নির্যাস

কবি জয়দেব ও তার গীতগোবিন্দ কাব্য

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০ । ০৩:০১ | প্রিন্ট সংস্করণ

--

জয়দেব [১১৭০-১২৪৫]

হলায়ুধ মিশ্রের সেকশুভোদয়ায় একটি গল্প আছে লক্ষ্মণ সেনের সভায় জয়দেবের আগমন নিয়ে। একদিন লক্ষ্মণ সেনের সভায় এক বিখ্যাত সঙ্গীতনিপুণ কলাবিদ এসে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে জাহির করেন। রাজা তার দাবি স্বীকার করে নিয়ে জয়পত্র লিখে দিতে চাইলেন। খবর পেয়ে জয়দেব পত্নী পদ্মাবতী রাজসভায় এসে অনুরোধ করলেন তার স্বামীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে যেন তাকে জয়পত্র না দেওয়া হয়। রাজা সভায় জয়দেবকে আনলেন। তথাকথিত সঙ্গীতনিপুণ কলাবিদের গানে গাছের সব পাতা ঝরে গেল। সবাই সঙ্গীতনিপুণ কলাবিদকে ধন্য ধন্য করতে লাগল। জয়দেব বললেন এ আর এমন কী! গাছে আবার পাতা গজিয়ে দেখাও। সঙ্গীতনিপুণ কলাবিদ অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন জয়দেব গান ধরলেন, আর সাথে সাথে গাছের পাতা গজিয়ে উঠল। সবাই জয়দেবের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করল।

রূপকথার মতো এমন গল্প প্রচলিত থাকলেও আসলে জয়দেব মধ্যযুগীয় সংস্কৃত সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রসিদ্ধ কবি। তিনি গীতগোবিন্দ কাব্যের রচয়িতা। সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দের অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর প্রভাব রয়েছে। ধারণা করা হয় বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলির সূচনা জয়দেবের গীতগোবিন্দের পদাবলি থেকেই।

কবি জয়দেবের জন্ম বীরভূমের কেন্দুবিল্ক্ব বা কেঁদুলি গ্রামে। তার নামে সেখানে প্রতি বছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তার পিতার নাম ভোজদেব ও মাতার নাম বামা দেবী। তবে অন্য মতে জয়দেব পুরীর নিকটাবর্তী কেন্দ্রবিল্ক্ব শাসনের ব্রাহ্মণ পরিবারের মানুষ ছিলেন। তবে স্বয়ং জয়দেব লিখেছিলেন 'কেন্দবিল্ক্ব সমুদ্র সম্ভব'। উড়িষ্যা ও দাক্ষিণাত্যের সংস্কৃৃতিতে জয়দেবের প্রভাব অনস্বীকার্য।

জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণ সেনের (১১৭৮-১২০৬) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম; অন্য চারজন হলেন- গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ী ও উমাপতি ধর। ১২ শতকে জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দম্‌ কাব্যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা, রাধার বিষাদ বর্ণনা, কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুলতা, উপালম্ভ বচন, কৃষ্ণের রাধার জন্য উৎকণ্ঠা, রাধার সখীদের দ্বারা রাধার বিরহ-সন্তাপের বর্ণনা গ্রন্থিত হয়েছে। এ কাব্যের মনোরম রচনাশৈলী, ভাবপ্রবণতা, সুমধুর রাগরাগিণী, ধর্মীয় তাৎপর্য তথা সুললিত কোমল-কান্ত-পদাবলী সাহিত্যিক রসপিপাসুদের অপার আনন্দ প্রদান করে। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম জোন্স দ্বারা লিখিত 'অন দ্য মিউজিক্যাল মোডস্‌ অব হিন্দুস্‌' বইয়ে গীতগোবিন্দকে 'গোপনাট্য' (চধংঃড়ৎধষ উৎধসধ) বলে অভিহিত করা হয়েছে। অন্য সমালোচকরা একে 'গীতিনাটক', 'পরিশুদ্ধ যাত্রা', 'সংগীত রূপক' বলে আখ্যায়িত করেছেন। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকায় এই কাব্যকে 'ধর্মনাট্য' বলা হয়েছে। এই কাব্যের অনুবাদ সংস্করণ পাঠ করে কাব্যটির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন জার্মান কবি গ্যেটে।

গীতগোবিন্দম্‌ ২৪টি প্রবন্ধ ও ৭২ শ্লোকযুক্ত অষ্টপদী পঙ্‌ক্তির এমন এক সর্বাঙ্গসুন্দর গ্রন্থ যেখানে রাধা-কৃষ্ণের মিলন-বিরহ, অভিলাষ, প্রত্যাশা, নিরাশা, মান, ঈর্ষা, হর্ষোলল্গাস তথা পুনর্মিলনের কাহিনি মধুর লালিত্যমি ত পদ দ্বারা সংবন্ধিত হয়েছে। এই কাব্যের দশাবতার-স্তোত্রেই প্রথম গৌতম বুদ্ধকে 'যজ্ঞনিন্দাকারী' বিষুষ্ণর অবতাররূপে উলেল্গখ করা হয়েছে। 'নবরসিক' জয়দেব এই কাব্যে শৃঙ্গার রসের মাধুর্যব্যঞ্জক বর্ণযুক্ত বৈদর্ভী রীতির অনুপম শৈলীর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কাব্যটি দ্বাদশ সর্গে বিভক্ত। যথা : ১. সমোদদামোদর, ২. সক্লেশকেশব, ৩. মুগ্ধ মধুসূদন, ৪. স্নিগ্ধ মধুসূদন, ৫. সাকাংক্ষ পু রীকাক্ষ, ৬. কুণ্ঠবৈকুণ্ঠ, ৭. নাগরনারায়ণ, ৮. বিলক্ষলক্ষ্মীপতি, ৯, মন্দমুকুন্দ, ১০. চতুর চতুর্ভুজ, ১১. সানন্দ দামোদর ১২. সুপ্রীতিপীতাম্বর।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com