সমকালীন প্রসঙ্গ

বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি : এক যাত্রায় দুই ফল?

প্রকাশ: ২২ জুন ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ২২ জুন ২০ । ০২:৪৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ

শিক্ষা খাতে বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিদায়ী অর্থবছরে এই দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে ছিল ৬১ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। একই সঙ্গে এবারের বাজেটে করোনাভাইরাসজনিত ছুটির ক্ষতি পুষিয়ে পাঠ্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষার উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের কারণে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। এতে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় (দুই বিভাগ) মিলিয়ে শিক্ষা খাতে মোট ৬৬ হাজার ৪০১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষায় প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, 'অচিরেই সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুটি করে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হবে।' মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার কথা বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'শিক্ষার উন্নয়নকে বেগবান করতে আমরা এখন জোর দিচ্ছি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও উচ্চশিক্ষায় গবেষণার ওপর।' মেধাবৃত্তি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, পাবলিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এরই মধ্যে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষার্থীকে মেধাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আরও এক লাখ ৮৭ হাজার শিক্ষার্থীকে মেধাবৃত্তি দেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও শিক্ষাব্যবস্থায় লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সকল উন্নতশীল দেশের রোল মডেল। সরকার ইতোমধ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ভবন ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ শ্রেণিকক্ষ স্থাপন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ, বেসরকারি স্কুল সরকারীকরণ, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, আইসিটি বিষয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

এদিকে কভিড-১৯-এর সময় টেলিভিশনে লেখাপড়ার কিছু কর্মসূচি চালু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়োজিত রাখার একটা চেষ্টা করা হয়েছে, যাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। করোনায় পড়াশোনা নিয়ে বিপাকে পড়া প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশন ও বেতারে পাঠদানের পর এবার চালু করা হচ্ছে বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর- ৩৩৩৬। যে কোনো মুঠোফোন অপারেটর থেকে এ নম্বরে ডায়াল করলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে তার নিজ শ্রেণির পাঠদান পরামর্শ পাবে। পাঁচ মিনিট পর্যন্ত কলটি হবে টোল ফ্রি। সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এই হেল্পলাইন নম্বরে যুক্ত থাকবেন। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে এ ধরনের উদ্যোগ এবারই প্রথম। চলতি জুনেই এ কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হবে। উদ্যোগটি সফল হলে তা কোচিং সেন্টারের বিকল্প হবে বলে মনে করছেন প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্নিষ্টরা। সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের সম্মিলিত উদ্যোগে এ কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য এ ভালো খবরের সঙ্গে একটি আপাত দুঃসংবাদ আছে। জানা গেছে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের 'স্কুল মিল কর্মসূচি'র কার্যক্রম বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেছে। ১১ জুন ঘোষিত বাজেটে সাড়ে ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য সংস্থান রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে মাত্র ১৬টি উপজেলায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। ফলে বাকি উপজেলার শিক্ষার্থীদের আগের মতোই বিস্কুট খেতে হবে। স্কুল মিল প্রকল্প প্রস্তাবনা (পিপি) চূড়ান্ত না হওয়ায় সরকার সার্বিকভাবে সংশ্নিষ্ট উপজেলায় স্কুল মিল কর্মসূচি চালু করতে পারেনি। জানা গেছে, পিপিতে তিন ধাপে স্কুল মিল কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুপারিশ আছে। প্রথম ধাপে ২৫০টি উপজেলায় এটি বাস্তবায়ন করা হবে। পরে ৩৫০টি এবং শেষ ধাপে ৫০১টি উপজেলায় রান্না করা খাবার দেওয়া হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ ধাপ বাস্তবায়ন করা হবে। জানা যায়, স্কুল মিল কর্মসূচির অধীনে স্কুলে শিক্ষার্থীদের একবেলা রান্না করা খাবার খাওয়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। স্কুলে শিশুদের আকৃষ্ট করা, ধরে রাখা, ঝরে পড়া হ্রাস এবং পুষ্টি ও খাদ্যের শক্তি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এ কর্মসূচি নেওয়া হয়। ১০৪ উপজেলার মধ্যে ৮৭ উপজেলার স্কুলে বর্তমানে বিস্কুট কর্মসূচি চালু আছে। কিন্তু বিস্কুটের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনীহা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি ঝরে পড়ার হারও বাড়ছিল। ফলে ব্যাহত হচ্ছিল স্কুলে খাবার দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা। এমন পরিস্থিতিতে স্কুলে রান্না করা খাবার পরিবেশনের জন্য দাতা সংস্থাগুলো থেকে সুপারিশ আসে। এ নিয়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) তিনটি উপজেলায় রান্না করা খাবার পরিবেশনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে। এতে ইতিবাচক ফল মেলে। এরপরই সরকার ১৬টি উপজেলায় এ কর্মসূচির পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করে। পাশাপাশি তৈরি করে নীতিমালা। ১৯ আগস্ট মন্ত্রিসভায় সেটি অনুমোদন পায়। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর থেকে ১৭টি উপজেলায় রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একটি পরিচালনা করছে ডব্লিউএফপি। বাকিগুলো সরকার পরিচালনা করছে।

অন্যদিকে বাজেট পাস হওয়ার আগেই প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপনের দিন থেকে গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা কাটা শুরু করেছে দেশের মোবাইল অপারেটররা। প্রস্তাবিত বাজেটে, মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে বাজেট পাস হওয়ার আগেই মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস পাঠানো এবং ডেটা ব্যবহারের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ যেন এক যাত্রায় দুই ফল। বাজেটে বরাদ্দ নেই তাই শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাজেট পাসের জন্য অপেক্ষা না করেই ১১ জুন মধ্যরাত থেকেই বাড়তি হারে সম্পূরক শুল্ক্ক কাটা শুরু হয়েছে।

পরিশেষে, একটি মানবিক দিকে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বেসরকারি স্কুল-কলেজে, অনার্স-মাস্টার্স কলেজে যাদের এমপিও নেই, তাদের কথা বাজেটে নির্দিষ্টভাবে আসেনি। মানবিক দিক বিবেচনা করে বাজেট পাসের সময় এ বিষয়টি স্পষ্ট করলে ভালো হয় যে, যোগ্য প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের এমপিওতে অন্তর্ভুক্ত করার নীতি বহাল থাকবে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ইতোমধ্যে এ বিষয়ে ইতিবাচক কথা বলেছেন। তারপরও অর্থমন্ত্রী বাজেট পাসের সময় তা স্পষ্ট করতে পারেন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, টেলিভিশনে যারা পাঠদান করছেন, ডিজিটাল কনটেন্ট যারা তৈরি করেছেন তাদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। বাজেটে তার উল্লেখ চোখে পড়েনি। একটা বিষয় আমাকে হতাশ করেছে, সেটা হলো ইন্টানেটের রাউটারের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রস্তাব। মোবাইলে ৫ শতাংশ সারচার্জ বৃদ্ধিও পুনর্বিবেচনাযোগ্য না হলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত মোবাইলে শিশু-শিক্ষার্থীদের পাঠদান কর্মসূচি মারাত্মক হোঁচট খাবে। তা ছাড়া বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মোবাইল কোম্পানিগুলোর তো সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। গ্রাহকের ওপর তার বোঝা আরোপ কেন?

শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com