সমাজ

দুঃখহীন সুখ

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০ । ০১:৩৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

ড. প্রতিভা রানী কর্মকার

আমাদের সবার জীবনের সুখ-দুঃখের কথা নিয়ে রচিত হয় অন্তহীন কাহিনি। দুঃখহীন সুখ বা সুখহীন দুঃখ কোথাও নেই। প্রকৃতি যেমন সহসা অবয়ব বদলায়, মানুষের জীবনও তেমন এক রকম থাকে না। যে সকালে আকাশ ঝলমলে পরিস্কার, ঝকঝকে রোদে পরিপূর্ণ; তার আগের বা পরের রাতে যে ঝড় আসেনি বা আসবে না- কে বলতে পারে নিশ্চিত করে! অর্থাৎ আমাদের জীবনে এমন কোনো সুখ, দুঃখ, আনন্দ বা বেদনা নেই, যা চিরস্থায়ী।

দুঃখহীন সুখ আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। চিরায়ত বাংলা গ্রন্থমালা, লোককাহিনি, গুণীজন কথা- সর্বত্র যে প্রবহমান সংলাপ সেখানেও সুখ ও দুঃখ পাশাপাশি বহমান। আজকের পৃথিবীতে আমরা উৎকর্ষের খোঁজে ছুটছি। আমাদের বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আবিস্কার নিয়ে গর্ব করার প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ কেউ চিরস্থায়ী সুখের খোঁজে দিনরাত কষ্ট করছেন, কেউবা চেষ্টাবিহীন ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ সন্ধানে রয়েছেন। নৈতিকতার চেয়ে স্বার্থপরতা, নিজেকে সংশোধনের পরিবর্তে অপরকে আক্রমণ করার প্রবণতায় সৌন্দর্য ও নির্ভরশীলতা হারাচ্ছে আধুনিক সভ্যতা।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন শুধু সুখ ও সাফল্যের জন্য তৈরি না করে; বরং দুঃখ ও কষ্টের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়লাভ করার অনুপ্রেরণা জোগায়- এদিকটা ভাবতে হবে। শিল্পজগতে প্রকৃত শিল্পীদের অবদান তুলে ধরা প্রয়োজন। একজন খাঁটি শিল্পী দুঃখকে ফুটিয়ে তোলেন দুঃখের ছবি দিয়ে; শুধু রং দিয়ে নয়। একজন প্রাণস্পর্শী লেখকও তেমনি দুঃখকে জয় করতে চান। দুঃখের কবিতা, গল্প বা কাহিনি দিয়ে দুঃসময়ে বলেন বিদ্রোহের কথা। এমনি একজন হলেন আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তিনি আমাদের প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, মানুষের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি ও জাতীয় কবি। ছোটবেলা থেকে কত কষ্টই না করেছেন তিনি! ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর অল্প পয়সায় মসজিদের খাদেমের কাজ, রুটির দোকানে কাজ, লেটোর দলে গান এবং পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি। ব্রিটিশদের রোষানলে অনেকবার জেলও খেটেছেন। বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থাতে থাকলেও তিনি তাঁর 'দারিদ্র্য' নামক কবিতায় লিখেছেন-

'হে দারিদ্র্য! তুমি মোরে ক'রেছ মহান্‌,
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা।- দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;'।

আর তাই তো তাঁর গান, কথায় আজও বিদ্রোহের সুর বাজে। ছোটবেলা থেকে মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তাঁর মনে দাগ কাটত। প্রতিবাদে ধরতেন কলম। রচনা করতেন সাম্যের কবিতা। উঁচুতলার মানুষকে তাদের অত্যাচার থামানোর জন্য তিনি বারবার তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনায় লেখনীর মাধ্যমে সতর্ক বার্তা জানিয়ে দিতেন। শ্রমিকদের মূল্যায়নের কথা যখন সমাজ চিন্তাও করেনি, তখন তিনি তাঁদেরকে 'পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কারিগর' বলে সম্বোধন করে অনেক লেখা লিখেছেন। পরাধীনতার বেড়াজাল ভেঙে তিনি মুক্তির গান শুনিয়েছেন। সব বন্দির প্রাণে জুগিয়েছেন মুক্তির ডাক। কখনও তাঁর লেখনীতে তিনি ভীতু যুবককে বলেছেন বৃদ্ধ, আর সাহসী বৃদ্ধকে বলেছেন চিরযৌবনদীপ্ত যুবক। তাঁর মতে- বার্ধক্য কখনও বয়সের ফ্রেমে বাঁধা থাকে না; তা একান্তই মনের ব্যাপার, প্রাণশক্তির ব্যাপার। তিনি দলনেতা হয়ে নয়; বরং দলভুক্ত সহযাত্রী হয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি দারিদ্র্যকে জয় করে এভাবেই দুঃখ-কষ্টকে জয় করেছেন।

এবার একজন মহান নেতার নাম না বললেই নয়। কারণ, তিনি আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)। উল্ক্কাপিণ্ডের মতো ক্ষণস্থায়ী নন, ধূমকেতুর মতো হঠাৎ আবির্ভূত নন; বাংলার রাজনৈতিক গগনে ধ্রুব নক্ষত্রের মতোই কাল-পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু চিরস্থায়ী আসন লাভ করেন।

আমাদের জীবনটা ক্ষণস্থায়ী। তাই অল্প সময়ের মধ্যেই গুণীজনের দেখানো পথ অবলম্বন করে সংগীত, সাহিত্য, বিজ্ঞান- সর্বক্ষেত্রে কষ্টের কথা মনে রেখে সাধনা করতে হবে। জীবনকে বহুর মধ্যে স্বতন্ত্র করে কষ্টকে আলিঙ্গন করেই সুখের সন্ধান করা সমীচীন; কষ্ট থেকে পালিয়ে নয়। প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ মানুষকে সফল ও সম্মানিত করে। সেই ইচ্ছাশক্তি যেন দুঃখহীন সুখের খোঁজে না হয়; বরং দুঃখ আছে জেনে সুখ আর শান্তির খোঁজ হয়- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com