
মানসিকতার পরিবর্তন হোক
অন্যদৃষ্টি
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০ । ০৩:২৪ | প্রিন্ট সংস্করণ
মুহম্মদ মোফাজ্জল
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হরিজন সম্প্রদায়ের শিশু বিরাট বাসপের বাবাকে ডেকে ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে নিষেধ করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের বেতনের টাকায় পরিচালিত স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের হুমকির মুখে এ কাজটি করেছে। উত্তরবঙ্গের একটি স্কুলে নিম্ন সম্প্রদায়ের এক শিশুর ভর্তি না নেওয়ার ঘটনাও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে।
প্রশ্ন জাগে, অভিভাবকের সম্প্রদায় ও অর্থকেন্দ্রিক মানসিকতায় সন্তান প্রভাবিত হয় কিনা? কিছু স্কুলে মৃদুভাষী কোনো কোনো শিশু সহপাঠীদের দ্বারা মানসিক হেনস্তার শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব ঘটনা অনেকে কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না। এখন 'আমি' ভালো আছি এবং ভালো থাকতে চাই- এটাই যেন শেষ কথা। যে কোনো প্রকারে সেই 'ভালো' থাকাটাও যেন অনেকের অলিখিত মৌলিক অধিকার। নিজের সন্তানের জন্য পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র খুঁজতে অভিভাবকের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে না। আর চাহিবামাত্র অনেক কিছু পাওয়ার সুবাদে কোনো কোনো শিশু অভিভাবকের কাছ থেকে মূল্যবোধ শেখার পরিবর্তে ভিন্ন কিছু শিখছে।
কয়েক বছর আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক অনুষ্ঠানে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী অনুষ্ঠান শেষে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানালেন, রাজধানীতে মেয়েদের একটি স্কুলে স্টুডেন্ট বাস চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। স্টুডেন্ট বাস চালুর উদ্দেশ্য ছিল স্কুলের সামনে ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে সৃষ্ট যানজট কমানো। কিন্তু সেই বাস সার্ভিস চালুর ক্ষেত্রে জোর আপত্তিটা আসে কিছু বিত্তশালী অভিভাবকের কাছ থেকে। বিষয়টা এমন যে, তাদের মেয়েরা ক্লাসে নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্তের মেয়েদের সঙ্গে বসলেও একসঙ্গে বাসে আসা-যাওয়া বেমানান। এসব পরিবারের কোনো সন্তান যদি তার সহপাঠীকে একটু ভিন্ন চোখে দেখতে শেখে তবে তার দায় অভিভাবকদের ওপরেই বর্তায়।
ব্যতিক্রম ভাবনার অভিভাবকও সমাজে আছেন। তেমনই একজন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী বছর তার ছেলে জন্মদিনে যা চাইবে তাই দেবেন। শর্ত হচ্ছে- জন্মদিনে তার ছেলেকে একটি অনাথ আশ্রমের শিশুদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতে হবে। সেদিন তিনি ছেলেকে বলবেন, তুমি যা চাচ্ছ তাই দিচ্ছি। তবে এটাও উপলব্ধি করার চেষ্টা কর যে তুমিও আজ অনাথ হতে পারতে। আমি চাই, তুমি এই বোধশক্তি নিয়ে বড় হও।
আশার কথা হচ্ছে, আর্থসামাজিক অবস্থার ন্যায়হীন বিবর্তনকালেও অনেক শিশু চিন্তা-ভাবনায় অভিভাবকের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। স্কুলে তারা সহপাঠীদের সঙ্গে কী কী আলোচনা করে, সেটা অনেক অভিভাবক জানেন না। পারিবারিক সমস্যাও কোনো কোনো শিশু সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করে। তেমনই দুই সহপাঠী অমিয় ও সাকিব। অমিয়র বাবা যে ধূমপান করেন, সেটা সাকিব জানে। বাবা ধূমপান করায় অমিয়র কষ্টের অন্ত নেই। বাবা বাইরে থেকে ঢুকলেই অমিয় তার মুখ শুঁকে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। প্রায়ই সাকিব অমিয়কে বলে, তোর বাবা এখনও সিগারেট ছাড়েনি? অমিয় মুখ কালো করে বলে, নাহ্! একদিন অমিয় বাবার ধূমপান পরিহার করাতে একটা কৌশল বের করে। সেটা হচ্ছে, সে এলাকার সব সিগারেটের দোকানে গিয়ে বাবার ছবি দিয়ে বলবে, আপনারা এই লোকের কাছে সিগারেট বিক্রি করবেন না। অমিয়র বাবা শুধু এলাকার দোকান থেকেই সিগারেট কেনেন না। তাই অমিয়র পরিকল্পনা খুব একটা কার্যকর না হলেও ছেলের ভাবনা বাবাকে অপরাধী করে দেয়। বাবা নতুন প্রজন্মের পরিচ্ছন্ন ভাবনায় সুন্দর আগামীর ছবি দেখতে পান।
সব শিশুই মা-বাবাকে বড় দেখতে ও প্রমাণ করতে চায়। বলার মতো মা-বাবার গল্পটা তারা অন্যকে শুনিয়ে আনন্দ পায়। যে অভিভাবকরা দুর্নীতির অর্থে দুর্গন্ধ না পেলেও নিম্ন আয় কিংবা সম্প্রদায়ের সন্তানকে অচ্ছুত ভাবেন, তাদের গল্প সন্তানের কাছে আনন্দের হবে না। তারা কোমলমতি শিশুদের সুকোমল মূল্যবোধকে কলুষিত করে হিরো হতে পারবেন না। অভিভাবকরা নিজের সন্তানকে বলার মতো একটি গল্প উপহার দিলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হবে।
লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com