছু কিছু সূচকে একটা নিম্নগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন ধরুন, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহকে আমরা যদি জিডিপির অনুপাতে প্রকাশ করি, তাহলে দেখা যাবে এটা কমে গেছে। যদি আমরা রফতানি প্রবৃদ্ধি হার দেখি, সেটাও কমে গেছে। এই অবনতিশীল প্রবণতাকে ফেরাতে হবে। একই সঙ্গে বরাবরই আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছিলাম, বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ২০১০-এর দশকে খুব একটা বাড়েনি। সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগের ঘাটতি কিছুটা মেটানো গেলেও তার আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ দিকগুলোর প্রতি নতুন সরকারের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রসঙ্গ থাকলে বলা যাবে যে ইশতেহার আমাদের জন্য। তবে সবকিছুই কালের এবং শ্রেণিস্বার্থের অধীন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com