
তুমুল গাঢ় সমাচার
সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ
ধারাবাহিক
১৪ জুন ১৯ । ০০:০০
বিনায়ক সেন

পর্ব ::১৭
পূর্ব প্রকাশের পর
এত বেড়ে যাওয়ায় গঙ্গাচরণ যাও-বা কিছু কিনতে পারলো, নবীন পাড়ূই কিছুই কিনতে পেল না। মাছ ধরে তার যা উপার্জন তাতে করে তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে খাদ্যশস্যের মূল্য। কীভাবে অমর্ত্য সেন কথিত 'এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্টের' দ্রুত অবনতি হচ্ছিল, তার বিবরণ মেলে তাদের কথায়]
'গঙ্গাচরণ বললে- নবীন, চাল নেবে না?
- না বাবাঠাকুর। একটা সিকি কম পড়ে গেল।
- তবে তো মুশকিল। আমার কাছেও নেই যে তোমাকে দেবো।
- আধসের পুঁটিমাছ ধরেলাম সামটার বিলে। পেয়েলাম ছ'আনা। আর কাল মাছ বেচবার দরুন ছেল দশ আনা। কুড়িয়ে-বুড়িয়ে একটা টাকা এনেলাম চাল কিনতি। তা আবার চালের দাম চড়ে গেল কী করে জানব?
- তাই তো!
আধপেটা খেয়ে আছি দু'দিন। চাষিদের ঘরে ভাত আছে। আমাদের তা নেই। আমাদের কষ্ট সকলের অপেক্ষা বেশি। জলের প্রাণী, তার ওপর তো জোর নেই? ধরা না দিলে কী করছি! যেদিন পালাম সেদিন চাল আনলাম। যেদিন পালাম না সেদিন উপোস। আগে ধান-চাল ধার দিত। আজকাল কেউ কিছু দেয় না।'
৩. [চাল-সংগ্রহ অভিযানের কারণে অনেক বড় বড় দোকানেও কেনার জন্য চাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না]
'কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার। বড় বড় তিন-চারটি দোকান খুঁজে বেড়ালে, সকলেরই এক বুলি- চাল নেই। গঙ্গাচরণের মনে পড়লো বৃদ্ধ কুণ্ডু মশায়ের কথা। ...কিন্তু সেখানেও তথৈবচ। গঙ্গাচরণ দোকানঘরটিতে ঢুকবার সময় চেয়ে দেখলে বাঁ পাশের যে বাঁশের মাচায় চালের বস্তা ছাদ পর্যন্ত সাজানো থাকে। সে জায়গা একদম খালি। হাওয়া খেলচে।...
গঙ্গাচরণ বললে- কিছু চাল দিতে হবে।
- কোথায় পাব, নেই।
- এক টাকার চাল, বেশি নয়। এই লোকটাকে উপোস করে থাকতে হবে। দিতেই হবে আপনাকে।
কুণ্ডু মশায় সুর নিচু করে বললে- সন্ধ্যের পর আমার বাড়িতে যেতে বলবেন, খাবার চাল থেকে এক টাকার চাল দিয়ে দেবো এখন।
গঙ্গাচরণ বললে- ধান-চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?
- কী করব বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুট হওয়ার পর কী করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন! সবারই সে দশা। তার ওপর শনচি পুলিশে নিয়ে যাবে চাল কম দামে মিলিটারির জন্য।...
- আমরা না খেয়ে মরব?
- যদিন থাকবে, দেবো। ...
- ...বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক, নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে! কী খেয়ে বাঁচবে মানুষ?
- বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কনটাকটারদের কাছে। এক দানা ধান রাখেনি। এই রকম অনেকেই করেচে খবর নিয়ে দেখুন।'
৪. [মতি মুচিনী মারা যাচ্ছে। গঙ্গাচরণকে গোঙাতে গোঙাতে বলল, 'বড্ড জ্বর দাদাঠাকুর, তিন দিন খাইনি, দুটো ভাত খাব।' তার পরের বিবরণী বিভূতিভূষণের লেখাতেই শুনুন]
'অনঙ্গ-বৌ শুনতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো, কিন্তু সেও অত্যন্ত দুর্বল। উঠে মতির কাছে যাওয়ার শক্তি তারও নেই!
