আমার কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে

প্রকাশ: ১৫ মে ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হাসান আজিজুল হক

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার হাসপাতালে চিকিৎসারত ছিলেন এক মুহূর্ত আগ পর্যন্ত তো এটুকুই জানতাম। কিন্তু এ মুহূর্তে তার চির প্রস্থানের খবরে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছি। আলো নিভে গেল, আমাদের আলো। আর যা কিছু বাকি, তা আমাকে বলতে হলে বলতে হবে সময় নিয়ে। আমার কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে, চোখ জলে ভাসছে। আপাতত এটুকুই, আর পারছি না।

আমাদের কালের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাকে নিয়ে বলতে গিয়ে তখন কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিল। এবার তাকে নিয়ে খানিকটা বলে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে চাই। দু'দিন আগেও হাসপাতাল ও তার চিকিৎসকদের সূত্রে সংবাদমাধ্যমে জেনেছি, তার স্বাস্থ্যবার্তা স্বস্তির। উন্নতি হচ্ছিল তার শারীরিক অবস্থার। কিন্তু এই স্বস্তির বার্তা আমাদের আশার ভাবনার দাগটা প্রলম্বিত করল না। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তা আমাদের জন্য খুবই মর্মান্তিক। আমার বছর দুইয়ের অগ্রজ এই পাহাড়সম জ্ঞানধারীকে নিয়ে তার গত জন্মদিনে সমকালের এই স্তম্ভে লিখেছিলাম। বহুকালের সম্পর্ক তার সঙ্গে তার চিরবিদায়ের পর তাকে নিয়ে কিছু লেখা খুব দুরূহ। আনিসুজ্জামানকে নিয়ে লেখা আমার জন্য আরও দুরূহ।

শুরুতেই বলেছি আলো নিভে গেল। হ্যাঁ, আলোই তো বটে। চারপাশ জ্বলজ্বল করা আলো। তার বিস্তৃতি যেন গণ্ডিহীন। বহুকাল থেকে তাকে চিনি-জানি। যদি সেই কলকাতা থেকে ঢাকা অব্দি চেনাজানার হৃদ্যতার কথা বলি, তাহলে বিরাট উপাখ্যান হয়ে যাবে। খুলনায় তার এক মামার বাড়ি ছিল। যদিও আমাদের জন্ম পশ্চিম বাংলায়, কিন্তু কাজের পরিধি রেখা টানা শুরু এই বাংলায়। খুলনার ফুলতলায় আমাদের বাড়ি ছিল। আমি যখন ১৯৬১ সালে ফুলতলার বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, তখন আমি দৌলতপুর কলেজে শিক্ষকতা করি। একদিন তিনি আসলেন সেখানে। আমি তখন একটি বিখ্যাত ইংরেজি উপন্যাসের অনুবাদের কাজে মগ্ন ছিলাম। তাকে দেখে চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলেন, কী করছেন। বিষয়টা জেনে আগ্রহভরে বইখানি হাতে তুলে নিয়ে বললেন, অনেক বড় কাজ করছেন, ব্যাখ্যা করে এর বর্ণনা দেওয়া কঠিন। আমি আজ মুক্তকণ্ঠে বলি। তার মতো এতবড় মাপের মানুষের পক্ষেই অনুজ সম্পর্কে এমন দ্বিধাহীন মূল্যায়ন অকপটে সম্ভব।

তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, এ কথা যতবার ভাবছি, ততবারই স্তব্ধ হয়ে যাই। স্মৃতিতে তিনি অমর। তিনি অমর তার কীর্তির জন্য। তার খ্যাতির সীমানা তো অনেক বিস্তৃত। তার দ্বারা কতকিছু সমৃদ্ধ হওয়ার ছাপ চতুষ্পার্শ্বে। সত্য-জ্ঞান-নীতি-প্রজ্ঞার সাধক আনিসুজ্জামান আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। জীবনচক্রের এই এক অমোঘ বিধান। এর কোনো ব্যত্যয়, ব্যতিক্রম নেই। সে জন্যই কি আমরা অতি আপনজনেরও মৃত্যুশোক সহ্য করতে পারি? আনিসুজ্জামানের মৃত্যুশোক আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে। একপর্যায়ে মৃত্যুশোক ভুলে গেলেও তাকে তো ভুলতে পারব না। সাম্প্রতিককালেও একসঙ্গে অনেক কথা বলেছি। তার সঙ্গে আমার দেখা হতো কম, কথা হতো অনেক বেশি। তার অপত্য ভালোবাসায় আমি স্নাত। আমাকে নিয়ে সম্প্রতি যে বইটি বের হয়, এর প্রথম লেখাটাই তার। এ মুহূর্তে সেই লেখার শেষ ক'টা লাইন মনে পড়ছে। তিনি কত বড়, তা বোঝাতেই সেখান থেকে ক'টা লাইন উদ্ধৃতি- 'হাসান আজিজুল হক এক বড় মাপের লেখক ও বড় মাপের মানুষ। বড় লেখক যে সবসময় বড় মাপের মানুষ হবেন, তাই নয়। আমাদের সৌভাগ্য তিনি দুই-ই।' অনুজকে অগ্রজের এই মূল্যায়ন মণিমুক্তার চেয়েও দামি। আমার স্মৃতিতে আজ কত কিছুই ভেসে উঠছে। থাক এগুলো, আমার অমূল্য সম্পদ হয়েই থাক।

তিনি সব জায়গায় যেতেন, যা কিছু সুন্দর তার সব কিছুর সঙ্গে থাকতেন। জীবিতকালে তিনি প্রজন্মের চেতনা সমৃদ্ধকরণে অনেক ডাক দিয়ে গেছেন। জোনাকির মতো চারপাশের অন্ধকারকে তিনি এভাবেই আলোকময় করে গেছেন। বন্ধুবৎসল আনিসুজ্জামানের প্রয়োজন আমাদের জীবন থেকে ফুরিয়ে যায়নি। আজ তার শারীরিক অনুপস্থিতিতে আমি বলব, তার ডাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শঙ্খধ্বনির মতো ছড়িয়ে পড়ূক দিগন্তজুড়ে। তার মতো মানুষ শয়ে শয়ে জন্মান না। দু-একজনই থাকেন; যারা অন্যদের প্রদীপের নিচে ডাকেন। এ জন্যই এমন জনরা নমস্য, বরেণ্য হয়ে থাকেন। আনিসুজ্জামান তেমনই একজন। তিনি আমাদের মাঝে অক্ষয় হয়ে থাকবেন। তার সমৃদ্ধ রচনা ভান্ডারে, তার কৃতকর্মে, তার আলোকময় ব্যাপ্তিতে তিনি আমাদের সামনে ছিলেন, আছেন, থাকবেন; তিনি জ্বল জ্বল করবেন এ আমার শাশ্বত বিশ্বাস।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com