
আলুর মূল্য
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সম্পাদকীয়
অমর কথাসাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোটগল্প 'ফুলের মূল্য' সম্পর্কে কে না জানে? কিন্তু কেউ কি জানত, এতকাল পরে বাজারে আলুর মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে সেই সাহিত্যকীর্তির? সাত সাগর পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে যুদ্ধ করতে এসে প্রাণ হারানো প্রিয়জনের সমাধিতে একগুচ্ছ ফুল দিতে গল্পের উত্তম পুরুষের হাতে অর্থ গুঁজে দিয়েছিলেন এক বিদেশিনী। প্রবাসী ওই বাঙালি মুখ ফুটে বলতে পারেননি, সেই সময় পর্যন্ত উপমহাদেশে ফুল কিনতে পয়সার প্রয়োজন হতো না। এখন অবশ্য ফুলের মূল্য চাল-ডাল-আলুর মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চেয়েও বেশি। বাজারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, তখন ভারতবর্ষ বা বর্তমান বাংলাদেশে আলু কিনতেও পয়সার প্রয়োজন হতো না। বাজারে বহুল প্রচলিত গোল আলু যদিও সতেরো শতকে পর্তুগিজ নাবিকদের জাহাজে উঠে ভারতবর্ষে এসে নেমেছিল; আমাদের দেশি আলু প্রচলিত ছিল আগে থেকে। বস্তুত মেটে আলু এখনও গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়। ওই আলু প্রাকৃতিকভাবেই জন্মাত, বাজারে উঠতে শুরু করেছে বলতে গেলে সেদিন। তবে খাদ্য হিসেবে আলুর মর্যাদা বাজারে ওঠা না ওঠার সঙ্গে কোনোকালেই ছিল না। হোক না দেশি মেটে আলু বা বিদেশ থেকে আগত গোল আলু; বাঙালির রসনাতৃপ্তিতে আলুর বহুমাত্রিক ব্যবহারের তুলনা নেই। স্বয়ং ভর্তা, ভাজি বা ঝোল তরকারি হিসেবে তো পাতে ওঠেই; মাছ বা মাংসের সঙ্গেও অনুষঙ্গ হিসেবে এর জুড়ি নেই। প্রচলিত ডাল বীজের উপস্থিতি ছাড়াই আলু নিজেই হয়ে উঠতে পারে 'ডাল'। ডালসহ যদি খিচুড়িতে দেওয়া হয়, তাতেও মানানসই। শুধু তরকারি হিসেবে নয়; ভাতের বিকল্প হিসেবে আলু খাওয়ার কথাও প্রায়শই ওঠে। এতকিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলার দক্ষতার কারণেই হয়তো 'আলু' এখন পাতের বাইরে জনারণ্যে সামাজিক প্রপঞ্চ হিসেবেও ব্যবহূত হয়। হালে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা চিপস হিসেবেও আমরা দেখছি আলুর জনপ্রিয়তা। এতকিছুর পরও কখনও কখনও আলু বাজারে গিয়ে উপযুক্ত দাম পায় না। এর কারণ খুব অস্পষ্ট নয়। দেশে প্রতিবছরই আলুর উৎপাদন বাড়লেও অভ্যন্তরীণ বা রপ্তানি চাহিদা বাড়ছে না। ফলে প্রতিবছরই মৌসুম শেষে আলু উদ্বৃত্ত থাকে।
এমনকি ভরা মৌসুমেও আলুর দাম না পেয়ে হাটে বা মহাসড়কে ফেলে দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের চিত্রও আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি। সেদিক থেকে সাম্প্রতিক বাজারে আলুর দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার যে খবর বৃহস্পতিবারের সমকালে প্রকাশ হয়েছে, সেটিকে স্বাগত জানানোই যেত। কিন্তু আমরা জানি, বাড়তি দামের অর্থ ভোক্তার পকেট থেকে মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে চলে যাবে। যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আলু উৎপাদন করে বাঙালি রসনা তৃপ্তির দায়িত্ব নিয়ে থাকেন, তাদের ভাগ্যে জুটবে না। অস্বীকার করা যায় না, কখনও কখনও আলু খাতে সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রণোদনা উৎপাদক না কার পকেটে যায়- তা নিয়ে সন্দেহ বরাবরের। মাঝখান থেকে প্রিয় আলু কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠতে পারে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের। আমরা চাই, উৎপাদকরা উপযুক্ত মূল পাক, ভোক্তারাও আলু কিনুক ন্যায্যমূল্যে। আলুর মতো কৃষিপণ্যের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থা সংহত করার কথা আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে অনেকদিন ধরেই বলে আসছি। নীতিনির্ধারণী মহলেও এ ব্যাপারে কম আলোচনা হয়নি। এখন সময় এসেছে সক্রিয় হওয়ার। আলুর মূল্য নিয়ে উৎপাদকের হাহাকার এবং ভোক্তার চিৎকার বন্ধ হবে না। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের পরিসর ছাপিয়ে তখন 'আলুর মূল্য' নামে অমর কথাসাহিত্য রচিত হতে পারে বটে, তা দিয়ে রসনা বা পাত ভরানো কঠিন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com