
সরেজমিন : রাজাবাজার
এমন লকডাউন হবে ভাবেননি এলাকাবাসী
প্রকাশ: ১১ জুন ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ১১ জুন ২০ । ০২:২৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
অমিতোষ পাল ও বকুল আহমেদ

রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন করার পর এলাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে অবস্থান নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বুধবারের ছবি- সাজ্জাদ নয়ন
এলাকাবাসী ভেবেছিলেন লকডাউন যতই কড়াকড়ি হোক না কেন, প্রথম দফার মতো এবারও বের হতে পারবেন। সেভাবে গতকাল বুধবার সকালে অনেকেই কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন। কিন্তু বেরিয়েই দেখেন চেহারাটা ভিন্ন। তার পরও মহল্লা থেকে বেরিয়ে প্রধান সড়কে ওঠার ফটক পর্যন্ত পৌঁছান অনেকে। সেই ফটকও বন্ধ। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টহল। আছে সেনাবাহিনীর গাড়িও। এক কথায় রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় শুরু হওয়া জোনভিত্তিক লকডাউনে ওই এলাকায় বসবাসরত চিকিৎসক, নার্স, সাংবাদিক, সেবা সংস্থার প্রতিনিধি ও দু-একজন সবজি বিক্রেতা ছাড়া কাউকেই বের হতে দেওয়া হয়নি। কাউকে ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। পেশাগত দায়িত্বপালনকরী গণমাধ্যম কর্মীদেরও ফটক পর্যন্ত গিয়েই থামতে হয়েছে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে লকডাউন শুরু হওয়া পূর্ব রাজাবাজারের গতকালের চিত্র ছিল এমনই। পাড়ার ভেতরে কিছু স্বেচ্ছাসেবী ও পুলিশ সদস্য যাতায়াত করেছেন। ভেতরে কোনো দোকানপাটও খুলতে দেওয়া হয়নি। যাতায়াত খুবই সীমিত রাখা হয়। তবে এই লকডাউনে বিপাকে পড়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবীরা। তারা বলছেন, বর্তমানে কোনো সাধারণ ছুটি নেই। এভাবে টানা ১৪ দিন বা ২১ দিন লকডাউন থাকলে কোম্পানি তাকে চাকরিতে রাখবে না। কারণ গত কয়েক মাসের লকডাউনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এমনিতেই অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তার ওপর আবার লকডাউন চললে তাদের চাকরিচ্যুত করতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একটি বায়িং হাউসের মার্চেন্ডাইজার ও পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা সমকালকে বলেন, করোনার কারণে তার মালিককে অনেক লোকসান গুনতে হয়েছে। গতকাল সকালে তিনি বের হওয়ার চেষ্টা করেন। পূর্ব রাজাবাজারে ঢোকা ও প্রবেশের আটটি গেটেই যান। কোনো গেট দিয়েই তিনি বের হতে পারেননি। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীদের অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কাজ হয়নি। অথচ অফিসে পৌঁছাননি দেখে তাকে অফিস থেকে বারবার ফোন করা হয়েছে।
পূর্ব রাজাবাজারে বসবাসকারী অনেক ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবীর অনেকেই তাদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। আটটি গেটের মধ্যে একমাত্র গ্রিন রোডের আইবিএ হোস্টেল সংলগ্ন ফটকটি (নাজনিন স্কুল গেট হিসেবে পরিচিত) খোলা রাখা হয়। লকডাউন শুরুর পর থেকেই সেখানে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নেন। দু'পাশে চেয়ার-বেঞ্চ পেতে বসে থাকেন। অন্য গেটগুলোতেও ছিল ব্যারিকেড দেওয়া। বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারা। পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দাদের অভিযোগ, লকডাউনের আগে স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের একটি তালিকা করা হয়েছে। লকডাউনের মধ্যে ওইসব মানুষের যদি খাবার কষ্ট হয়, তাহলে খাবার সরবরাহ করা হবে। কিন্তু অনেকের নামই তালিকায় ওঠেনি। এ ছাড়া টানা ১৪ দিন বেকার থাকলে আরও অনেকেরই ঘরে চাল কেনার পয়সা থাকবে না। তাদের কী হবে? সিটি করপোরেশন কি তাদের খাবার সরবরাহ করবে?
