আন্তর্জাতিক

আরব-ইসরায়েল শান্তিচুক্তির প্রহেলিকা 

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আবদুল লতিফ মাসুম

'লরেন্স অব অ্যারাবিয়া'র রোমাঞ্চকর গল্প সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। লরেন্স ছিলেন ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্নেল। ১৯১৪-১৮ সাল পর্যন্ত প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে অটোমান এম্পায়ার বা উসমানীয় সালতানাতের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহ পরিচালনা করে তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হন। আরব জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করে তিনি তুর্কি প্যান ইসলামিজম বা ইসলামি খেলাফত ধ্বংস করতে সক্ষম হন। আরবের ভাষা, আরবের আশা, আরবের ধর্ম ধারণ করে তিনি আরবেরই সর্বনাশ সাধন করেছেন। এই বিরাট কাজের জন্য ব্রিটিশরাজ তাকে ইতিহাসে স্থান দিয়েছে। প্রবল প্রতাপশালী উসমানীয় সালতানাত ভেঙে তারা তৈরি করেছে অনেক আরব রাষ্ট্র। সুতরাং ভাগ করে শাসন করা তাদের জন্য সহজ হয়েছে। এ আরব দেশগুলোর ভাষা, ধর্ম, সমাজ ও অর্থনীতি প্রায় এক ও অভিন্ন। কিন্তু তারা পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত। অতীতেও ছিল, এখনও তাই আছে।

আরব বিশ্বে এমন সব ঘটনা ঘটছে যা স্বাভাবিক বলা কঠিন। সর্বশেষ ঘটনা হলো- ইসরায়েল-আরব আমিরাত চুক্তি। ১৩ আগস্ট আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সানন্দে এই বিরাট বিজয়ের কথা ঘোষণা করেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, চুক্তিটি যেখানে স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা সেখানে স্বাক্ষরিত হয়নি। হয়েছে সাত সমুদ্র তের নদীর পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এতে বোঝা যায়, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব তাদের। তাদেরই মধ্যস্ততায় স্বাক্ষরিত হয়েছে এ 'অধীনতামূলক মিত্রতা'। বিগত বছরগুলোতে ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে যে আগ্রাসী নীতি যুক্তরাষ্ট্র অনুসরণ করেছে তার প্রেক্ষাপট- ক. তেলআবিব থেকে রাজধানী জেরুজালেমে স্থানান্তরের স্বীকৃতি। খ. অধিকৃত গোলান মালভূমি ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। গ. তথাকথিত 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি'র মাধ্যমে জাতিসংঘ ঘোষিত দ্বিরাষ্ট্রিক নীতি অস্বীকারকরণ। সম্পাদিত চুক্তির পটভূমি হিসেবে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৪৮-২০২০ পর্যন্ত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ক্রমান্বয়ে সাধিত হয়েছে অধীনতামূলক মিত্রতার পরিধি। নীলনকশার গল্প আরও পুরোনো। প্রথম মহাযুদ্ধের মাঝখানে ১৯১৭ সালে ঘোষিত হয় 'বেলফোর ডিক্লারেশন'। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজিত উসমানীয় সালতানাত থেকে ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনের দখল নিয়ে নেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপনীতে ব্রিটিশদের পূর্ব ঘোষিত প্রতিশ্রুতির আলোকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ২৪২নং প্রস্তাব অনুযায়ী দুটি পৃথক- ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। পরাশক্তিগুলোর কেউই একটি পৃথক আরব রাষ্ট্র গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনি জনগণ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্র- সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, মিসর ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। একদিকে একক ইসরায়েল, অন্যদিকে সম্মিলিত আরব শক্তি। তবুও পরাজয় বরণ করতে হয় আরবদের। এর কারণ, ইসরায়েল তার অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছিল জানমাল সবকিছু দিয়ে।

