একাত্তরের চারঘাট গণহত্যা

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০ । ০১:০৬ | প্রিন্ট সংস্করণ

ড. মেসবাহ কামাল ও কবিকো আজাদ

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যার যেসব ঘটনা ঘটায়, তাদের অন্যতম ছিল চারঘাট গণহত্যা। পদ্মা নদীর পাড়ে অবস্থিত রাজশাহী জেলার এই উপজেলার দুটি প্রতিষ্ঠান সারদা পুলিশ একাডেমি ও আইয়ুব ক্যাডেট কলেজ এবং স্থানীয় বাজারে অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিসকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির সংবাদ পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর নজরে ছিল। উত্তরবঙ্গের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই শতাধিক গাড়ির এক বিশাল বহর এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা থেকে রাজশাহীর পথে যাত্রা করে এবং তার একাংশ, পাঁচ শতাধিক সৈন্যের একটি বড় বাহিনী, ৫০-৬০টি গাড়িতে করে বানেশ্বর-চারঘাট সড়ক ধরে ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ চারঘাট আসে। এই বাহিনী ওইদিন সারদা এলাকায় পুলিশ একাডেমি সংলগ্ন পদ্মা নদীর তীরে ব্যাপক গণহত্যা চালায়, যার সাক্ষ্য বহন করছে দুটি গণকবর ও একটি বধ্যভূমি।

রাজশাহী শহর থেকে ২০ মাইল দূরের পদ্মা ও বড়াল নদী বিধৌত চারঘাট উপজেলার পশ্চিমে পদ্মা নদীর ওপারে ভারতের মুর্শিদাবাদ আর পদ্মা নদীর পশ্চিমে সারদায় পূর্ব বাংলার প্রধান পুলিশ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং চৌকস সেনা অফিসার তৈরির প্রতিষ্ঠান ক্যাডেট কলেজ। কাজেই চারঘাটের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য স্ট্র্যাটেজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

পাকিস্তানি বাহিনী চারঘাটে আসার আগে ঝলমলিয়া, পুঠিয়া, মাড়িয়া, বিড়ালদহ ও বানেশ্বরে যে হত্যাযজ্ঞ চালায়, তার থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ সারদায় পদ্মা নদীর চরে এসেছিলেন। নিজেদের জীবন বাঁচাতে তারা পদ্মা পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেবেন ভেবেছিলেন। পুলিশ একাডেমি থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র ব্যবহার করে চারঘাটের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চারঘাট কুঠিপাড়ার টিঅ্যান্ডটির কাছে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। আক্রান্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছুক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং যুদ্ধ করতে করতে পুলিশ একাডেমির রাইডিং মাস্টার (ঘোড়া চালানো প্রশিক্ষক) লাল চাঁদ (৩৫) ও চাকরিজীবী শামসুজ্জামান সোমু (২৬) সেখানেই শহীদ হন, বেগতিক অবস্থা দেখে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। পাকিস্তানি বাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে নেমে এসে টিঅ্যান্ডটি সংলগ্ন মণ্ডল বাড়িসহ আশপাশের অনেক বাড়িতে আগুন দেয় এক ধরনের গানপাউডারের মাধ্যমে। তারপর কুঠিপাড়ার আরও ভেতরে ঢুকে পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী ইসমাইল হোসেন ও শামসুজ্জামান সোমুর পরিবারের চারজনসহ আরও কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে। আর যেন কেউ প্রতিরোধ না করতে পারে, এ জন্য গোটা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

