উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি

'ভালো' কলেজের বিকল্প

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর থেকে ভালো কলেজে ভর্তি নিয়ে সদ্য উত্তীর্ণদের দুশ্চিন্তার কথা উল্লেখ করে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সংবাদ ছাপা অব্যাহত থাকার পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের এ লেখা।

দেখা যাচ্ছে, কলেজে ভর্তি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে সদ্য এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক উভয়ের মধ্যে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ধারণা, ভালো কলেজে ভর্তি হলে পরে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশেও তা কাজে আসবে। কিন্তু সারাদেশে ভালোমানের কলেজ হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক লাখের মতো আসন থাকলেও এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৯৮ জন। অর্থাৎ জিপিএ ৫ পেয়েও অনেকে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবে না। সে জন্য ভালো বা সেরা কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দুশ্চিন্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ভালোমানের কলেজের চেয়ে বাড়ির কাছের কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কোনো কোনো কলেজ অধ্যক্ষ। এখানে বলা দরকার, অনেকে মফস্বলে না হয়ে রাজধানী বা বিভাগীয় শহরের কলেজগুলোতে ভর্তি হতে চায়। কিছুদিনের জন্য মেস ভাড়া করে থাকে। আমার বাসা ঢাকার ফার্মগেট এলাকায়। আমাদের শিক্ষাবিদ ও নীতি-নির্ধারকরা সঙ্গত কারণেই প্রচলিত কোচিংকে বহুদিন ধরে নিছক বাণিজ্যিক উপাদান হিসেবে উল্লেখ করে একে ক্ষতিকর বলে এলেও বাস্তবতা হলো শুধু শিক্ষার্থী নয়, তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকরা কাম্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোচিং সেন্টারগুলোর দ্বারস্থ হতে দ্বিধা করছেন না।

ফার্মগেট এলাকায় এখানে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোচিং সেন্টার। এসব কোচিং সেন্টারে 'পড়ার জন্য' আশপাশের বাসায় ভাড়া নিয়ে থাকে অনেক ছেলেমেয়ে বিশেষ করে পরীক্ষার পাসের ফল বের হওয়ার পর এবং ভর্তির আগে। এদের কারণে এখানে বাসা ভাড়া যেমন বেশি, অনেক সময় রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলাও কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতে, ভর্তির ক্ষেত্রে সমস্যা হলো ভালো কলেজগুলোতে আসন কম। কিন্তু অনেকেই শুধু ভালো কলেজগুলোতে ভর্তির পছন্দ দেয়। কিন্তু এসএসসির ফল ও পছন্দের কলেজে আসনের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় অনেকে ভর্তি হতে না পেরে হতাশায় ভোগে। তাদের উচিত কলেজ পছন্দের ক্ষেত্রে নিজের এসএসসি ও সমমানের ফল এবং কলেজের আসন সংখ্যা দেখে পছন্দক্রম তৈরি করা।

ভালো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল অথবা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে শিক্ষার্থীকে কতটা সহায়তা করে অথবা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পর সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে, আত্মকর্মসংস্থানে ও শিল্প-বাণিজ্য উদ্যোক্তা হতে কতটা সহায়তা করে, তার ওপর বিশেষ কোনো জরিপ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এ লেখার মূল উদ্দেশ্য 'ভালো প্রতিষ্ঠান'-এর সংকট উত্তরণে সাময়িক হলেও কিছু বিকল্প নিয়ে ভাবনা তুলে ধরা। আমরা জানি, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ধারণার মধ্যে রয়েছে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের পাঠদান ও প্রতিষ্ঠানে অনুকূল পরিবেশ বা সুব্যবস্থাপনা। বর্তমানে এসএসসির ফলাফলে বলা যায় দক্ষ অঙ্ক, বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছে। অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অবসর গ্রহণ ও শিক্ষকদের পেশা ত্যাগও এর একটা কারণ। এ সমস্যার সাময়িক সমাধান কি হতে পারে?

প্রথমত, বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকদের পালাক্রমে এলাকাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ, শিক্ষক নিজের প্রতিষ্ঠানে যেমন পড়াবেন, সে সঙ্গে এলাকার আশপাশে নির্ধারিত একটি প্রতিষ্ঠানেও নির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নেবেন। ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকও একই বিষয়ে তার স্কুলে এসে পড়াবেন। এতে দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দু'জন শিক্ষকের পাঠদানে তারতম্য বুঝতে পারবেন। এটা অনেকটা বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্রচলিত কো-টিচিং বা একই ক্লাসে দু'জন শিক্ষকের পাঠদানের অনুরূপ। কো-টিচিংয়ে অবশ্য এক শিক্ষক পড়ান আর অন্য শিক্ষক খেয়াল রাখেন তিনি কেমন পড়াচ্ছেন ও শিক্ষার্থীরা তা কীভাবে নিচ্ছে। আবার পর্যবেক্ষক শিক্ষক ও পাঠদানকারী শিক্ষক উভয়ের পালাক্রমে পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঠদানে এ বিনিময় প্রথা অথবা এক প্রতিষ্ঠানেই এক ক্লাসে দুই শিক্ষকের পালাক্রমে পাঠদান দুটিই বৈচিত্র্য আনতে পারে ও এতে ভালো ফল দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানে দক্ষ এবং যোগ্য হিসেবে পরিচিত এবং যারা কর্মক্ষম তাদের একটা প্যানেল তৈরি করে তাদের দিয়ে পালাক্রমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ানোর কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ও সংশ্নিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের নিয়ে একটি ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক টিম গঠন করা যেতে পারে। যারা চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে নিয়োজিত থাকবেন।

উপরোক্ত প্রস্তাবগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন। প্রয়োজনে এর ওপর তথ্য সংগ্রহ বা জরিপ করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এসব পদক্ষেপ সাময়িক উপশম আসবে। চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হবে বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষার পূর্ব পর্যন্ত এলাকাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ভর্তি হওয়া। সব প্রতিষ্ঠান কোনো সময় একই মানের হতে পারে না অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান চিরস্থায়ীভাবে একই মান ধরে রাখতে পারে না। তবে কিছু সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া হলে প্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দের ব্যবধান অনেকটা কমে আসবে বা একটা ভারসাম্য আসবে।

শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক
prof.qfahmed@gmail.com

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com