বললে- ওগো মতিকে কিছু খেতে দিয়ে এসো-
- কী দেবো?
- দুটো কলাইয়ের ডাল আছে ভিজনো। এক মুঠো দিয়ে এসো।
- ও খেয়ে কি মরবে? তার জ্বর আজ কত দিন তা কে জানে? মুখ-হাত ফুলে ঢোল হয়েচে। কেন ও খাইয়ে নিমিত্তের ভাগি হবো!
খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো অনঙ্গ। কিন্তু অন্য কিছুই ঘরে নেই। কী খেতে দেওয়া যায়, এক টুকরো কচু ঘরে আছে বটে, কিন্তু তা রোগীর খাদ্য নয়। ... ভেবেচিন্তে অনঙ্গ-বৌ বললে- হ্যাঁ গা, কচু বেটে জল দিয়ে সিদ্ধ করে দিলে রোগী খেতে পারে না?
- তা বোধ হয় পারে। মানকচু?
[ব্রাহ্মণ পণ্ডিত স্কুলের শিক্ষক গঙ্গাচরণের উনোনেরই যদি এই দশা হয় আরও নিম্ন-আয়ের সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হচ্ছিল, তা এর থেকে অনুমেয়।]
৫. [অবশেষে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর ঘটনা সত্য বলে প্রমাণ হলো। বিভূতিভূষণ তার অননুকরণীয় বর্ণনার সেই আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা লিখছেন। সে বর্ণনা চার্চিল-কেইনস্ বা ঔপনিবেশিক ভারতের ভাইসরয়রা কেউ পড়েননি, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের 'অশনিসংকেত' ছবির কল্যাণে পরে মতি মুচিনীর মৃত্যুসমগ্র পশ্চিমা জগতে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল]
'গ্রামে থাকা খুব মুশকিল হয়ে পড়লো মতি মুচিনীর মৃত্যু হওয়ার পরে। অনাহারে মৃত্যু এই প্রথম। এর আগে কেউ জানত না বা বিশ্বাসও করেনি যে অনাহারে আবার মানুষ মরতে পারে। এত ফল থাকতে গাছে গাছে, নদীর জলে এত মাছ থাকতে, বিশেষ করে এত লোক যেখানে বাস করে গ্রামে ও পাশের গ্রামে, তখন মানুষ কখনও না খেয়ে মরে? কেউ না কেউ খেতে দেবেই। না খেয়ে সত্যিই কেউ মরবে না।
কিন্তু মতি মুচিনীর ব্যাপারে সকলেই বুঝলে, না খেয়ে মানুষে তাহলে তো মরতে পারে। এত দিন যা গল্পে-কাহিনীতে শোনা যেত, আজ তা সম্ভবের গণ্ডির মধ্যে এসে পৌঁছে গেল। কই, এই যে একটা লোক মারা গেল না খেয়ে, কেউ তো তাকে খেতে দিলে না? কেউ তো তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারলে না? সকলের মনে বিষম একটা আশঙ্কার সৃষ্টি হলো। সবাই তো তাহলে না খেয়ে মরতে পারে!'
