গল্প

মৌটুসির বাবা

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সালেহা চৌধুরী

মৌটুসির বয়স বারো বছর। পাঁচ বছর হলো ওকে যিনি মৌ বলে ডাকতেন তিনি নেই। মা ডাকতেন মৌ বলে, বাবা টুসি। বাবার কাছে বেড়ালের মতো ঘন হয়ে বসে কতসব গল্প শোনা। পাঁচ বছর হলো মৌটুসি বাবার ঘর শেয়ার করে। যেখানে একটি ছোটমতো খাট পাতা। বাবার খাটটা একটু বড়। রাতের আলো অন্ধকারে বাবা তাকে বই পড়ে শোনান, গল্প করেন। আর বাবা যখন ভূতের গল্প করেন, মৌটুসির বাবা ওর কাছে এসে বসেন। বলেন- ভয় করছে টুসিমা? ও কথা বলে না। বাবার হাতের পাতায় ভয় পাওয়া তাড়াতে চায়। বাবা ওকে স্কুলে রেখে আসেন। আবার স্কুল শেষ হলে বাড়িতে নিয়ে আসেন। স্কুল বন্ধ হলে দূরের এক খালা আসেন। মমতা খালা ওকে তখন দেখাশোনা করেন। সে অবশ্য দিনের ব্যাপার। রাতে বাবা আর ও। সেখানে আর কেউ থাকে না। সে জগৎটা মৌটুসির খুব পছন্দ। ঘন অন্ধকারে বাবার গলার স্বর শোনা।

এবার বন্ধে মমতা খালা এলেন। পায়ে বাত। শরীরটা তেমন সুবিধার নেই। বলেন- মৌটুসি একটা কথা বলব?

বল? ছবি আঁকতে আঁকতে বলে মৌটুসি।

মমতা খালা কাছে এসে বসেন। বলেন- বাবাটা বড় একা নারে মৌটুসি?

একা আবার কী? আমি আছি না? বাবা আর আমি আর কাউকে দরকার নেই। তুমি এসেছ সে তো দিনের জন্য। রাতে আমি আর বাবা। গল্প, বই, কখনও ক্যাসেটে গান শোনা।

মমতা খালা পান-জর্দার ঠোঁট মুছে বলেন- আসলে ওই রাতের জন্য তোমার বাবার একজন দরকার। মৌটুসি বুঝতে পারে না এমন কথার কী মানে। মমতা খালা বলেন- একেবারে একা বেচারা। পুরুষ মানুষ কতদিন আর এমন একা থাকবে।

মৌটুসি ঝংকার দিয়ে বলে- খালা তুমি আর এমন একা একা বলবে না। আমার শুনতে ভালো লাগছে না।

মমতা খালা আর কিছু বলেন না। তবে একটু গম্ভীর হয়ে বলেন- খুব স্বার্থপর হয়ে গেছ তুমি। মৌটুসি রাগ করে এ ঘর থেকে চলে যায়।

সে রাতে তারাদের গল্প শুনতে শুনতে মৌটুসি বলে- বাবা তুমি কি একা?

কেন?

মমতা খালা বলেন রাতে তুমি নাকি একা। বাবা একটু হাসেন এবং একটু গম্ভীর গলায় বলেন- মায়ের কথা মনে আছে তোমার?

অল্প অল্প।

তোমার মায়ের মতো কাউকে তোমার দরকার নেই? অল্প আলোতে বাতির ছায়া দেয়ালে। মৌটুসির মনে হয় সেখানে একটা ছায়মূর্তি। মৌটুসি রাতেও এমন ছায়া ছায়া ছবি দেখেছে। কে যেন খুব কাছে। কিন্তু ও তাকে চেনে না। বাবা বলেন- ওই যে ঘরটা তোমার পছন্দ সেখানে একটা ভালো খাট পেতে দিলে সেখানে তুমি ঘুমাতে পারবে না? আমার বইপত্রের ঘরের পাশের ঘরটা।

