বিডিআর বিদ্রোহের রায় ও ভবিষ্যতের শিক্ষা

নিরাপত্তা

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০ । ০১:৪১ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের জেরে হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়
প্রকাশ হয়েছে গত ৮ জানুয়ারি। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু
জাফর সিদ্দিকী ও মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার এ রায়টি
স্বাক্ষর করেন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা
করেছিলেন। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর
সদর দপ্তরে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তারই রায়। যে ঘটনায় ৫৭ সেনা
কর্মকর্তাসহ প্রাণ হারান মোট ৭৪ জন।


এ রায় যেমন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পূর্ণাঙ্গ রায়, এ ঘটনাও ইতিহাসেরই অংশ। কারণ
অনেক যুদ্ধেও এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। আদালত
পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এত অল্প সময়ে একসঙ্গে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা
পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ৫৫ সেনা
কর্মকর্তা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হয়। আফ্রিকার রুয়ান্ডা ও
কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে ১৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহতের নজির পাওয়া যায়। দক্ষিণ
ফিলিপাইনের বিদ্রোহে ৬ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়। ১৯৬৭ সালে পৃথিবীর
ইতিহাসে সর্বাধিক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানে
চীনাপন্থি কমিউনিস্টদের সমর্থনে ৭ দিনের বিদ্রোহে ১০০ সেনা কর্মকর্তা নিহত
হন। পিলখানার ঘটনা তাকেও হার মানিয়েছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ৫৭ জন সেনা
কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনা নৃশংস, অবর্ণনীয়,
বর্বরোচিত ও নজিরবিহীন। রায়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
অত্যন্ত যুগান্তকারী পদক্ষেপ তারা নিয়েছেন। তারা পরিশ্রম করে এত বড় রায়
লিখেছেন। এটি একটি মাইলফলক এবং ভবিষ্যতের জন্য নির্দেশিকা হয়ে থাকবে।


তখন নবগঠিত সরকার ক্ষমতায়। তাদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জও ছিল। আমাদের যে
কোনো বাহিনী হোক না কেন, সেটা সেনাবাহিনী বা বিজিবি প্রত্যেককেই গঠন করা
হয়েছে দেশকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য। সেভাবেই পরিকল্পনা,
প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ঘরের ভেতরেই যখন তা
ঘটে, সব থেকে কাছের লোক যখন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তখন তা মোকাবিলা করা আরও
কঠিন। বিশেষ করে পিলখানা শহরের একটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। আমি তখন
খুবই কাছে ছিলাম। আমাদের ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের অফিস তখন
ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কে ছিল। আমাদের অফিসের অনেক গ্লাস ভেঙে যায়। কে কাকে
মারছে, সেটাও বাইরে থেকে বোঝার উপায় ছিল না।


আদালত রায়ে ১১টি পর্যবেক্ষণ ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রথমেই যদি
আমরা দেখি গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি। সবচেয়ে চৌকস ও বিশ্বস্তদের বিডিআরে
গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা। সেটা হয়তো হয়নি। ফলে তারা খবরগুলো
প্রকাশ করেনি, উল্টো তাতে জয়েন করেছে। সেখানে এনএসআই, ডিজিএফআই সবই ছিল;
কিন্তু আদালতের ভাষায় তারা ছিল অন্তঃসারশূন্য। বলা হয়- (ঘটনার আগের দিন)
'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় বাংলাদেশ
রাইফেলসের কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেছেন, অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা
বাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীদের বাহ্যিক তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও ভেতরে
অন্তঃসারশূন্যতা পরিলক্ষিত হয়।' পিলখানায় লিফলেট বিতরণের কথা এসেছে। একটি
ইউনিফর্মড বাহিনীর মাঝে যদি এ ধরনের লিফলেট বিতরণ হয়, সেটা শৃঙ্খলার
মারাত্মক লঙ্ঘন। সেটা দেখার পর সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে যাওয়া উচিত ছিল।
সেখানে যারা ইনচার্জ ছিলেন তারা হয়তো ভেবেছিলেন, এটি সাময়িক এবং বাইরে না
জানিয়েই এটি সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু তা পারেননি। যখন হামলার ঘটনা ঘটছে,
তখন প্রয়োজন ছিল অস্ত্রাগার আগেই নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। সেখানে সেদিন একজন
অফিসার দায়িত্বে ছিলেন। যখন বিদ্রোহ হলো, তখন তাকে সেখান থেকে সরিয়ে অস্ত্র
নিয়ে নেয়। সেটাও রায়ে এসেছে।


বিডিআরের মধ্যে নানা কারণে অসন্তোষ ছিল। তখনকার কমান্ডারদের উচিত ছিল
বিষয়গুলো দেখা। জওয়ানদের আশ্বস্ত করা যে, আমরা তোমাদের বিষয়গুলো দেখছি। তা
হয়নি বলেই অফিসারদের


বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়তে বাড়তে এ ঘটনা ঘটেছে।


আদালতের রায়ে ঔপনিবেশিক মানসিকতার কথাও এসেছে। আসলে আমাদের সামরিক আইনগুলো
এসেছে প্রথমে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাক্ট থেকে। তারা নিয়েছে ইন্ডিয়ান আর্মি
অ্যাক্ট থেকে। কিন্তু যখন ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যাক্ট হয়, সেটি ব্রিটিশ আর্মির
মতো ছিল না। একটা নেটিভ বাহিনীর জন্য ব্রিটিশরা করেছিল। ব্রিটিশ আর্মি
অ্যাক্ট বা আমেরিকান আর্মি অ্যাক্টের পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু আমাদের তেমন
পরিবর্তন হয়নি। শৃঙ্খলা রক্ষা ও পরস্পরের সম্পর্ক কেমন হবে, তাতে ওই
ঔপনিবেশিক ধারণাই রয়ে গেছে। এই রায়েও তা স্পষ্ট করা হয়েছে।