'অশনিসংকেত' ছাড়াও সে সময়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন তার 'মন্বন্তর' উপন্যাস (দুর্ভিক্ষের ওপরে লেখা বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকটি তখনই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল)। ১৯৪২ সালের শীত-মৌসুমের খাদ্যশস্য বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেল দক্ষিণ বঙ্গের জেলাগুলোতে। 'মন্বন্তরে' তারাশঙ্কর লিখেছেন :'লোক কয়েকটি মেদিনীপুরের অধিবাসী। ঘরবাড়ি ভেঙে মাটির ঢিবি হয়ে গেছে, গরু-বাছুর ভেসে গেছে, জলোচ্ছ্বাসে জমির বুকে চাপিয়ে দিয়েছে বালির রাশি। অন্ন নেই- এমনকি তৃষ্ণা মিটিয়ে জলপান করবারও উপায় নেই- জল লবণাক্ত হয়ে গেছে।' এই বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় দুর্ভিক্ষের প্রাগ-পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। মন্বন্তরে বিজয়দা নীলাকে লিখছে :'এখন মাঘ মাস, এরই মধ্যে দেখছি- ধান প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। গত বছরের ডিনায়েল পলিসি, এ বছরের অজন্মা, এর ওপর চোরা বাজারের কালো কাপড় ঢাকা হাত দান টেনে নিচ্ছে।' মন্বন্তর উপন্যাসটি সমসাময়িকতায় বিদ্ধ হলেও আদর্শ প্রচারের কারণে ততটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারাশঙ্কর একদিকে মহাত্মার অনুসারী, অন্যদিকে বামপন্থি চিন্তাধারার প্রভাবও স্বীকার করে নিচ্ছেন। এ দুইয়ের মিলিত উচ্ছ্বাস মাঝেমধ্যেই তার পাত্র-পাত্রীদের কথার মধ্যে উপচে পড়ে। একটি উদাহরণ দিই, শহর কলকাতায় তখন দুর্ভিক্ষপীড়িত জনস্রোত ঢুকে পড়েছে। বাকিটা তারাশঙ্করের বর্ণনায় শুনুন :
'নীচে পথর উপর থেকে ক্ষীণ কাতর কণ্ঠে ডাক উঠল- ভাত দাও মা চারটি, বাসি ভাত! নীলা এবং কানাইয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। এ মন্বন্তর শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাসাটা তাদের কাছে অপরাধ বলে মনে হলো।
বিজয়দা লেখা সমাপ্ত করে বললো- কানাই ভাই, এইবার কাজে নেমে পড়ো, নীলা ভাই, কমরেডের সঙ্গে তুমিও লেগে পড়ো। ...
নীলা এবার বললে- বলুন, কী করব? কাজ বলে দিন।
- কাজ অনেক। মানুষকে, এ মন্বন্তরের দুর্যোগ পার করে নিয়ে যেতে হবে।'
পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আরও কথাসাহিত্য লেখা হয়েছে বাংলায়। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য গোপাল হালদারের ট্রিলজি- 'পঞ্চাশের পথ', 'ঊনপঞ্চাশি' ও '১৩৫০'। লঙ্গরখানা খোলার কথা আছে অনেক গল্পে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'নয়নচারা' গ্রন্থের 'মৃত্যুযাত্রা' গল্পে গ্রাম ছেড়ে নিরন্ন মানুষের অশক্ত পথচলার বিবরণ পাই। দুর্ভিক্ষের সময়ে ওয়ালীউল্লাহ কলকাতায় অবস্থান করছিলেন এবং বামধারার ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। 'মৃত্যুযাত্রা' গল্পে তিনি লিখছেন :'তিনু কিছু বললে না। হঠাৎ কী হয়েছে তার- নদীর অপর তীর দেখবার জন্য তার মনটা আকুল হয়ে উঠেছে। তার আশঙ্কা হচ্ছে- মহাসাগরের তীরে যেন বসে রয়েছে। পথ ভুল করে কি তারা সীমাহীন মহাসাগরের তীরে এসে বসেছে মরণের পারে যাবে বলে?... ক'দিন হলো মতি উধাও হয়ে গেছে গাঁ থেকে এবং তার খোঁজে সে এদের সঙ্গ নিয়েছে। তা ছাড়া গাঁয়ে যে রকম বীভৎস আকাল লেগেছে, সেখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত।' দুর্ভিক্ষের কারণে জমি সামান্য টিপসই দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল নিরন্ন কৃষক, এ কথা শহীদুল্লাহ কায়সারের 'সংশপ্তক' আমাদের জানিয়েছে। আবু ইসহাকের 'সূর্যদীঘল বাড়ি' উপন্যাসে জয়গুণ ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের স্মৃতিচারণ করছে এভাবে :'পঞ্চাশ সনের কথা মনে হয়। একটা রোজাও রাখা হয়নি। রোজা রাখার কথা মনেও হয়নি। এক বাটি ফেনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে কত জায়গায়-কত বাড়িতে তাকে ঘুরতে হয়েচে... মাঝেমধ্যে সারারাত সারাদিন কেটেছে, একটা দানাও পড়েনি পেটে।'
