করোনায় সার্কের পুনর্জন্ম সম্ভব?

দক্ষিণ এশিয়া

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মো. শফিকুল ইসলাম

দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশ নিয়ে আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থে সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক মতবিরোধ সার্ককে অনেকটাই অকার্যকর করে তোলে। সন্ত্রাসবাদের কারণে ক্রমেই সার্ক অর্থহীন হয়ে পড়ে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে ১৮তম সার্ক সম্মেলন হয়। উরি হামলার পর ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও পরে সেটি বয়কট করে ভারত। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভুটান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ সম্মেলন বয়কট করে। তখন থেকে সার্কের কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি।

দীর্ঘ বিরতির পর গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কৌশল ঠিক করতে সার্কভুক্ত দেশের নেতাদের ভিডিও কনফারেন্সে সভা আহ্বান করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সার্কভুক্ত অন্য দেশের নেতারা নরেন্দ্র মোদির প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে সম্মতি প্রদান করেন। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে কি সার্কের পুনর্জন্ম হলো? ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি এবং পাকিস্তানের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. জাফর মির্জা নিজ নিজ দেশের পক্ষে অংশগ্রহণ করেন।

বিশ্বে করোনা আতঙ্ক চলমান এবং এর প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন সার্কভুক্ত দেশের সরকার প্রধানরা। মহামারি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সার্কভুক্ত দেশগুলোকে লড়াই করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি 'শক্তিশালী কৌশল' তৈরি এবং নিবিড়ভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার আহ্বান জানান। ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেন, সার্কভুক্ত দেশগুলোকে সম্মিলিতভাবে এই মহামারি মোকাবিলা করতে হবে। করোনাসহ ভবিষ্যতে যে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য একটি ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রস্তাবও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবাই সম্মত হলে বাংলাদেশ এ পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী বলেও ঘোষণা দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ তার সক্ষমতা ও দক্ষতা ভাগাভাগি করে নিতে ইচ্ছুক, পাশাপাশি প্রয়োজনে যৌক্তিক সহায়তা প্রদানসহ সার্কের দেশগুলোর সঙ্গে সর্বোত্তম আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্যও প্রস্তুত রয়েছে।

সার্ক রাষ্ট্রগুলোর জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ৯টি প্রস্তাব দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর প্রথমটি হলো, কভিড-১৯ মোকাবিলায় সার্ক তহবিল গঠনের প্রস্তাব। 'কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি ফান্ড' গঠনে প্রাথমিকভাবে ভারত এক কোটি ডলার দিয়ে এ তহবিলের সূচনা করার প্রস্তাবও দেন তিনি। সার্কভুক্ত দেশের পররাষ্ট্র সচিবরা এই প্রস্তাব ও তহবিল পরিচালনার নীতি চূড়ান্ত করবেন। এটি একটি ভালো উদ্যোগ; কিন্তু এখন তা বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরি। এসব আলোচনা থেকে বুঝতে পারি একটি সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সব দেশই একমত যা করোনা মোকাবিলা করতে সহায়ক এবং কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

মার্চ মাসে ওই আলোচনার পর গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে কতটা অগ্রগতি হয়েছে জানা নেই। বরং সীমান্ত ও চীন ইস্যুতে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব তৈরি হতে দেখা গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন, তা আগেই বলেছি। ফলে এটা আশা করা কঠিন, কভিড ইস্যুতে সার্কের পুনরুজ্জীবন ঘটবে।

সার্ককে গতিশীল করার জন্য প্রথমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু রজনৈতিক সেতুবন্ধ তৈরি করতে হবে এবং অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সুসম্পর্ককে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ এই সার্কভুক্ত অঞ্চলে মোট বৈদেশিক বাণিজ্যর মাত্র ৫ শতাংশ আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য হয়ে থাকে যেখানে আসিয়ানভুক্ত দেশে ২৫ শতাংশ আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য হয়। সার্কভুক্ত দেশে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং আস্থার অবনতির কারণে তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা অনুসারে, বিভিন্ন ধরনের আন্তঃকোন্দল যদি না থাকত, দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্যের আকার বর্তমানে যা আছে তার তিন গুণ করাও সম্ভব হতো। এ ছাড়াও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাকে (সার্ক) আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন বিশ্নেষক ও ব্যবসায়ীরা। সার্কের শীর্ষ সংস্থা সার্ক সিসিআই এই অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক ও আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। পর্যটন, শিক্ষা এবং জ্বালানি খাতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া জরুরি প্রয়োজন।

আসলে সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে টেকসই বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যে চুক্তি ছাড়া এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সম্ভব নয়। সার্ককে গতিশীল করতে হলে সব দেশের নেতাকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে যে কোনো সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং রাজনেতিক ঐক্য বৃদ্ধি করে এই দুঃসময় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
shafiquejkkniu@gmail.com

শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com