বিশেষজ্ঞ মত

হোম কোয়ারেন্টাইন মানতেই হবে

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০ । ০১:৪১ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাহাদাত হোসেন পরশ ও রাজবংশী রায়

করোনাভাইরাসের মহামারিতে কাঁপছে গোটা দুনিয়া। মানব জাতি নতুন সংকট মোকাবিলা করছে। এখন পর্যন্ত করোনার কোনো ওষুধ বা টিকা আবিস্কার না হলেও এই লড়াইয়ে জিততে সবচেয়ে জরুরি হলো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, করোনা প্রতিরোধে চারটি বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। তা হলো- সন্দেহভাজন রোগীদের অন্যদের থেকে আলাদা করা, তাদের পরীক্ষা করা, শনাক্ত করা ও চিকিৎসা দেওয়া। সন্দেহভাজনদের আলাদা রাখতে হবে। তারা করোনায় আক্রান্ত কি-না বোঝার পন্থা হলো আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টাইন ও প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন। তবে বিদেশফেরতদের অনেকেই হোম কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশনা মেনে চলছেন না। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার বদলে অনেকে বাজার, রাস্তাঘাটসহ জনসমাগমস্থলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে খোশগল্পে সময় পার করছেন। হোম কোয়ারেন্টাইন থেকে কেউ কেউ পালাচ্ছেন। এসব কারণে অনেক প্রবাসীকে জরিমানাও করা হচ্ছে। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অনেককে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা যাচ্ছে। বিদেশফেরত সন্দেহভাজনরা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন না বলেই করোনার ঝুঁকি বাড়ছে। করোনাভাইরাস স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও বাড়ছে।

বর্তমানে সারাদেশে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় সব দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় পরিবহন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। কার্যত 'লকডাউন' করা হয়েছে শিবচর।

সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রতিরোধে হোম কোয়ারেন্টাইন কতটা জরুরি তা অনেকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তারা বিষয়টি হালকাভাবে নিচ্ছেন। এর পরিণাম তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এমনকি গোটা সমাজের জন্য কত ভয়াবহ হতে পারে, তা বুঝতে চাচ্ছেন না তারা। নতুনভাবে করোনা আক্রান্ত রোধ করতে হোম কোয়ারেন্টাইনের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে শক্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অল্প জরিমানা না করে শর্ত লঙ্ঘনকারীদের কারাদণ্ড নিয়ে বিশেষ জেলে রাখা যেতে পারে।

বিদেশফেরত নাগরিকদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এসব কমিটি গঠন করতে হবে। বুধবার স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করা হয়। নতুন কমিটিকে সহায়তা করার জন্য সংশ্নিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করা হয়েছে।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম মেনে চলতেই হবে। যারা এটা মানবে না তাদের শুধু জরিমানা নয়, কারাদণ্ডও দিতে হবে। জরিমানা করে টাকা আদায় মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। হোম কোয়ারেন্টাইনের বিধিবিধান প্রয়োগে সরকারকে আরও কঠোর হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, সরকারের অনুরোধ অনেকে আমলে নিচ্ছে না। প্রত্যেক জেলায় একেকটি প্রতিষ্ঠানকে সাব-জেল করা যেতে পারে। হোম কোয়ারেন্টাইন যারা মানবে না, তারা কারাদণ্ডের পর সাব-জেলে থাকবে। কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম অমান্যকারীদের তথ্য সংশ্নিষ্ট দেশের দূতাবাসে পাঠানো দরকার। যাতে তারা যে দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে, ওই দেশও তার বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নিতে পারে। এটা এমন এক সময় যখন গোটা মানব জাতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন। পৃথিবী কী সংকটময় সময় পার করছে এটা সকলকে অনুধাবন করতে হবে।

রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, যখন ওমরাহ বন্ধ হয়ে যায়, সৌদি আরবে দুটি মসজিদ ছাড়া সব মসজিদে জামাত বন্ধ করা হয়েছে। তখন বুঝতে হবে করোনা ঠেকাতে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে কতটা কঠোর হওয়া উচিত।

ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন সমকালকে বলেন, করোনা প্রতিরোধে হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম মেনে চলা জরুরি। তবে আমাদের এখানে অনেক ক্ষেত্রে আইন ও নিয়ম না মানার সংস্কৃতি রয়েছে। করোনার ক্ষেত্রে হোম কোয়ারেন্টাইনের অর্থ কী- এটা শুরু থেকে সাধারণ মানুষকে আমরা সেভাবে বোঝাতে পারিনি। এটা না মানলে এর ভয়বহতা এবং কী পরিণতি হতে পারে সে ব্যাপারে সকলকে অবহিত করা জরুরি। মোবাইল ফোন, টিভি ও পত্রিকার মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে।

মাহবুবা নাসরীন আরও বলেন, হোম কোয়ারেন্টাইনে কারা রয়েছে, কারা যাচ্ছেন তার হিসাব রাখতে একটি নির্দিষ্ট ডাটাবেজ থাকা দরকার। এখনও সেই ধরনের ডাটাবেজ তৈরি হয়নি। অনেক এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। সেখানে বিয়েশাদি হয়ে থাকে। এখন সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে বিভিন্ন এলাকার কমিউনিটি সেন্টারগুলো প্রস্তুত রাখা যেতে পারে। এই সংকট মোকাবেলায় তরুণদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। তারা তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে। কেউ আক্রান্ত হলেই তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। করোনা নিয়ে যাতে জনগণ সঠিক তথ্য পান, সেটি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বিদেশ থেকে ফেরা পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকায় 'হোম কোয়ারেন্টাইনে' আছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে অভিযোগ উঠেছে, বিদেশফেরতরা হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত মানছেন না। অনেকেই বাসাবাড়িতে অবস্থান না করে বাইরে বের হচ্ছেন। সমকালের কাছেও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ ধরনের অভিযোগ এসেছে। সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিবেশীরা চাপ প্রয়োগ করেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এতে করে রোগটি আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আতঙ্ক বাড়ছে। কারণ এটি অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে রোগ।

সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিষয়টি নিয়ে সমকালকে বলেন, তাদের কাছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযোগ এসেছে, অনেকে হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত মানছেন না। অনেকে বাসাবাড়িতে অবস্থান না করে রাস্তাঘাট, বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সংশ্নিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাব, এই ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে সবাই যেন নির্দেশনা মেনে চলেন। অন্যথায় আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো। আমরা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি চাই না। যাতে করে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়। সুতরাং হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত সবাই মেনে চলবেন এটিই প্রত্যাশা করি।

এ বিষয়ে চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, বিদেশফেরতদের মাধ্যমেই দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের বেশিরভাগই বিদেশফেরত প্রবাসী। তাদের একজনের সংস্পর্শে থাকার কারণেই পরিবারের অন্য সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। সুতরাং বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সংক্রমিত দেশগুলো থেকে ফেরত ব্যক্তিদের নূ্যনতম ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই মানতে হবে। কারণ কয়েকশ' মানুষের জন্য সারাদেশের মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যাবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এ বিষয়ে আহ্বান-অনুরোধ সবই করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো এলাকায় কেউ কেউ হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন না। এতে করে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে এর পরও আহ্বান জানাব, সবাই যেন হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত মেনে চলেন। অন্যথায় সংক্রামক রোগের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টাইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন-করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে সতর্কতা হিসেবে এই তিনটি শব্দ এখন বহুল পরিচিত। এর মধ্যে আইসোলেশন হলো- করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রত্যেককে পৃথক রেখে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে আসা সন্দেহভাজন কাউকে বাসাবাড়িতে পৃথকভাবে অবস্থান করাকেই বলে হোম কোয়ারেন্টাইন। এরকম সন্দেহভাজনদের হাসপাতালে এনে পর্যবক্ষণে রাখাকে বলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী সন্দেহভাজনদের কমপক্ষে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। এ সময়ের মধ্যে কেউ আক্রান্ত না হলে তিনি করোনামুক্ত বলে প্রমাণিত হবেন।

কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালে আলাদা গোসলখানা এবং টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। অন্যদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছে কেউ গেলে তাকে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে এবং ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেওয়া জরুরি। ব্যক্তিগত ব্যবহার সামগ্রী অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যাবে না।







© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com