হুমায়ূন আহমেদ তার 'মধ্যাহ্ন' উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরকে প্রোথিত করেছেন। তাতে করে দেখা যায়, শুধু পশ্চিমবঙ্গে এবং কলকাতায় নয়, এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। চাল কিনে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের সুরক্ষিত করার জন্য 'প্রকিউরমেন্ট পলিসি' দুর্ভিক্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ফিরে যাই হুমায়ূনের বর্ণনায় :
১. [আর, পি, সাহার কথা মনে রেখেই কি নিচের এই স্তবকটি লিখেছিলেন হুমায়ূন? স্মর্তব্য, রণদা প্রসাদ পরে 'দানবীর'রূপে সমধিক পরিচিতি পেলেও তার 'প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়ন' হয়েছিল যুদ্ধের বাজারে- দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে- ধান-চালের মজুদদারি করেই]
'বান্ধবপুর বাজারে এককড়ি সাহার চালের আড়ত। তিনি সামান্য পুঁজি দিয়ে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধের কারণে এখন রমরমা অবস্থা। ধান-চালের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আরও বাড়বে- এ রকম গুজব বাতাসে ভাসছে। সব চাল নাকি মিলিটারিরা কিনে নিবে।... দেশের চাল সব সরকার কিনছে। এদিকে আবার বার্মা মুলুক থেকে চাল আসা বন্ধ। জাপানিরা বার্মা দিয়ে ভাতবর্ষে ঢুকবে।'
২. [এটা গেল দুর্ভিক্ষের 'ব্যাকগ্রাউন্ডের' কথা। এবার হুমায়ূন দেখাবেন কী করে মজুদদারি শুরু হয়ে গেল সরকারি ক্রয়-অভিযানের আড়ালে]
'এককড়ি হারিকেন নিভিয়ে দিয়েছেন। কেরোসিনের সাশ্রয় করতে হবে।... আধো অন্ধকারে এককড়ি দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। গলা নামিয়ে বললেন, চাল কিনা শুরু করো। দাম কিছু বেশি হলেও কিনবা। বড় নৌকা নিয়ে ভাটি অঞ্চলের দিকে যাও। সেখানে ধান-চাল দুইই সস্তা।'
[ক্রমশ]
পূর্ব প্রকাশের পর
এত বেড়ে যাওয়ায় গঙ্গাচরণ যাও-বা কিছু কিনতে পারলো, নবীন পাড়ূই কিছুই কিনতে পেল না। মাছ ধরে তার যা উপার্জন তাতে করে তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে খাদ্যশস্যের মূল্য। কীভাবে অমর্ত্য সেন কথিত 'এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্টের' দ্রুত অবনতি হচ্ছিল, তার বিবরণ মেলে তাদের কথায়]
'গঙ্গাচরণ বললে- নবীন, চাল নেবে না?
- না বাবাঠাকুর। একটা সিকি কম পড়ে গেল।
- তবে তো মুশকিল। আমার কাছেও নেই যে তোমাকে দেবো।
- আধসের পুঁটিমাছ ধরেলাম সামটার বিলে। পেয়েলাম ছ'আনা। আর কাল মাছ বেচবার দরুন ছেল দশ আনা। কুড়িয়ে-বুড়িয়ে একটা টাকা এনেলাম চাল কিনতি। তা আবার চালের দাম চড়ে গেল কী করে জানব?
- তাই তো!
আধপেটা খেয়ে আছি দু'দিন। চাষিদের ঘরে ভাত আছে। আমাদের তা নেই। আমাদের কষ্ট সকলের অপেক্ষা বেশি। জলের প্রাণী, তার ওপর তো জোর নেই? ধরা না দিলে কী করছি! যেদিন পালাম সেদিন চাল আনলাম। যেদিন পালাম না সেদিন উপোস। আগে ধান-চাল ধার দিত। আজকাল কেউ কিছু দেয় না।'
৩. [চাল-সংগ্রহ অভিযানের কারণে অনেক বড় বড় দোকানেও কেনার জন্য চাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না]
'কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার। বড় বড় তিন-চারটি দোকান খুঁজে বেড়ালে, সকলেরই এক বুলি- চাল নেই। গঙ্গাচরণের মনে পড়লো বৃদ্ধ কুণ্ডু মশায়ের কথা। ...কিন্তু সেখানেও তথৈবচ। গঙ্গাচরণ দোকানঘরটিতে ঢুকবার সময় চেয়ে দেখলে বাঁ পাশের যে বাঁশের মাচায় চালের বস্তা ছাদ পর্যন্ত সাজানো থাকে। সে জায়গা একদম খালি। হাওয়া খেলচে।...
