রাজনীতি

আলি কেনানরা যুগে যুগে

প্রকাশ: ২১ জুন ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ২১ জুন ২০ । ০২:২৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

মহিউদ্দিন খান মোহন

প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক আহমদ ছফার একটি উপন্যাসের নাম 'একজন আলি কেনানের উত্থান পতন'। উপন্যাসটিতে তিনি স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের একজন আলি কেনানের চরিত্র অঙ্কন করেছেন, যে ঘটনাচক্রে প্রবল পরাক্রমশালী একজন রাজনীতিকের ছত্রছায়ায় থেকে নিজেও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল।

উনসত্তরের আগের বছরের ঘটনা। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গেছেন দ্বীপশহর ভোলা সফরে। কিন্তু এলাকার জনসাধারণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তিনি লঞ্চ থেকে নামতে পারছিলেন না। শেষে লঞ্চ থেকে নৌকায় নেমে ঘাটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। জনতার আক্রমণে সে নৌকা ডুুবে যায়। সে সময় নদীতে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত আলি কেনান ও তার ভাইয়েরা গভর্নরকে উদ্ধার করে তীরে এনে পুলিশের হেফাজতে দিয়ে দেয়। আলি কেনান ছিল এলাকার বিখ্যাত লাঠিয়াল ও দাঙ্গাবাজ। স্বল্প শিক্ষিত আলি কেনানের ছিল প্রচণ্ড সাহস। আর সে সাহসের বলেই সে গভর্নরকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। আলি কেনানের সাহসিকতায় মুগ্ধ গভর্নর তাকে সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং নিজের খাস পিয়নের পদে নিয়োগ দেন। পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির খাস লোক হয়ে আলি কেনান হয়ে ওঠে অতিশয় ক্ষমতাধর। কাউকে তোয়াক্কা না করার একটি মানসিকতা তাকে ঘোরতরভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার অনুমতি ছাড়া কেউ গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে পারে না, সে লাইন না দিলে গভর্নরের সঙ্গে কেউ টেলিফোনে কথা বলতে পারে না।

মন্ত্রীরা আলি কেনানের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। কেউ কেউ তোয়াজও করেন। গভর্নর হাউসের প্রভাব খাটিয়ে সে জেলা প্রশাসক, এসডিও, সিও, ওসি সবাইকে তার হুকুমবরদারে পরিণত করে। আর সে প্রভাব খাটিয়ে এলাকার খাস জমি, জলমহাল, হাটবাজারসহ প্রায় সবকিছু তার ভাই-বেরাদারের নামে ইজারা নিয়ে নেয়। কিন্তু একদিন ঘটে বিপত্তি। দুপুরে লাঞ্চ সেরে গভর্নর সাহেব বিশ্রাম করছিলেন। এ সময় কেন্দ্রীয় রাজধানী থেকে প্রেসিডেন্টের পিএস গভর্নরের পিএসকে ফোন করে জানান, প্রেসিডেন্ট গভর্নরের সঙ্গে জরুরি কথা বলবেন। পিএস আলি কেনানকে তা জানালে সে বলে এখন স্যার বিশ্রামে আছেন, ফোন দেওয়া যাবে না। একপর্যায়ে পিএস গভর্নরের কামরায় ঢুকে প্রেসিডেন্টের ফোনের কথা জানালে লাইন দিতে দেরি হলো কেন তিনি তা জানতে চান। পিএস যখন জানাল আলি কেনান লাইন দিতে রাজি হয়নি, তখন গভর্নর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গভর্নর হাউসের বাইরে ফেলে দিয়ে আসার নির্দেশ দেন। হঠাৎ এ ভাগ্য বিপর্যয়ে আলি কেনান দিশেহারা হয়ে গেল। তার অবস্থা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- 'প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো' হয়ে উঠল।