আরবরা ইসরায়েলকে দুর্বল ভেবেছিল। রাশিয়াসহ সকল পরাশক্তি একাত্ম হয়ে এ যুদ্ধে ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের অস্তিত্বে দৃঢ় সংরক্ষক রূপে আবির্ভূত হয়। পর্যবেক্ষকরা ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম স্টেট বলে রসিকতা করেন। এভাবে বেড়ে যায় ইসরায়েলের সীমারেখা। সেই থেকে ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ এবং ১৯৮২ প্রতিটি যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে আরবরা। ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়েছে ইসরায়েলের আয়তন। আরব শাসকদের অনৈক্য ও বিশ্বাসঘাতকতাই ছিল এসব যুদ্ধে পরাজয়ের মূল কারণ। তাদের স্বার্থপরতা, শঠতা ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি কখনও। আজও ফিলিস্তিনি শক্তির মধ্যে রয়েছে বিভেদ। পশ্চিম তীর এখন 'ফাতাহ'-এর নিয়ন্ত্রণে। গাজা হামাসের নিয়ন্ত্রণে। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব প্রকট ও অনতিক্রম্য। অপরদিকে ইসরায়েল হয়ে উঠেছে দুর্দমনীয় শক্তি। শক্তি মদমত্ততায় শুধু পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহ নয় ইরাক ও আফ্রিকার লক্ষ্যগুলোতে আঘাত হেনেছে সে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ইসরায়েল এসব অন্যায় আক্রমণ করছে। অন্যদিকে শান্তি আলোচনার নামে সেই প্রথম থেকেই সময়ক্ষেপণ ও আরও শক্তি অর্জন করছে। বিগত সময়গুলোতে আজকের চুক্তির মতো আরও অনেক চুক্তি বিভিন্ন সময়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে এ ধরনের আরেকটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেখানেও অভিভাবকত্ব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অবকাশ কেন্দ্র 'ক্যাম্প ডেভিড'-এর নামে চুক্তিটি খ্যাত হয়। এ চুক্তির আওতায় মিসর স্বীকৃতি দেয় ইসরায়েলকে। ইসরায়েল সিনাইসহ গাজা প্রত্যর্পণ করে মিসরের কাছে।

১৯৯৩ সালে অযাচিতভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগঠন পিএলও এবং ইসরায়েলের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির ফলে তথাকথিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে নামমাত্র স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে পিএলওপ্রধান ইয়াসির আরাফাতকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ১৯৯৪ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির আদলে জর্ডানের সঙ্গে আরেকটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সময়ে তারা পশ্চিম তীর ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফিলিস্তিনি হামলার অজুহাতে ফের বসতি স্থাপন শুরু করে ইসরায়েলিরা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, এসব চুক্তিশান্তির গ্যারান্টি দেয়নি। বরং মৃত্যু ডেকে এনেছে দুই শান্তিবাদী প্রেসিডেন্টের জন্য। মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ১৯৭৯ সালে এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ১৯৯৫ সালে চরমপন্থিদের হাতে প্রাণ হারান। শান্তিচুক্তির বাহানা এবং যুদ্ধের মহড়া অব্যাহত রয়েছে। গত ১৩ আগস্ট ট্রাম্প যখন শান্তির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন ঠিক তখনই ইসরায়েলি বিমানবাহিনী গাজার সাধারণ মানুষের ওপর বোমা বর্ষণ করছিল।

২০০৩ সালে এ গবেষণা প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। কীভাবে ইসলামিক বিশ্ব তথা আরব বিশ্বে গৃহযুদ্ধ ঘটানো যায় সে পরিকল্পনা রয়েছে সেখানে। ২০০৪ সালে ইউএস স্ট্র্যাটেজি ইন মুসলিম ওয়ার্ল্ড নামে আরও একটি কৌশলপত্র প্রণীত হয়। এসব গবেষণার কৌশল বাস্তবায়নে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান। কয়েক মাস আগে কীভাবে ইরানি সেনাপ্রধান সোলায়মান নিহত হলেন ইরাকের রাজধানী বাগদাদে- সচেতন পাঠকের তা মনে থাকার কথা। এভাবে তারা বিভেদের বীজ বপনের জন্য চেষ্টা করছে অবিরত। শিয়া-সুন্নি অথবা আরব-অনারব বিভেদ জাগিয়ে তুলছে তারা। ইরান বনাম আরব সমীকরণ তারই প্রমাণ। এবার একই মানসিকতা নিয়ে হয়তো তুরস্কের বিরুদ্ধে আরব শক্তিকে সক্রিয় করা হবে।

অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com