গঙ্গাচরণ বললে- কিছু চাল দিতে হবে।
- কোথায় পাব, নেই।
- এক টাকার চাল, বেশি নয়। এই লোকটাকে উপোস করে থাকতে হবে। দিতেই হবে আপনাকে।
কুণ্ডু মশায় সুর নিচু করে বললে- সন্ধ্যের পর আমার বাড়িতে যেতে বলবেন, খাবার চাল থেকে এক টাকার চাল দিয়ে দেবো এখন।
গঙ্গাচরণ বললে- ধান-চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?
- কী করব বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুট হওয়ার পর কী করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন! সবারই সে দশা। তার ওপর শনচি পুলিশে নিয়ে যাবে চাল কম দামে মিলিটারির জন্য।...
- আমরা না খেয়ে মরব?
- যদিন থাকবে, দেবো। ...
- ...বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক, নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে! কী খেয়ে বাঁচবে মানুষ?
- বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কনটাকটারদের কাছে। এক দানা ধান রাখেনি। এই রকম অনেকেই করেচে খবর নিয়ে দেখুন।'
৪. [মতি মুচিনী মারা যাচ্ছে। গঙ্গাচরণকে গোঙাতে গোঙাতে বলল, 'বড্ড জ্বর দাদাঠাকুর, তিন দিন খাইনি, দুটো ভাত খাব।' তার পরের বিবরণী বিভূতিভূষণের লেখাতেই শুনুন]
'অনঙ্গ-বৌ শুনতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো, কিন্তু সেও অত্যন্ত দুর্বল। উঠে মতির কাছে যাওয়ার শক্তি তারও নেই!
বললে- ওগো মতিকে কিছু খেতে দিয়ে এসো-
- কী দেবো?
- দুটো কলাইয়ের ডাল আছে ভিজনো। এক মুঠো দিয়ে এসো।
- ও খেয়ে কি মরবে? তার জ্বর আজ কত দিন তা কে জানে? মুখ-হাত ফুলে ঢোল হয়েচে। কেন ও খাইয়ে নিমিত্তের ভাগি হবো!
খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো অনঙ্গ। কিন্তু অন্য কিছুই ঘরে নেই। কী খেতে দেওয়া যায়, এক টুকরো কচু ঘরে আছে বটে, কিন্তু তা রোগীর খাদ্য নয়। ... ভেবেচিন্তে অনঙ্গ-বৌ বললে- হ্যাঁ গা, কচু বেটে জল দিয়ে সিদ্ধ করে দিলে রোগী খেতে পারে না?
- তা বোধ হয় পারে। মানকচু?
[ব্রাহ্মণ পণ্ডিত স্কুলের শিক্ষক গঙ্গাচরণের উনোনেরই যদি এই দশা হয় আরও নিম্ন-আয়ের সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হচ্ছিল, তা এর থেকে অনুমেয়।]
৫. [অবশেষে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর ঘটনা সত্য বলে প্রমাণ হলো। বিভূতিভূষণ তার অননুকরণীয় বর্ণনার সেই আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা লিখছেন। সে বর্ণনা চার্চিল-কেইনস্ বা ঔপনিবেশিক ভারতের ভাইসরয়রা কেউ পড়েননি, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের 'অশনিসংকেত' ছবির কল্যাণে পরে মতি মুচিনীর মৃত্যুসমগ্র পশ্চিমা জগতে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল]
'গ্রামে থাকা খুব মুশকিল হয়ে পড়লো মতি মুচিনীর মৃত্যু হওয়ার পরে। অনাহারে মৃত্যু এই প্রথম। এর আগে কেউ জানত না বা বিশ্বাসও করেনি যে অনাহারে আবার মানুষ মরতে পারে। এত ফল থাকতে গাছে গাছে, নদীর জলে এত মাছ থাকতে, বিশেষ করে এত লোক যেখানে বাস করে গ্রামে ও পাশের গ্রামে, তখন মানুষ কখনও না খেয়ে মরে? কেউ না কেউ খেতে দেবেই। না খেয়ে সত্যিই কেউ মরবে না।
কিন্তু মতি মুচিনীর ব্যাপারে সকলেই বুঝলে, না খেয়ে মানুষে তাহলে তো মরতে পারে। এত দিন যা গল্পে-কাহিনীতে শোনা যেত, আজ তা সম্ভবের গণ্ডির মধ্যে এসে পৌঁছে গেল। কই, এই যে একটা লোক মারা গেল না খেয়ে, কেউ তো তাকে খেতে দিলে না? কেউ তো তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারলে না? সকলের মনে বিষম একটা আশঙ্কার সৃষ্টি হলো। সবাই তো তাহলে না খেয়ে মরতে পারে!'
