জানালাগুলো খোলা থাক

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০ । ০১:৫০ | প্রিন্ট সংস্করণ

--

আমরা জানি, সরকারের পক্ষে কার্যত 'লকডাউন' ঘোষণা করা হলেও সবাইকে ঘরবন্দি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এটাও স্বীকার করতে হবে যে, অনেক মানুষই এখন ঘরবন্দি। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে আসছেন না। ইতোমধ্যে ঘরবন্দির মেয়াদ এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। এই ধারণা অমূলক হতে পারে না যে, এই পরিস্থিতি বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পর্যন্ত গড়াবে। বস্তুত সামষ্টিক স্বার্থে এর বিকল্পও নেই। স্বীকার করতে হবে, বিষয়টি নিছক ঘরবন্দি থাকার নয়। বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের অর্থনীতির প্রশ্ন। বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষ, যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের ঘরে বসে থাকলে চলবে কীভাবে? এই অনুমান অত্যুক্তি হতে পারে না যে- নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগরিকদের সঞ্চয় ফুরিয়ে গেলে তারা না পারবে হাত পেতে সাহায্য নিতে, না পারবে হাত ব্যবহার করে উপার্জনের সুযোগ।

ভবিষ্যতের অর্থনীতি, উপার্জন, টিকে থাকার প্রশ্নও এখন কেউ যদি 'দূরের বাদ্য' মনে করে, তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ এক বা দুই সপ্তাহের ঘরবন্দি দশা কীভাবে কাটাবে, সেই প্রশ্নই অনেকের সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। 'সামাজিক জীব' মানুষের জন্য হঠাৎ চেপে বসা সামাজিক দূরত্ব যেন সত্যিই অলঙ্ঘনীয়। আমরা জানি, পশ্চিমা জনগোষ্ঠী এমনিতেই 'ব্যক্তিবাদী'। একই পরিবারে থেকেও ভিন্ন ভিন্ন জগৎ সেখানে বিরল নয়। তাদের জন্য লকডাউন হয়তো সাংস্কৃতিক হোঁচট নয়; কিন্তু প্রাচ্য জনগোষ্ঠী যারা স্বভাবতই দলেবলে থাকতে পছন্দ করে, তারা কীভাবে এই একলা থাকার দিনগুলো কাটাবে? ভুলে যাওয়া চলবে না, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে পারিবারিক বিনোদনের মাধ্যমও পর্যাপ্ত নয়। নিজের ঘরে যার যার মতো করে মগ্ন থাকার সুযোগ সামান্য।

এ ক্ষেত্রে বই হতে পারে একটি মাধ্যম। বইয়ের সপক্ষে প্রচারকারীরা বলে থাকেন যে, নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হিসেবে এর তুলনা নেই। আমরাও মনে করি, এই সময়ে বই হতে পারে সময় কাটানোর মাধ্যম। আমরা দেখছি, বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের পক্ষে বই বিতরণ করা হচ্ছে। কোনো কোনো প্রকাশক তাদের প্রকাশিত গ্রন্থের ই-সংস্করণ বিনামূলে দিচ্ছেন। যদিও বই কেনার প্রবণতা কমেছে; এই প্রত্যাশা করা যেতেই পারে যে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এখনও কিছু বই রয়েছে। ঘরবন্দি থাকা অবস্থায় যদি সেগুলো সদ্ব্যবহার করা যায়, তাহলে কেবল সময় কাটানো নয়, নতুন চিন্তা ও উপলব্ধিও জন্মাবে। দুই-তিন সপ্তাহে যদি বই পড়ে সময় কাটে, তাহলে তার আলো ব্যক্তি ও পরিবার পেরিয়ে সমাজেও পড়বে আশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে মুদ্রিত সংবাদপত্রের প্রাসঙ্গিকতাও আমরা আরেকবার তুলে ধরতে চাই। সামান্য কয়েক টাকা খরচ করে সংগৃহীত সমকাল কিংবা অন্যান্য সংবাদপত্র হতে পারে ঘরবন্দির দিনগুলোর জন্য একটি কার্যকর খোলা জানালা।

স্বীকার করতে হবে, সব পরিবারের জন্য হাতের নাগালে বই পাওয়া সহজ নয়। শিক্ষার হার বাড়লেও শ্রমজীবী অনেক পরিবারে বই পড়ার সামর্থ্যও নেই। সে ক্ষেত্রে টেলিভিশনে গতানুগতিক অনুষ্ঠান ও খবরের সঙ্গে বই পাঠ বিষয়ক অনুষ্ঠান চালু করা যেতে পারে। চালু করা যেতে পারে দূরশিক্ষণ অনুষ্ঠানও। দুই বা তিন সপ্তাহ যেহেতু ঘরেই বসে থাকছে বেশিরভাগ মানুষ। এর মাধ্যমে তাদের অক্ষরজ্ঞান দেওয়া গেলে তা হবে বিরাট সাফল্য।

আমরা চাই- মানুষের চিন্তা, মনন ও চেতনার জানালাগুলো খোলা থাক ঘরবন্দিত্বের দিনগুলোতেও। সেখানে বইয়ের পাশাপাশি উন্নতমানের সিনেমা, নাটক, জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানও নিশ্চয়ই কাজে আসবে। আসলে প্রয়োজন আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। সংবাদমাধ্যম, প্রকাশক, সরকার, এমনকি পাড়ার পাঠাগার কর্তৃপক্ষ যদি আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসেন, তাহলে ঘরবন্দির সময় খোলা জানালাগুলো পরবর্তীকালেও খোলাই থাকতে পারে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com