আলি কেনান তার জন্মস্থানে ফিরে গেল না। ভিক্ষা করতে গিয়ে সে নতুন পথের সন্ধান পেল। সে হয়ে গেল আধ্যাত্মিক পীর। এরপর আহমদ ছফা আলি কেনানের পীরত্ব, তার মাজার দখল, মানুষকে সম্মোহিত করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়াসহ নানা কাহিনি বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসে আলি কেনানের শেষ পরিণতি ভালো হয়নি। যখন তার সব শেষ তখন সে ভোলায় ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু তখন তার পকেটে ভোলা যাওয়ার লঞ্চ ভাড়ার টাকাও নেই।

আহমদ ছফার সৃষ্ট চরিত্র আলি কেনানরা মরে না। তারা যুগে যুগে নানাভাবে নানাবেশে আমাদের মাঝে ফিরে আসে। বিভিন্ন সময়ে এদের দেখা মেলে বিভিন্ন রূপে। এরা ক্ষমতাশালীদের আশপাশে থেকে নিজেরা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে এরা কাছাকাছি চলে যায়, তারপর হয়ে ওঠে আস্থাভাজন। অর্জন করে বিশ্বাস। তারপর অতি সন্তর্পণে সে বিশ্বাসের ঘরে করে ডাকাতি। আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় ক্ষমতাশালীদের কাছের লোকজনের প্রভাব আমজনতার ওপর প্রবল। আলি কেনানরা সে সুযোগটিই কাজে লাগায় অত্যন্ত সুকৌশলে। আমরা যদি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে দৃষ্টি ফেলি বা এর অতীত-বর্তমানের দিকে আলোকপাত করি, তাহলে দেখব আলি কেনানদের কমতি কখনোই ছিল না। এরা রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের কাছাকাছি থেকে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার মওকা সৃষ্টি করে নেয় চাতুর্যের সঙ্গেই।

মজার ব্যাপার হলো, আলি কেনানরা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় থেকে অকাম-কুকাম করে বেড়ালেও রহস্যজনক কারণে সে ব্যক্তি তা বুঝতে পারেন না, অথবা অজ্ঞাত কোনো কারণে তা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। আলি কেনানরা বোধকরি সম্মোহনী বিদ্যায় পারদর্শী। নাহলে ক্ষমতাধরদের আচ্ছন্ন করে রাখে কীভাবে? এসব আলি কেনানের উপদ্রবে সাচ্চা রাজনৈতিক কর্মীরা বিরক্ত-অতিষ্ঠ হলেও তারা কিছুই করতে পারে না। বরং আলি কেনানদের আধিক্য ও দৌরাত্ম্য এতটাই সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে যে, প্রকৃত কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

আমার এ নাতিদীর্ঘ জীবনে এ রকম বেশ কয়েকজন আলি কেনানের দেখা পেয়েছি; যারা শীর্ষ ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বগলছায়ায় থেকে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন চমৎকারভাবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ কার্যালয়ে বছর পাঁচেক কর্মবত থাকার সুবাদে এদের কাজকর্ম অনেকটা কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। এদের কেউ হয়েছেন কপর্দকহীন ভ্যাগাবন্ড থেকে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। ক্ষমতার সোনারকাঠির স্পর্শে তার সম্পদের পরিমাণ হয়ে উঠল পর্বতসম। তবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যখন ওই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি পড়লেন চরম বিপদে, এই আলি কেনান আর পিছু ফিরে দেখলেন না। কিছুদিন নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সবদিক সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন। গতিক সুবিধের নয় দেখে অবশেষে পাত্তারি গুটালেন। এক সময়ে যাকে তিনি জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন বলে প্রচার করতেন, তাকে ফেলে চলে গেলেন দেশত্যাগ করে। এখন তিনি সেখানে ভালোই আছেন।