'অশনিসংকেত' ছাড়াও সে সময়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন তার 'মন্বন্তর' উপন্যাস (দুর্ভিক্ষের ওপরে লেখা বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকটি তখনই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল)। ১৯৪২ সালের শীত-মৌসুমের খাদ্যশস্য বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেল দক্ষিণ বঙ্গের জেলাগুলোতে। 'মন্বন্তরে' তারাশঙ্কর লিখেছেন :'লোক কয়েকটি মেদিনীপুরের অধিবাসী। ঘরবাড়ি ভেঙে মাটির ঢিবি হয়ে গেছে, গরু-বাছুর ভেসে গেছে, জলোচ্ছ্বাসে জমির বুকে চাপিয়ে দিয়েছে বালির রাশি। অন্ন নেই- এমনকি তৃষ্ণা মিটিয়ে জলপান করবারও উপায় নেই- জল লবণাক্ত হয়ে গেছে।' এই বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় দুর্ভিক্ষের প্রাগ-পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। মন্বন্তরে বিজয়দা নীলাকে লিখছে :'এখন মাঘ মাস, এরই মধ্যে দেখছি- ধান প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। গত বছরের ডিনায়েল পলিসি, এ বছরের অজন্মা, এর ওপর চোরা বাজারের কালো কাপড় ঢাকা হাত দান টেনে নিচ্ছে।' মন্বন্তর উপন্যাসটি সমসাময়িকতায় বিদ্ধ হলেও আদর্শ প্রচারের কারণে ততটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারাশঙ্কর একদিকে মহাত্মার অনুসারী, অন্যদিকে বামপন্থি চিন্তাধারার প্রভাবও স্বীকার করে নিচ্ছেন। এ দুইয়ের মিলিত উচ্ছ্বাস মাঝেমধ্যেই তার পাত্র-পাত্রীদের কথার মধ্যে উপচে পড়ে। একটি উদাহরণ দিই, শহর কলকাতায় তখন দুর্ভিক্ষপীড়িত জনস্রোত ঢুকে পড়েছে। বাকিটা তারাশঙ্করের বর্ণনায় শুনুন :
'নীচে পথর উপর থেকে ক্ষীণ কাতর কণ্ঠে ডাক উঠল- ভাত দাও মা চারটি, বাসি ভাত! নীলা এবং কানাইয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। এ মন্বন্তর শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাসাটা তাদের কাছে অপরাধ বলে মনে হলো।
বিজয়দা লেখা সমাপ্ত করে বললো- কানাই ভাই, এইবার কাজে নেমে পড়ো, নীলা ভাই, কমরেডের সঙ্গে তুমিও লেগে পড়ো। ...