আরেকটা বিষয় এসেছে- ডালভাত কর্মসূচি। বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর
জেনারেল শাকিল আহমেদ অত্যন্ত ভালো অফিসার ছিলেন। স্টাফ কলেজে আমি তার
ইনস্ট্রাক্টর ছিলাম। এনডিসিতে থিসিস সুপারভাইজার ছিলাম। তিনি থিসিসের জন্য
বেস্ট অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন। তাকে একদিন আমি বলেছিলাম- দেখো, জরুরি
অবস্থায় বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী বিভিন্ন দায়িত্বে যেতে পারে। যেখানে পানির
অভাব, খাদ্যের অভাব সেগুলো মিটিয়ে চলে আসবে। কিন্তু রাজধানীর ভেতর
ইউনিফর্ম পরে দিনের পর দিন আলু, পেঁয়াজ, ডাল বেচবে, গম আমদানি করবে- এটা
কেমন? আলোচ্য রায়েও এসেছে যে, সামরিক বাহিনীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে
বের করে এনে তাদের সামরিক কাজে মনোযোগী হতে হবে।


একটা বিষয় অনেকে সমালোচনা করে যে, তৎক্ষণাৎ কেন অ্যাকশনে যাওয়া হয়নি? বুঝতে
হবে, সেনাবিহিনী, বিমানবাহিনী এরা ফায়ার ব্রিগেড নয়। ওই দিন সকালে
সারাদেশে একটা সাধারণ পরিবেশ বিরাজ করছিল। হয়তো কেউ ক্লাস করছে, কেউ
খেলাধুলা করছে। কেউ অন্যান্য কাজ করছে। তার মধ্যে যখন সকাল ১০টায় হঠাৎ
বিডিআররা বিদ্রোহ করে বসছে, এ অবস্থায় কিন্তু দ্রুত অ্যাকশন নেওয়ার সুযোগ
নেই। থাকত, যদি অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা চলত। সেটাও সময়সাপেক্ষ।
আরেকটা হলো, আপনি যাবেন কোথায়? ভেতরে পরিবার, চারদিকে বেসামরিক মানুষ।
আরেকটা ভয় ছিল, ৭ নভেম্বরের মতো ঘটনায় মোড় নেওয়ার। ষড়যন্ত্রকারীরাও আরেকটি ৭
নভেম্বর চেয়েছিল। সেটা হলে আরও ব্যাপক বিপর্যয় হতে পারত।


রায়ে বিজিবিকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। আমার মত হলো, আমরা আইএসএসবি
পরীক্ষার মাধ্যমে যেমন সামরিক বাহিনীর অফিসার নিয়োগ করে থাকি; ঠিক একইভাবে
বিজিবিরও অফিসার নিয়োগ করা যেতে পারে। তাদের মিলিটারি একাডেমিতে পাঠাতে
পারি। এরপর বিজিবিতেই তারা কমিশনড অফিসার পদ পেতে পারে। এতে বিজিবির
অফিসারের সঙ্গে সিপাহির যে দূরত্ব, সেটা কিন্তু আর থাকবে না। ভারতীয়
সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফও সম্পূর্ণ আলাদা বাহিনী। আমরা ১৯৭১ সালে
দেখেছি, বিএসএফও সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্র হয়ে যুদ্ধ করেছে।


আগেই বলেছি, আমাদের ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের অফিস ছিল পিলখানার
কাছে। আমি তখন ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার। ওই ঘটনায় আমাদের দু'জন
শিক্ষার্থী অ্যাফেক্টেড হয়। একজনের বাবা যিনি হাই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যারা
এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন, তিনি অন্যতম। বিদ্রোহীরা তাকে
মেরে ফেলে। ওই শিক্ষার্থী টিউশন ফি মওকুফের আবেদন করে। তাকে আমরা মওকুফ করে
দিই। আরেকজনের বাবা এ ঘটনায় জেলে যায়। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকেও
আমরা মওকুফ করি। কারণ তার পড়ালেখা এতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ওই দিনের ঘটনায়
৭৪ জন মারা যায়, এখন আদালত ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। ফলে ঘটনাটি
উভয়পক্ষের পরিবারের জন্যই একটা ট্রমার মতো।


এই যে বিচারটা হলো, এটা কিন্তু উদাহরণ। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে
ও সেনাবাহিনীর কোনো কোনো ইউনিটে বিদ্রোহ হয়েছিল। সেখানে মার্শাল কোর্ট করা
হয়। আমরা জানিও না কতজনের ফাঁসি হয়। সত্যিকার অর্থে ওটা কোনো বিচার হয়নি।
যেটা হয়েছে সেটা প্রতিশোধ। এখন এ ঘটনা আমাদের সবার জন্য একটি শিক্ষা। এর
মাধ্যমে হয়তো ভবিষ্যতে অমরা এমন ট্রা্যজেডি এড়াতে পারব।


নিরাপত্তা বিশ্নেষক; অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর; ট্রেজারার, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com