গতকাল লকডাউনের প্রথম দিনে তেমন খাবার সরবরাহ করা লাগেনি। কারণ আগে মাইকিং করার কারণে সবাই সাধ্যমতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে রাখেন। স্থানীয় কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান সমকালকে বলেন, এখানে সরকারের সম্পূর্ণ নির্দেশনা অনুসরণ করে লকডাউন পালন করা হচ্ছে। কারণ আমরা এখন প্রান্তসীমায় চলে এসেছি। এখন এ ছাড়া কিছু করার নেই। তবে প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খাবারের সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, চাকরিজীবীসহ অনেকেরই বাইরে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাদের বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঙ্গে কথা বলব। একটা উপায় বের করতে হবে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দাদের এই লকডাউনের মধ্যে কর্মস্থলে যেতে বলছে, তারা কি জানে না সরকারি সিদ্ধান্তে এই লকডাউন চলছে?
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিন দেখা যায়, গ্রিন রোড সংলগ্ন গেটটির ভেতরের রাস্তার দু'পাশে পুলিশ সদস্যরা বসে আছেন। ফটকের সামনের রাস্তায় গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। দু-একজন উৎসুক জনতাও পথ চলতে গিয়ে একটু উঁকি দিচ্ছে। কেউ ঢুকতে বা বেরোতে চাইলেই পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে বেরোতে দিচ্ছেন বা ফিরিয়ে দিচ্ছেন। ফটকের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে প্রবেশ নিষেধ সংবলিত সাইন বোর্ড টাঙানো হয়েছে। সেখানে লকডাউনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি সাইন বোর্ডে স্থানীয় কাউন্সিলর, পুলিশসহ সংশ্নিষ্টদের ফোন নম্বর সংবলিত একটি ব্যানার টানানো হয়েছে। লকডাউনে থাকা বাসিন্দাদের যে কোনো প্রয়োজনে ওইসব ফোন নম্বরে সহযোগিতা চাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, ইন্দিরা রোডের বৈশাখী হোটেল গলি বাঁশ দিয়ে আটকে দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন আছে। সকালের দিকে এ গলি দিয়ে নানা অজুহাতে কিছু লোক বের হওয়ার চেষ্টা করেন। তবে পুলিশ ফেরত পাঠিয়ে দেয়। অন্য ছয়টি গলির মুখে শুধু বাঁশ দিয়ে আটকানো কিংবা যেখানে আগে থেকেই লোহার গেট রয়েছে, সেই গেটে তালা লাগানো বা দড়ি দিয়ে বাঁধা। সকালে সব প্রবেশপথেই বের হওয়ার জন্য মানুষের ভিড় জমে যায়। তাদের সবাইকে বাসায় ফেরত পাঠানো হয়। শুধু স্বাস্থ্যসেবা কাজে সংশ্নিষ্ট এবং গণমাধ্যমকর্মীদের বের হতে দেওয়া হয়।
শেরেবাংলা নগর থানার ওসি জানে আলম মুনশি সমকালকে বলেন, লকডাউন কার্যকর করতে পূর্ব রাজাবাজারের ভেতরে তিনটি পায়ে হাঁটা ও দুটি মোটরসাইকেল টহল দল সার্বক্ষণিক রাখা হয়েছে। অলিগলিতে যাতে কেউ আড্ডা দিতে না পারে এবং দোকানপাট খুলতে না পারে, তাও নিশ্চিত করছে ওই টহল দল। চারপাশের সড়কেও টহল দল রয়েছে। আটটি প্রবেশপথের মধ্যে দুটিতে পুলিশ সার্বক্ষণিক অবস্থান করছে। অন্যগুলোর সামনে টহল দিচ্ছে।
স্বেচ্ছাসেবী রাকিবুল ইসলাম বলেন, মহল্লার মানুষের জরুরি কিছু প্রয়োজন হলে ফোন করছে এবং প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভেতরে কাউন্সিলরের পক্ষ থেকে কয়েকটি রিকশা রাখা হয়েছে। খুব জরুরি প্রয়োজনে রিকশায় মানুষ যাতায়াত করতে পারবে।
দুপুর সোয়া ১টায় সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় গলিতে দেখা যায়, গেটের বাইরে একজন চাল, ডাল, ডিম ও আলু নিয়ে অপেক্ষা করছেন। সাইদুল নামের ওই যুবক জানালেন, ওইসব জিনিসপত্র তার দু'জন আত্মীয়কে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসেছেন।
লকডাউন শুরু হয়নি ওয়ারীতে :কয়েক দিন ধরেই আলোচনায় ছিল করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ারীতেও লকডাউন শুরু হবে। তবে গতকাল পর্যন্ত তা শুরু হয়নি। পুলিশের ওয়ারী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার হান্নানুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে তার কাছে কোনো নির্দেশনাও আসেনি। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী বলেন, তার এলাকায় লকডাউন শুরুর বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com