
করোনাকালে খাদ্য নিরাপত্তা ও মৌসুমি ফল
প্রকাশ: ২৪ মে ২০ । ১২:২২
ড. মনসুর আলম খান

জাতিসংঘ ২০২১ সালকে ‘আন্তর্জাতিক ফল এবং সবজি’ বছর হিসাবে পালন করতে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যকর খাবারের উপাদান হিসেবে ফল এবং সবজির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য তাদের এই আয়োজন। কারণ, তাদের হিসাব মতে কেবল ২০১৭ সালেই ৩৯ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেছে পর্যাপ্ত ফল এবং সবজি না খাওয়ার ফলে সৃষ্ট অপুষ্টিজনিত রোগে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উপমহাপরিচালক মারিয়া হেলেনা সেমেদো যেমনটি বলেছেন, ‘পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ ব্যতীত আমরা অপুষ্টিজনিত রোগ নির্মূলের আশা করতে পারি না।’
বর্তমান বিশ্বে অপুষ্টিজনিত ব্যাপক প্রাণহানীর আশঙ্কা আরও বেড়েছে। করোনার প্রভাবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) মতে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হলে সারা বিশ্বে করোনা পরবর্তী সময়ে প্রায় তিন কোটি লোকের প্রাণহানি হতে পারে অপুষ্টি, অনাহারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে। কোভিড-১৯ এর যেহেতু কোন সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক নাই, এই সময়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সবাইকে বেশি বেশি ফল-সবজি খেতে উপদেশ দিয়েছে, প্রতিদিন নিদেনপক্ষে দুই কাপ ফল এবং আড়াই কাপ সবজি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উপদেশ না দিলেও আমরা ফল খাব। এই মধু মাসে আমাদেরকে ফল খেতে উপদেশ দেওয়া রীতিমত অপমান করার শামিল। টসটসে লিচু, রসালো কাঁঠাল, অমৃত আম, টক-মিষ্টি লটকন খেতে কারো উপদেশের দরকার হবে না। তথাপি দেখে নেওয়া দরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কেন এই উপদেশ দিতে গেল।
ফলফলাদি হলো ভিটামিন ও খনিজ লবণের প্রধান উৎস। এতে থাকে প্রচুর আঁশ, স্টেরল ও এন্টিঅক্সিডেন্ট। হৃদরোগ, ক্যান্সার, ওজন বৃদ্ধি ইত্যাদি অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ফলমূলের ভূমিকা আজকাল স্কুলের বাচ্চারাও জানে। তাছাড়া, বেশি করে ফল খেলে পরিবেশও সুরক্ষিত থাকে, হয় টেকসই। এফএও এবং হু যৌথভাবে প্রকাশিত ‘সাসটেইনেবল হেলদি ডায়েটস গাইডিং প্রিন্সিপলস ২০২৯’ মোতাবেক খাদ্য তালিকা হওয়া উচিত ‘পুষ্টিকর এবং পরিবেশবান্ধব’, ভারসাম্যপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে ৬-৭ হাজার প্রজাতির শস্য আবাদ করা হলেও ৫০ ভাগ খাদ্যশক্তি আসে মাত্র তিনটি ফসল থেকে। এগুলো হলো, ধান, গম ও ভুট্টা। এই তিনটি ফসল একমুখী উৎপাদনের ফলে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে। প্রাণিজ আমিষ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের অন্যতম উৎস। এসব কারণে স্বাস্থ্যকর ও টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদে দেশে দেশে এখন চলছে শস্য বহুমুখীকরণ। বেশি বেশি ফল-ফলাদি খাওয়র আয়োজন।
বিশ্বে ফলের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যপক হারে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফলের গত ১০ বছরের গড় উৎপাদন বৃদ্ধি হার শতকরা ৩.৬ ভাগ। বাংলাদেশে এই প্রবৃদ্ধির হার বিস্ময়কর। এফএওর হিসেবে শতকরা ১১.৫ ভাগ। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দশম। গত ১০ বছরে দেশে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াইগুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ বেড়েছে। দেশি ফলভাণ্ডারে যোগ হয়েছে বিদেশি ফল। ড্রাগন, স্ট্রবেরি, এভ্যোকাডো, আরবী খেজুর, রামবুটান, পার্সিমন এবং আরও অনেক কিছু এখন চাষ হয় টাঙ্গাইল অথবা নরসিংদীতে। বিক্রি হচ্ছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফলের দোকান।
