তার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন

প্রকাশ: ১৫ মে ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সৈয়দ আবুল মকসুদ

যে কোনো সময় দুঃসংবাদ পাওয়া যাবে, এমন একটা আশঙ্কা গত চার-পাঁচ দিন ধরে করছিলাম। ল্যাবএইড থেকে বাসায় ফেরার পরদিন ফোন করেছিলাম। ফোন বাজল কিন্তু তিনি ধরলেন না। এক মিনিট পর তিনি নিজেই ফোন করলেন। দুর্বল গলা; শারীরিক সমস্যাগুলোর কথা বললেন। অল্প কথা বলেই সেদিন আমি ফোন রেখে দিই। কয়েকদিন পর আবার তিনি ভর্তি হলেন ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে। সে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমার অত্যন্ত প্রীতিভাজন ডা. আশিষ কুমার চক্রবর্তীর কাছ থেকে প্রতিদিনই আমি স্যারের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতাম। তারপর স্যার সেখান থেকে গেলেন সিএমএইচএ। সিএমএইচ থেকে তিনি আর আমাদের মাঝে ফিরে এলেন না। স্যারের এই না আসাটা যে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও শিক্ষা জগতের জন্য কত বড় শূন্যতা, তা এ মুহূর্তে বলে বোঝানো যাবে না। জাতির এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের পতন হলো।

গত সত্তর বছরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যত প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে, তার সবগুলোতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনে স্যারের ভূমিকা স্মরণীয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনসহ ষাটের দশকের বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বাঙালি সংস্কৃতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বৈরিতার বিরুদ্ধে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তার প্রত্যেকটির পুরোভাগে ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের প্রশাসনে অংশগ্রহণ ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ঘটনা। স্বাধীনতার পরে ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ তৈরিতে আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। সে সময় আমি তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময়ও তাকে দেখেছি অসামান্য নিষ্ঠার সঙ্গে জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ দলিলকে বাংলায় তর্জমার মহান দায়িত্বটি তিনি পালন করছেন।

প্রফেসর আনিসুজ্জামান জাতীয় এমনসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িত থাকলেও প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতি তিনি করেননি, কিন্তু পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল যেমন কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতাদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছেন। তাদের সমর্থন দিয়েছেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে যে কোনো উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডে তাকে পাওয়া যেত। ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল আপসহীন। বাকসংযম ও পরিমিতিবোধের প্রশ্নে তিনি ছিলেন তুলনাহীন। অসংখ্য সভা-সমাবেশে তাকে সভাপতিত্ব করতে হয়েছে, কোথাও প্রধান অতিথি বা মূল বক্তা। মূল বিষয়বস্তুর বাইরে অনাবশ্যক ও অপ্রাসঙ্গিক একটি কথাও তিনি বলতেন না। প্রফেসর আনিসুজ্জামান ছিলেন আদর্শ শিক্ষক ও নিষ্ঠাবান গবেষক। তিনি তার ছাত্রদের গবেষণায় উৎসাহিত করতেন। ছাত্রদের বাইরে আমাদের মতো গবেষকদেরও যে কোনো প্রয়োজনে আন্তরিকতার সঙ্গে সহায়তা করেছেন। গবেষণার জন্য কোনো বইপত্রের প্রয়োজন হলেও তিনি সানন্দে জোগাড় করে দিতেন। তার এমন অকুণ্ঠ সহাযোগিতার জন্যও আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ।

একটি আধুনিক, উন্নত, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল প্রফেসর আনিসুজ্জামানের আরাধ্য। শেষ জীবনে তিনি দুঃখ করেছেন যে, তার সেই স্বপ্ন আংশিক পূরণ হয়েছে, সম্পূর্ণ পূরণ হয়নি। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হলেই তার আত্মার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে। তার জীবন ও কর্মের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।







© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com