এ ঘরে ঘুমাব বাবা। কিছু না বলে বাবা গল্পটা শেষ করেন। ঘুমসুন্দরীর গল্প। আমাকে অন্য ঘরে খাট পেতে দিও না। বাবা বলেন- সবসময় সবকিছু একই নিয়মে চলে না। বদল হয়। অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। মৌটুসি বলে কেবল- আমি এখানে থাকতে চাই বাবা।

মমতা খালা বলেন- রোজিকে বিয়ে করবেন তোমার বাবা। তার পান-জর্দার গলাটা কেমন খসখসে।

রোজি আপু? প্রিন্সিপাল চাচার মেয়ে।

এখন থেকে আপু বলবে না। বলবে মা মণি। না হলে শুধু মা।

কেন? মা মণি বলব?

সাত দিন পর বাবা ওকে বিয়ে করবেন। তখন ছুটিতে আর আমাকে আসতে হবে না। আসতে পারবও না। বাতে পা ভারী হয়ে গেছে। এখন থেকে কেবল নিজের বাড়ি। জানালার ওপারে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। মমতা খালা জানালার পাল্লা বন্ধ করতে করতে বলেন- পাঁচ বছর একা। আশরাফ ভাইয়ের বিয়ে করা উচিত। মৌটুসি খানিকটা বুঝতে পারে। বাবা তাহলে বিয়ে করবেন?

সাত দিনে পৃথিবীর রূপ-রং বদলে যায় মৌটুসির। অন্ধকারে একা ঘুমানো। ভয় পেলে বাবার মুঠি না থাকা। একদিন বাবা ওকে ডাক দিয়ে সওদাপাতি দেখান। রংবেরঙের শাড়ি। সাজুগুজুর জিনিস। একটা সোনার সেট। চুরি। নতুন জুতা। আরও কত কী।

এগুলো কার বাবা? বলেন- এই নাও তোমার নতুন জামা। আর ওগুলো সব রোজির। ওর কেবল একটা জামা আর রোজি আপুর বড় এক সুটকেস জিনিস। বাবা তার মাথার ভেতরের সাদা চুলের ইশারাকে কলপে দূর করেন। মাঝে মাঝে গান করেন। যেমনটি তিনি আগে করেননি। বাবার হাসির শব্দ এখন অন্যরকম। মৌটুসির ভালো লাগে না। সবকিছু কেন এমন করে বদলে যায়!

রোজি আপু বাড়িতে এলে মমতা খালা বলেন- মা বলে ডাকবে। আপুটাপু নয়। ঘোমটার ফাঁকে রোজি ওকে তাকিয়ে দেখে। তারপর মুখ নামায়। কতসব গয়নাগাটি আর টকটকে লাল শাড়ি। মাথায় ফুল। মৌ মৌ গন্ধ।

বাবার খাটটা ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আয়না বসানো একটা পুরোনো কালের খাট। দু'জনের জন্য। অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চমৎকার বেডকভার। আর সুন্দর বালিশ। একটা বড় আলমারি যেখানে রোজির কাপড়চোপড়। মৌটুসি বুঝতে পারে রোজি ওকে খুব পছন্দ করে না। একদিন ও শুনতে পায় রোজি বলছে- মৌটুসি আমাকে ঈর্ষা করে।

বাবা বলেন- তা কেন? ও তো এতদিন একা ছিল আমার সঙ্গে। এখন তোমাকে মেনে নিতে ওর সময় লাগছে। ঠিক হয়ে যাবে। এই বলে বাবা রোজির গালে চুমু খান। আর রোজি বলে- হাজার হলেও আমি সৎ। খানিক পর ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মৌটুসি বিচ্ছিন্ন জগতে। ভালো লাগে না। বাবা এখন আর গল্প করেন না। রাতে দরজা যখন বন্ধ হয় মৌটুসির মনে হয় ও একা। সত্যি একা। দেয়ালে সেই ছায়াটা ঘুরে যায়। ছায়া কোনো কথা বলে না। ছায়াটা কখনও ওর বিছানার কাছে চলে আসে। মশারির ওপারে তারপর চলে যায়। ছায়াটাকে ও ভয় পায় না। ছুটির দিনে দুপুরে দরজা বন্ধ হওয়া? সেই দাবা, স্ট্ক্রাবল, লুডো, বাগাডুলির দুপুর। না এখন বাবা ওকে নিয়ে সেই মাতাল হাওয়া খেলার জীবনে চলে যান না। বাবা ছুটির দিনে দরজা বন্ধ করে ঘুমান।