এসব ফল বিপ্লবের কারিগর হলেন আমাদের দেশের অগণিত তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা। যেমন-গোপালগঞ্জ জেলার বিদেশফেরত এক যুবক তিন বছর আগে মাত্র ১৫ একর জমি লিজ নিয়ে এবছর কাশ্মীরি কুল বিক্রি করেছেন ৩৫ লাখ ও পেয়ারা ৫০ লাখ টাকার। চট্টগ্রামের এক স্বপ্নবাজ তরুণ ইঞ্জিনিয়ার বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে মেতে উঠেছেন কাজুবাদাম নিয়ে। প্রতিযোগিতায় নেমেছেন ভিয়েতনামের সরকারি উদ্যোগের সাথে। ভিয়েতনাম সরকার ২০২৫ সালে ১০ বিলিয়ন ডলারের কাজুবাদাম রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। স্বপ্নবাজ তরুণ ওখান থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আদেশ আনতে চান বাংলাদেশে। রফতানি খাতে সিলেটের চা'কে চোখ রাঙানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে টাঙ্গাইলের কফি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্পের চারা থেকে নারিকেল হয় ৩ বছরে। প্রকল্প থেকে বাজারে আসতে যাচ্ছে আনারস, কাঁঠালের চিপস। এ সবই হচ্ছে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। জনসাধারণের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মানুষ দিনে গড়ে ফল খেত ৫৫ গ্রাম। বর্তমানে ৮৫ গ্রাম। আগে ফল ফলাদি ছিল রোগের পথ্য, মেহমানদারির উপাদান, এখন নিত্য আহার্য। আগে দেশে উৎপাদিত ফলের ৭০ শতাংশ বাজারে আসত জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় এই দুই মাসে। বাকি ১০ মাস থাকত ফলের আকাল। এখন দেশে ৫৪ শতাংশ ফল উৎপাদিত হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবণ, এই চার মাসে, বাকি ৪৬ ভাগ আসে আট মাসে। আগাম-নাবি-বারোমাসি, অপ্রচলিত, বিদেশি ইত্যাদি ফল আবাদের কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা আশা করছেন আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে বছরের যেকোন সময় পাওয়া যাবে যেকোন ফল। অনেকটা এখনকার কলার মত।
এসব দেখে মনে হতে পারে বাংলাদেশে ফল খাতে এখন চলছে 'একাদশে বৃহস্পতি'। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। দেশে ফল নিয়ে মানসম্মত গবেষণা হয় না বললেই চলে। ফল বিজ্ঞানী, ব্রিডার হাতেগোনা। আছে জাতের অপর্যাপ্ততা। প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের উদ্যোগের অভাব প্রকট। এছাড়াও রফতানি হয় না বললেই চলে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ লাখ টন ফল আমদানির বিপরীতে রফতানি হয়েছে মাত্র ২.৮ হাজার টন। আমাদের সুমিষ্ট আম, তরমুজ দেশের বাজারে গড়াগড়ি খায়, বিদেশে রফতানি হয় না আধুনিক ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, প্যাকেজিং হাউস, টেস্টিং ল্যাব ও মান নিয়ন্ত্রণের অভাবে। দেশীয় বাজারের অবস্থাও তথৈবচ। আমের কথাই ধরা যাক। এ বছর ১ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২২.৩২ লাখ টন। চাষি, ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, সরকারের কর্তাব্যক্তি সকলেই শঙ্কায় আছেন, এবছর আম বিক্রি হবে তো? কেননা, করোনার প্রভাবে বাজারে ক্রেতার অভাব, পরিবহন সংকট, আয় কমে যাওয়াতে সীমিত হয়েছে ভোক্তার খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ। তার ওপর যোগ হয়েছে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক বয়ে চলা রাসায়নিকের ভয়।
রাসায়নিকের নাম শুনে আমাদের শিরদাঁড়া শীতল হয়ে গেলেও ফলের আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার জন্য রাসায়নিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ফল একটি অতি পচনশীল পণ্য। এফএও’র মতে দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ৪৫ ভাগ পর্যন্ত নষ্ট বা অপচয় হয়। ফল যাতে দেরিতে পাঁকে অথবা পাকা ফল যাতে দ্রুত পচে না যায় সেজন্য বিদেশে গবেষণার অন্ত নেই। ভৌত ও রাসায়নিক দুই পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয় ফলের পচন রোধে, আয়ুষ্কাল বাড়াতে। ভৌত পদ্ধতির মাঝে আছে নিয়ন্ত্রিত চাপ, বিকিরণ, ভোজ্য পদার্থের প্রলেপ, বাষ্পীয় তাপ, নিয়ন্ত্রিত ও পরিবর্তিত বায়ুমণ্ডল প্যাকেজিং ইত্যাদি। প্রয়োগ করা হয় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- ইথাইলিন, মিথাইল জেসমোনেট, এথফোন এবং ইথিলিন গ্লাইকল, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, ওজোন, ১-মিথাইলসাইকোপ্রোপিন (১-এমসিপি), আমেনোয়োথক্সাইভিনাইল জাইসিন (এভিজি), সিলভার নাইট্রেট, সিলভার থিও-সালফেট, বেনজোথিয়াডিয়াজল ইত্যাদি। অর্থাৎ ফলের আয়ুষ্কাল বাড়ানোর জন্য রাসায়নিকের ব্যবহার পৃথিবীব্যাপী একটি বৈধ পন্থা। তবে এসব রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে, মানদন্ড ও নীতিমালা মেনে।
