উদ্বোধনের আগেই বেদখল

চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী ফৌজদারহাট সড়কে মাসে অর্ধকোটি টাকার চাঁদাবাজি

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০ । ০৪:৫৬ | প্রিন্ট সংস্করণ

আবদুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন বায়েজিদ বোস্তামী ফৌজদারহাট সড়কটি উদ্বোধনের আগেই দখল করে নিয়েছে চাঁদাবাজরা। টাকার বিনিময়ে বসানো হয়েছে বাজার, দোকান ও অটোরিকশা স্ট্যান্ড। বাংলাবাজার মোড় এলাকার ছবি- মো. রাশেদ

চট্টগ্রাম নগরের যানজট নিরসনে নির্মাণাধীন রয়েছে বায়েজিদ বোস্তামী-ফৌজদারহাট সড়ক। সড়কটির কাজ শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে গাড়ি চলাচল। তবে উদ্বোধনের আগেই সড়কটির একাংশ দখল করে নিয়েছে চাঁদাবাজরা। নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়ে সড়কটির প্রবেশ পথেই বসানো হয়েছে বাজার, দোকান, রিকশা গ্যারেজ ও অটোরিকশা স্ট্যান্ড। সড়কটির বাংলাবাজার মোড় ঘিরে প্রতিমাসে চলে অর্ধকোটি টাকার চাঁদাবাজি। সড়ক দখলমুক্ত করা নিয়ে চলে চোর-পুলিশ খেলা। ঘটে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হামলা ও খুনের ঘটনাও। প্রতিবার উচ্ছেদে শুধু দখল হাতবদল হয়, দখলমুক্ত হয় না সড়ক। উদ্বোধনের আগেই দখল হয়ে গেলে যে লক্ষ্যে সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে, তা পূরণ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগে চাঁদা নিত স্থানীয় সন্ত্রাসী জসিম ওরফে পানি জসিম। সে দিদার-মহিউদ্দিন গ্রুপের হয়ে চাঁদাবাজি করত। এখন চাঁদা তোলে মানিক ও জিয়া নামের দুই যুবক। তাদের কাছ থেকে টাকার ভাগ চলে যায় বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশের 'ক্যাশিয়ার' হিসেবে পরিচিত মো. আকাশের কাছে। তার মাধ্যমে চলে দখল-উচ্ছেদের চোর-পুলিশ খেলা। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) মো. আশিকুর রহমান সমকালকে বলেন, 'সড়কে বাজার বসানোর কোনো সুযোগ নেই। কারও বিরুদ্ধে চাঁদার মাধ্যমে বাজার বসানোর অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সড়ক থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।'

সরেজমিন দেখা গেছে, বায়েজিদ বোস্তামী-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কের প্রবেশমুখ বাংলাবাজার এলাকা সড়কটির একাংশ বন্ধ করে ভাসমান বাজার বসানো হয়েছে। অন্তত ২৫০টি ভ্যান রয়েছে এখানে। প্রতিটি ভ্যান বসানোর বিনিময়ে দুই হাজার টাকা করে এককালীন নেওয়া হয়। প্রতিদিন নেওয়া হয় ৬০ টাকা করে। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চার লেন সড়কের দুই লেন থাকে ভাসমান ব্যবসায়ীদের দখলে। এ ছাড়া সড়কের পাশে আটটি রিকশা গ্যারেজ, তিনটি লাকড়ির দোকান, ১০টি চা দোকান, দুটি মোবাইল ফোন রিচার্জের দোকান ও একটি ইট-বালু বিক্রির দোকান বসানো হয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত প্রতিমাসে নেওয়া হয়। সড়কের একাংশ দখল করে রাখা হয় গ্যারেজের সারি সারি রিকশা। এ ছাড়া রয়েছে অটোরিকশা স্ট্যান্ডও। সড়কের দু'পাশে সারি সারি করে রাখা থাকে শতাধিক অটোরিকশা। এখান থেকে প্রতিমাসে নেওয়া হয় অর্ধলাখ টাকা। এ ছাড়া বাংলাবাজারের মাছের দোকান থেকেও দৈনিক ১০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা তোলে মানিক ও জিয়া নামের দুই যুবক। বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশের 'ক্যাশিয়ার' হিসেবে পরিচিত আকাশ এসব দেখভাল করে। তার মাধ্যমে রাঘববোয়ালদের হাতে চাঁদার ভাগ চলে যায়।

পরিচয় গোপন রেখে ভ্যান বসাতে কী করতে হবে জানতে চাইলে মো. জিয়া বলে, 'সড়কে ভ্যান বসানোর বিষয়টি দেখেন মানিক ভাই। ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।' মো. মানিকের কাছে জানতে চাইলে সে বলে, 'এসে দেখা করেন। এসব বিষয়ে ফোনে নয়, সরাসরি কথা বলব। আগে জায়গা খালি আছে কিনা দেখতে হবে। খালি থাকলে ভ্যান বসাতে পারবেন।' চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে মো. আকাশ। তিনি প্রথমে জিয়া ও মানিককে চেনেন না বললেও পরে আবার মানিককে পুলিশের সোর্স হিসেবে চেনেন বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'ওসি স্যারের সঙ্গে প্রায় ১০-১২ বছরের পরিচয়। স্যারের বাসায় বাজার-সদাই করে দেয়। বিষয়টি অনেকে ভালো চোখে দেখেন না। তাই অনেকে অপপ্রচার চালান। আমার বাসা থানার পাশে। এখান থেকে বাংলাবাজার অনেক দূরে। ওখানকার কাউকে আমি চিনিও না।'

এ প্রসঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি প্রিটন সরকার সমকালকে বলেন, 'বাংলাবাজার মোড় থেকে একাধিকবার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদ করে পুলিশ চলে এলেই তারা আবার বসে যায়। বাজার যাতে আর বসতে না পারে এ জন্য নিয়মিত ফোর্স মোতায়েন করা হবে। কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হবে।' আকাশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'থানার অফিসারদের বাজার-সদাই করে দেয় আকাশ। এ ধরনের কোনো কিছুর সঙ্গে সে জড়িত নয়। থানায় কাজ করে এ জন্য হয়তো কেউ তার নাম ব্যবহার করছে।'

নগরের বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাইপাস সড়ক নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সড়কটির প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে সীমিত আকারে যান চলাচল শুরু হয়েছে। সড়কটির ফৌজদারহাট অংশে রেললাইনের ওপরে ওভারপাসটির কাজ শেষ হলে এটি যান চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ সমকালকে বলেন, 'সড়কটির প্রবেশ পথ থেকে একাধিকবার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। সড়কটির সীমানা নির্ধারণে জরিপ কাজ চলছে। জরিপ শেষে সীমানা পিলার বসানো হবে। এরপর সড়কের সীমানায় আর কাউকে বসতে দেওয়া হবে না।'

গত বছর ১৩ মে সড়কটির বাংলাবাজার মোড় থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। হামলায় আহত হন চার পুলিশ সদস্য। একই বছরের ৯ জুন ভ্রাম্যমাণ আদালতের হামলার নেতৃত্ব দেওয়া জসিম পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আহত হয়। একই এলাকায় দখল-বেদখলের ঘটনায় ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর খুন হন হকার্স লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রিপন। পরে ৩ জুন খুনে জড়িত মো. এমদাদ নামে এক যুবক পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com