এভাবে তিন মাস চলে যায়। মৌটুসির ভেতরে একটা কষ্ট গলার ভেতরে দলা পাকিয়ে যায়। একদিন ও বই আর পুতুলটুতুল সব ছুড়ে ফেলে। তারপর আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় সেই জায়গাটায় যেখানে শাপলা-পদ্ম ফোটে। মাছরাঙা উড়ে যায়। বাবা বলেন- আমরা কোনোদিন ঢাকা যাব না। কারণ ঢাকায় এসব নেই। ঢাকায় সবকিছু অন্যরকম। বড় নির্দয় মনে হয়। বাবা এটা ওটা লেখেন। মৌটুসি তাকিয়ে দেখে কোনো এক অজানা ফুলের গাছে এন্তার ফুল। লালমতো ফুল। ঘন সবুজ পাতা। একটা গন্ধভরা বাতাস। গাছ থেকে মৌটুসি সেই পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে শাপলা। আর মাছেদের। বাবা কোনোদিন ওকে বড়শি বানিয়ে মাছ ধরতে দেবেন না। ও কোনোদিন এমন করে একলা দুপুরে ঝিলপাড়ে আসেনি। আজ কতটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলো। বাবার বন্ধ ঘরের দরজা আর ওর বুকের ভেতর দাপাদাপি। বাবা যখন কলেজ পড়াতে যান, পইপই করে বলে যান- খররদার কোথাও যাবে না তুমি। তখন মমতা খালা থাকে না। রাশুর মা ওকে পাহারা দেয়। রাশুর মায়ের ছেলের নাম রাশু। যাকে মৌটুসি মাঝে মাঝে দেখে। এখন মমতা খালা নেই। রাশুর মা নেই। যে পাখিটা ঠোঁটে করে মাছ নিয়ে কোথায় উড়ে যায় সেদিকে তাকিয়ে থাকে। খানিক পরে বুঝতে পারে পাখিটা মাছ নিয়ে বাড়িতে গেছে। ছোট ছোট বাচ্চাকে খাওয়াবে বলে। এ দৃশ্য কেন যে ওকে বেদনাবিধুর করে কে জানে। শরশর বাতাস। একটু মেঘ। রোদের তাপ নেই। আর ঝিলের উপর একটু পাতলা আবরণ। আর সেখানে সেই ছায়াছায়ামায়ামায়া দৃশ্য। সে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় ছায়া ওকে ডাকছে। -এসো। আমার জগতে। মৌটুসি শুনতে পায় না কিন্তু বুঝতে পারে। একসময় ও একটু একটু করে পানির দিকে এগিয়ে যায়। ছায়াটা থমকে আছে। প্রথমে পায়ের পাতা ভিজে যায়, তারপর হাঁটু পর্যন্ত। মৌটুসি ভূতে পাওয়া একজনের মতো এগোতে থাকে। গাছেরা ফিসফিস করে কীসব বলছে। পাখিরাও। মৌটুসি সেসবে কান দেয় না। ও এগিয়ে যায় পানির দিকে। একে কি বলে অতল জলের আহ্বান। ও তো সাঁতার জানে না। তারপর? মৌটুসির আর মনে নেই।

যখন জেগে ওঠে ও দেখে বাবা ওর খুব কাছে। ওর জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার ওকে খুব ভালো করে দেখেন। বুক পেট সবকিছু। তারপর বলে- যাক ভয় কেটে গেছে।