নীলা এবার বললে- বলুন, কী করব? কাজ বলে দিন।
- কাজ অনেক। মানুষকে, এ মন্বন্তরের দুর্যোগ পার করে নিয়ে যেতে হবে।'
পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আরও কথাসাহিত্য লেখা হয়েছে বাংলায়। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য গোপাল হালদারের ট্রিলজি- 'পঞ্চাশের পথ', 'ঊনপঞ্চাশি' ও '১৩৫০'। লঙ্গরখানা খোলার কথা আছে অনেক গল্পে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'নয়নচারা' গ্রন্থের 'মৃত্যুযাত্রা' গল্পে গ্রাম ছেড়ে নিরন্ন মানুষের অশক্ত পথচলার বিবরণ পাই। দুর্ভিক্ষের সময়ে ওয়ালীউল্লাহ কলকাতায় অবস্থান করছিলেন এবং বামধারার ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। 'মৃত্যুযাত্রা' গল্পে তিনি লিখছেন :'তিনু কিছু বললে না। হঠাৎ কী হয়েছে তার- নদীর অপর তীর দেখবার জন্য তার মনটা আকুল হয়ে উঠেছে। তার আশঙ্কা হচ্ছে- মহাসাগরের তীরে যেন বসে রয়েছে। পথ ভুল করে কি তারা সীমাহীন মহাসাগরের তীরে এসে বসেছে মরণের পারে যাবে বলে?... ক'দিন হলো মতি উধাও হয়ে গেছে গাঁ থেকে এবং তার খোঁজে সে এদের সঙ্গ নিয়েছে। তা ছাড়া গাঁয়ে যে রকম বীভৎস আকাল লেগেছে, সেখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত।' দুর্ভিক্ষের কারণে জমি সামান্য টিপসই দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল নিরন্ন কৃষক, এ কথা শহীদুল্লাহ কায়সারের 'সংশপ্তক' আমাদের জানিয়েছে। আবু ইসহাকের 'সূর্যদীঘল বাড়ি' উপন্যাসে জয়গুণ ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের স্মৃতিচারণ করছে এভাবে :'পঞ্চাশ সনের কথা মনে হয়। একটা রোজাও রাখা হয়নি। রোজা রাখার কথা মনেও হয়নি। এক বাটি ফেনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে কত জায়গায়-কত বাড়িতে তাকে ঘুরতে হয়েচে... মাঝেমধ্যে সারারাত সারাদিন কেটেছে, একটা দানাও পড়েনি পেটে।'
হুমায়ূন আহমেদ তার 'মধ্যাহ্ন' উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরকে প্রোথিত করেছেন। তাতে করে দেখা যায়, শুধু পশ্চিমবঙ্গে এবং কলকাতায় নয়, এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। চাল কিনে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের সুরক্ষিত করার জন্য 'প্রকিউরমেন্ট পলিসি' দুর্ভিক্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ফিরে যাই হুমায়ূনের বর্ণনায় :
১. [আর, পি, সাহার কথা মনে রেখেই কি নিচের এই স্তবকটি লিখেছিলেন হুমায়ূন? স্মর্তব্য, রণদা প্রসাদ পরে 'দানবীর'রূপে সমধিক পরিচিতি পেলেও তার 'প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়ন' হয়েছিল যুদ্ধের বাজারে- দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে- ধান-চালের মজুদদারি করেই]
'বান্ধবপুর বাজারে এককড়ি সাহার চালের আড়ত। তিনি সামান্য পুঁজি দিয়ে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধের কারণে এখন রমরমা অবস্থা। ধান-চালের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আরও বাড়বে- এ রকম গুজব বাতাসে ভাসছে। সব চাল নাকি মিলিটারিরা কিনে নিবে।... দেশের চাল সব সরকার কিনছে। এদিকে আবার বার্মা মুলুক থেকে চাল আসা বন্ধ। জাপানিরা বার্মা দিয়ে ভাতবর্ষে ঢুকবে।'
২. [এটা গেল দুর্ভিক্ষের 'ব্যাকগ্রাউন্ডের' কথা। এবার হুমায়ূন দেখাবেন কী করে মজুদদারি শুরু হয়ে গেল সরকারি ক্রয়-অভিযানের আড়ালে]
'এককড়ি হারিকেন নিভিয়ে দিয়েছেন। কেরোসিনের সাশ্রয় করতে হবে।... আধো অন্ধকারে এককড়ি দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। গলা নামিয়ে বললেন, চাল কিনা শুরু করো। দাম কিছু বেশি হলেও কিনবা। বড় নৌকা নিয়ে ভাটি অঞ্চলের দিকে যাও। সেখানে ধান-চাল দুইই সস্তা।'
[ক্রমশ]
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com