আগেই বলেছি, পাঁচ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি থেকে এ রকম অনেক আলি কেনানের দেখা পেয়েছি। এদের একেক জনের চরিত্র একেক রকম। কিন্তু একটি জায়গায় মিল অপূর্ব। তা হলো ব্যক্তিগত স্বার্থ। ওই সময় যত আলি কেনানদের দেখেছি, তাদের সবার বিবরণ দিতে গেলে নিবন্ধ নয়, পুস্তক রচনা করতে হবে। সংক্ষেপে বলি, তাদের কেউ প্রশাসনে, কেউ সিনেমা জগতে, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার-অপব্যবহার করে আঙুল ফুলে বটগাছ হয়ে গিয়েছিল। স্রোত যখন উল্টো দিক থেকে বইতে শুরু করল, তখন তারা কেউই আর দেশে থাকল না। কেউ চলে গেল লন্ডন, কেউ আমেরিকা, কেউ কানাডা, কেউ মালয়েশিয়া, কেউবা দুবাই। আলি কেনান সেজে তারা আখের গুছিয়ে নিল, তিনি জেলে পচলেন, কিন্তু তারা চলে গেল ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আলি কেনানরা এমনই হয়। এরা বসন্তের কোকিল হয়ে আসে, বসন্ত শেষ হয়ে গেলে চলে যায়। রাজনীতিতে এসব বসন্তের কোকিলরা কখনোই দল বা নেতার জন্য আশীর্বাদ হয়ে ওঠে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের 'কাউয়া তত্ত্ব' রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। মুখে মুখে ফিরেছে তার কাউয়া তত্ত্ব। তবে, আমার মনে হয়, তিনি সঠিক বলেননি। কোকিল নয়, রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলে কাউয়া বা কাকেরই গুরুত্ব পাওয়া উচিত। কারণ কাক সব ঋতুতেই থাকে। ঝড়ে থাকে, বৃষ্টিতে থাকে, খরায় থাকে, বন্যায় থাকে, চরম শৈত্যপ্রবাহেও তাকে দেখা যায়। কিন্তু বসন্ত ফুরিয়ে গেলে কোকিলকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, আরেকটি বসন্ত না আসা পর্যন্ত।

আলি কেনানরা বসন্তের কোকিল। বসন্তেই শুধু এদের দেখা মেলে। সুসময়ে এরা কুহু কুহু তানে ক্ষমতাশালীদের কানে মধুবর্ষণ করে তাদের বিমোহিত করে রাখে। এরই ফাঁকে আপন স্বার্থ হাসিল করে নেয় যতটুকু সম্ভব। বসন্ত চলে গেলে তারা হয়ে যায় নিরুদ্দেশ। আকাশে ডানা মেলে উড়ে যায় কোনো এক নিভৃত-নিরাপদ জঙ্গলে। এরা যুগে যুগে টিকে থাকে, কায়া বদলায়। একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে আসে। এরা সবসময় থাকে। চরিত্র একই, লেবাসটি পরিবর্তন হয়।

এ ধরনের কিছু আলি কেনানের সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি বছরখানেক আগেও। সরকারের অ্যাকশনে আলি কেনানদের চেহারা মোবারক দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। এদের কেউ ছিলেন অঘোষিত সাম্রাজ্যের 'সম্র্রাট', আবার কেউ নিজেকে বানিয়েছিলেন টেন্ডার জগতের 'মোগল'। করোনা আক্রান্ত এ সময়েও কি আমরা আলি কেনানদের দেখা পাইনি? সারাদেশে ত্রাণ আত্মসাৎ করেছে যারা, তারা কি একেকজন আলি কেনান নয়? আসলে আলি কেনানরা সবসময় সব সরকারের আমলেই ক্ষমতার ছাতার নিচে বিচরণ করে। যাদের ছত্রছায়ায় এরা থাকে, তারা এদের চিনতে পারেন না। আর চিনতে না পারাটাই তাদের জন্য হয়ে ওঠে দুর্ভাগ্যের কারণ। আমরা যতই বলি বা লিখি, আলি কেনানরা বিলুপ্ত হবে না। একদল গেলে আরেক দল আসবে। ওরা যুগে যুগে আসে, হয়তো আসতেই থাকবে।

সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com