
রওশন জামিল: ইতিহাস কাঁপানো এক খল অভিনেত্রী
প্রকাশ: ১৪ মে ২০ । ১৬:৪২ | আপডেট: ১৪ মে ২০ । ১৭:০৭
বিনোদন প্রতিবেদক

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকীর দিনে জন্ম রওশন জামিলের। জন্মেসাল ১৯৩১। মৃত্যুবরণ করেন ২০০২ সালের ১৪ মে। দেখতে দেখতেই ১৮ বছর হলো কিংবদন্তি এ অভিনেত্রীর চলে যাওয়ার।
রওশন জামিল কত বড় মাপের অভিনেত্রী ছিলেন তা এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো অনুধাবন করতে পারবেন না। তাকে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ৫০-এর দশকে। তখন মেয়েরা অভিনয় করতো না। সামাজিক একরকম ট্যাবু ছিল। ছেলেরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করতো। সেটা ভাঙেন রওশন জামিল। তখন জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) শরৎচন্দ্রের দেবদাসে অভিনয় করেন।
পরিবারের উনার একচ্ছত্র আধিপত্য। স্বামী, দুই ভাই থেকে চাকর-চাকরানীরা পর্যন্ত তার ভয়ে তটস্থ থাকেন। সিনেমার প্রেক্ষাপট ছিল স্বাধীনতা পূর্ব আন্দোলন নিয়ে। প্রখ্যাত নির্মাতা জহির রায়হান এই চরিত্রটি দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের একনায়কতন্ত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এখন পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে এই চরিত্রটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী খল চরিত্র। সংসারে কর্তৃত্বকারী এই চরিত্রে অভিনয় করে কিংবদন্তি হয়ে আছেন রওশন জামিল।
খল অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে স্বাতন্ত্র্য করেছিলেন, তবে নানা চরিত্রে তিনি নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছিলেন কতটা দক্ষ অভিনেত্রী তিনি। জীবন থেকে নেয়ায় যেই খান আতার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় দর্শকরা উপভোগ করেছিলেন, তার ঠিক কয়েক বছর পরেই সুজন সখিতে খান আতার মায়ের চরিত্রে নিজেকে দারুন ভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন। সুজন সখি শুধু নায়ক-নায়িকার ছবি নয়, এর বাইরে যে দুইটি চরিত্র বেশ গুরুত্ব পেয়েছে তা হল খান আতা ও রওশন জামিলের চরিত্র। সুজন সখির দাদীর চরিত্রে যে মায়াভরা অভিনয় করেছিলেন তা অতুলনীয়।
‘নানী গো নানী বলি যে আমি, আমারে নিয়ে লইয়া যাবা ভাইসাবের বাড়ি’, আমজাদ হোসেনের বিখ্যাত ছবি ‘নয়ন মণি’তে ববিতার সেই নানী হচ্ছেন রওশন জামিল। নয়ন মনিতেও মূল অভিনয়শিল্পীর বাইরে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পেয়েছিল এই নানী চরিত্রটি। দাদী- নানী চরিত্র শুধু নিছক মজার চরিত্র নয়, উনি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
নয়ন মনিতে অভিনয় করেই প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে যখন রঙ্গীন নয়ন মনি নির্মিত হয়,সেখানেও তিনি শাবনূরের নানী হয়েছিলেন যা বিরল অর্জন বটে। নানী গো নানী গানটি আবার ব্যবহৃত হয়েছিল গোলাপী এখন ঢাকায় ছবিতে, সেখানেও চম্পার নানী তিনি।
আমজাদ হোসেনের আরেক যুগান্তকারী সিনেমা ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে এই সিনেমার একটি দৃশ্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। ‘লাভ হয় না দশ ট্যাকা, টিকিট কাটুম সাত ট্যাকা’, বিড়ি ফুঁকে সেই বয়স্কা দাদীর চরিত্র রওশন জামিল ই করেছিলেন। শুধু এইটুকু অংশ ই নয়, পুরো ছবিতে তিনি ববিতা ও আনোয়ারার দারুণ সঙ্গী হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘ওরা ১১ জন’ এরও অন্যতম অভিনেত্রী তিনি।
বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র গুলোর মধ্যে অন্যতম ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, এই সিনেমায় শফির মা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় উনার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অর্জন। ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, দহন, পোকামাকড়ের ঘর বসতি, পেনশন, টাকা আনা পাই- এই সিনেমাগুলোতে যেমন মমতাময়ী মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তেমনই চিরাচরিত বাণিজ্যিক ধারার ছবি ‘আমার সংসার’ এও খল চরিত্রে দর্শকদের আরেকবার চমক দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জোছনা’তেও তিনি অভিনয় করেন নানীর চরিত্রে, ‘মিস লোলিতা’ ছবিতে মেথরানী চরিত্রে মুগ্ধ করেছিলেন। সিনেমার পাশাপাশি অনেক নাটকেই অভিনয় করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে কূল নাই কিনার নাই, সকাল সন্ধ্যা, ঢাকায় থাকি, তালা অন্যতম। খুব সম্ভবত সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘প্রেমের তাজমহল’।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বহুমাত্রিক অভিনয় করলেও জুরি বোর্ড সেভাবে তার প্রতি সুবিচার করেন নি। বেঁচে থাকাকালীন একটি মাত্র জাতীয় পুরস্কার ই দেখে যেতে পেরেছিলেন, মৃত্যুর পর চিত্রা নদীর পাড়ে সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। চিত্রা নদীর পাড়ে সিনেমাতে বিধবা পিসির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যিনি দেশভাগের করুণ যন্ত্রনার শিকার হয়ে মাতৃভূমি ছেড়েছিলেন।
অভিনেত্রীর বাইরে তিনি নৃত্যশিল্পী ছিলেন, স্বামী বিখ্যাত নৃত্য পরিচালক গওহর জামিল। দুইজন ই নৃত্য সংগঠক ছিলেন। এই নৃত্যে অবদানের জন্যই ১৯৯৫ সালে একুশে পদক পেয়েছিলেন। বেঁচে থাকাকালীন এই সম্মাননা পেয়েছিলেন, তা আমাদের দেশে সৌভাগ্যের ব্যাপার বটে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com