পাকিস্তানি সৈন্যরা দুটি প্রধান দলে বিভক্ত হয়ে একটি দল পুলিশ একাডেমির মধ্যে প্রবেশ করে; অন্যটি আরও অগ্রসর হয়ে চাঁনমারি পার হয়ে পদ্মার পাড়ে যায়। চারঘাট গণহত্যার ঘটনায় পিতা ও দুই ভাইকে হারিয়ে নিজেরা বেঁচে ফেরা এবং প্রত্যক্ষদর্শী দুই ভাই মো. আবুল কালাম আজাদ ও মো. বেলাল আলী সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন সারদার পদ্মা পাড়ে পৌঁছে, তখন সেখানে কয়েক হাজার মানুষ নদী পেরিয়ে ভারত যাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছিলেন। চারঘাট থানার ভয়ার্ত জনগণ ছাড়াও পুঠিয়া, বাগাতীপাড়া, নাটোর, গুরুদাসপুর, সিংড়া প্রভৃতি দূরদূরান্তের পলায়নপর বহিরাগত মানুষজনও সেখানে ছিলেন। পর্যাপ্ত নৌকার অভাবে নদী পার হতে না পেরে তারা সেখানে আটকা পড়েছিলেন। থানাপাড়া গ্রামের পাশের নদীতীরে পাকিস্তানি সেনারা তাদের অনেককে ঘিরে ফেলে। এছাড়া, চাঁনমারি ও ক্যাডেট কলেজ এলাকা থেকে নদীর পাড় দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা সবাইকে 'ইধার আও, ইধার আও' বলে একত্রে গুছিয়ে নদীতীরের চরে নিয়ে যায়। এরপর সবাইকে তারা প্রশ্ন করে, 'কোন লোগ ইন্ডিয়া মে জানা চাতেহ?' যারা না বুঝে হাত তোলে, তাদের গুলি করে হত্যা করে। এর পর তারা শিশু ও নারীদের আলাদা করে। সমবেতদের মধ্যে যারা ইপিআর, পুলিশ ও ক্যাডেট ছিল তাদেরকে তারা হত্যা করে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা উপস্থিত সবাইকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসায় এবং এলোপাতাড়ি গুলি করে হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করে। এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার পর তারা পুলিশ একাডেমির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়েও কেউ কেউ মারা যাননি বা ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন বা উঠে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা পেছন ফিরে চেয়ে তা দেখতে পেয়ে সেখানে আবারও ফিরে গিয়ে তাদের গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এর পর অনেক লাশ এক জায়গায় জড়ো করে এক ধরনের গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

সেই ভয়াবহ দিনেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাডেট কলেজের মোট ১৮ জনকে হত্যা করে এবং পুলিশ একাডেমির নিহত হন ২৪ জন। তাদের নৃশংসতায় চারঘাটে সেদিন স্থানীয় ৭০০-৮০০ জনসহ আনুমানিক এক হাজার পাঁচশ' থেকে দুই হাজার মানুষ শহীদ হন। কুঠিপাড়া, থানাপাড়া, ক্যাডেট কলেজ, পুলিশ একাডেমি, গৌড় শহরপুর ও চারঘাটের নিকটবর্তী অন্যান্য এলাকার প্রতি পরিবারের দুই-তিন-চারজন করে পুরুষকে হত্যা করা হয়েছিল; অনেক শহীদের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। কারণ তারা কে কোথা থেকে এসেছিলেন, তা জানার কোনো উপায় ছিল না। অনেক লাশ শনাক্ত করা যায়নি, স্বল্প কিছু ক্ষেত্র ছাড়া তাদের দাফন পর্যন্ত হয়নি, পড়ে থাকা সেসব লাশ শিয়াল-কুকুর-শকুন-কাক ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে বহুদিন ধরে। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা ও নির্মমতার ব্যাপকতা ছিল কত ভয়াবহ, কত হৃদয়বিদায়ক ও নির্মম, তার প্রমাণ চারঘাট গণহত্যা।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এত বছর পরও স্বজন হারানো পরিবারগুলো এখনও সেই বেদনাকে ভুলতে পারেনি। তবে আত্মত্যাগের সেই বিবরণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কথ্য-ইতিহাস হিসেবে বহমান রয়েছে; স্থানীয় মানুষের কাছে তা কালক্রমে পরিণত হয়েছে গৌরব ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে।

লেখকদ্বয় যথাক্রমে সভাপতি, জন-ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র ও এমফিল শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com