বাংলাদেশে ফলের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর আছে একাধিক আইন। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য অধ্যাদেশ (সংশোধন) আইন ২০০৫, বাংলাদেশ কৃষিপণ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৬৪ (সংশোধিত, ১৯৮৫), বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এবং টেস্টিং ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট ১৯৮৫, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৪, ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯, বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ ইত্যাদিসহ আরও আট দশটি আইন আছে। তারপরও শোনা যায়, এত এত আইনের ফাঁক গলে কিভাবে যেন সত্য অথবা মিথ্যা ভেজাল আম রাজশাহী বা সাতক্ষীরা থেকে চলে আসে ঢাকার বাদামতলী ঘাটে। অতঃপর চলে যায় বুলডেজারের নিচে। যদিও অনেক দিন পরে খবরে প্রকাশিত হয়, যে যন্ত্র দিয়ে এই ফরমালিন পরীক্ষা করা হয়, সেই যন্ত্রই ভুল যন্ত্র। অল্প মাত্রার ফরমালিন আম নিজেই তৈরি করতে পারে। অথচ, কে বা কারা ফরমালিন মেশায় অথবা মেশায় না দোষ হয় আমের। পথে বসে কৃষক। আতঙ্কিত ভোক্তা মুখ ফিরিয়ে নেয় বাজার থেকে। নিজেকে বঞ্চিত করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে। ভোক্তার অধিকার যেমন সমুন্নত রাখতে হবে, কৃষকেও দিত হবে ন্যায় বিচার। দরকার যথাযথ তদারকি ব্যবস্থা প্রণয়ন। আহরণ পরবর্তী প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছ মান নিয়ন্ত্রণ। সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণের আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ। পরীক্ষার জন্য আধুনিক ল্যাব স্থাপন। নচেৎ এই বিশাল অপচয় বয়ে আনতে পারে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা।
আশার বিষয় হল, সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় অনাকাংখিত এই অপচয় রোধ করতে সচেষ্ট হয়েছে। করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এক অনলাইন (জুম প্লাটফর্মে) কর্মশালা করেছেন কৃষিমন্ত্রী। সেখানে উঠে এসেছে নানান সমস্যা ও সমাধান। পরিবহণ সহজীকরণ, ভেজাল রোধকরণ, অনলাইন বিপণন, সচেতনতামূলক প্রচারণা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, রফতানির জন্য নতুন বাজার খুঁজে বের করা ইত্যাদি সুপারিশমালা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে কৃষি মন্ত্রণালয়।
ফল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিগত বছরগুলোতে কৃষি মন্ত্রণালয় চমকপ্রদ সফলতা দেখিয়ে আসছে। করোনাকালীন এই দুঃসময়ে মৌসুমি ফল সঠিকভাবে বাজারজাত করতে হবে। নচেৎ একদিকে চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে নাগরিকেরা বঞ্চিত হবে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মৌসুমি ফল খাওয়া থেকে। অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উপদেশ দিয়েছে বেশি করে পুষ্টিকর খাবার খেতে। কেননা, কোভিড-১৯ এর সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক নাই। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করাই একমাত্র উপায়।
ইতোমধ্যে আম, লিচু, আনারস, কাঁঠালসহ মৌসুমি ফল বাজারে আসতে শুরু করেছে। এসব মৌসুমি ফল যোগান দিয়ে থাকে শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানের। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মৌসুমি পুষ্টিকর ফল গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
monsuralamkhan@gmail.com
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com