রাশু ওকে না দেখলে? বাবার গলা ভারী। বলেন তিনি আবার- ছেলেটা ওইসময় যদি ঝিলপাড় না যেত। তিনি ওর কাছে বসেন। বলেন- তোমাকে অনেকদিন বলেছি না টুসি কোনোদিন একা ঝিলপাড়ে যাবে না। মৌটুসি বলে না এ তোমার দরজা বন্ধ করবার প্রতিক্রিয়া। বন্ধ দরজা আমার খুব খারাপ লাগে। আমার একা লাগে। রোজি এসেছে ঘরে। হাতে দুধের গ্লাস। বলে- টুসি দুধটুকু খেয়ে নাও। মৌটুসি তাকিয়ে দেখে আজ রোজি চুল বাঁধেনি। বিকালের সাজুগুজু করেনি। কোমরে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নানা কিছু করছে। একবার ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে- ভরদুপুরে ঝিলপাড়ে? জানো না জায়গাটা ভয়ানক দোষান্ত।

দোষান্ত! মৌটুসির মনে পড়ে এই শব্দটা মা ব্যবহার করতেন। ঝিলপাড় দোষান্ত, কবরস্থান দোষান্ত, রাতে নিমগাছের ছায়ায় যাওয়া দোষান্ত। তখন রোজির বয়স পাঁচ। কিছুদিন পর ছয় হতো। একটা শব্দ ওকে পাঁচ বছরের জগতে ক্ষণিকের জন্য হলেও নিয়ে যায়। যত্ন করে রোজি দুধ খাইয়ে আঁচলে মুখটা মুছে দিয়ে চলে যায়। বাবা বলেন- রোজিকে মা বলে ডেকো। ও আজ তোমার জন্য অনেক কিছু করেছে।

কী অনেক কিছু?

ডাক্তার ডাকা, আমাকে ডাকা। আমি দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম। রাশুই ওকে ডেকে তুলেছিল। রাশুটা তোমার জীবন ফিরিয়ে দিল। সন্ধ্যা সন্ধ্যা সময়ে মৌটুসি দেয়ালে ছায়া দেখে না। বাবা বলেন- টুসি আজ তোমার তেরোর জন্মদিন। ও তোমার জন্য কী কী সব কিনে রেখেছে।

বাবা বলেন- এবার ঘুমাও। কাল সকালে দেখবে। বাবা চেয়ারটা কাছে টেনে হ্যান্সক্রিশ্চিয়ার অ্যান্ডারসনের একটা গল্প পড়ে শোনাবেন বলে কাছে আসেন। মৌটুসির দুই চোখের পাতা একসময় ভারী হয়ে আসে। একটা নৌকায় ওরা তিনজন। বাবা রোজি আর মৌটুসি। তখন ওই দোষান্ত ঝিল ওর কিছুই করতে পারবে না।

অনেক রাতে রোজির ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে জেগে ওঠে। কী একটা সুগন্ধি মাখে রোজি। একটা অচেনা ফুলের গন্ধ। রোজি বলে- ঘুমাও। আমি খালি তোমার জন্য এটা ওটা কিনেছি। তোমার বাবাও কতকিছু কিনেছেন। কাল সকালে সব দেখবে। মৌটুসি কাল একটা পার্টি হবে তোমার। রোজি আরও কাছে এসে বলে- একটা ভাই হলে তোমার ভালো লাগবে।

ভাই?

রোজি ওর কাছে আসে। চুলে হাত বুলিয়ে খুব নরম করে বলে। -ভাই না বোন?

ভাই ভালো।

তাহলে ভাই।

রোজিকে খারাপ লাগে না। জানে এখুনি রোজি গিয়ে বাবার পাশে টুক করে শুয়ে পড়বে। তারপর কথা, হাসাহাসি। যেমন করে বাবা ওর সঙ্গে কথা বলেন না, হাসেন না। বাবাটা তখন অন্য একজন।

সেই যে ছায়াটা ওকে ঝিলের ভেতর দিয়ে তার কাছে যেতে ডেকেছিল, সে তখন কোথায় যে চলে গেছে কে জানে। এসব পরিবর্তন মৌটুসির অভ্যাস হয়ে যাবে। ছায়া চিরকালর মতো চলে গেছে।

আলোছায়া সময়। মশারির ছাদের আর দেয়ালের ভেতর দিয়ে একটু বিষ্টিমাখা বাতাস।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com