
সম্প্রদায়-পরিচয়ের অস্ত্র
পাকিস্তানের ভূতদর্শন
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
--

১৯৫০ সালের আগে এ দেশে বড়ো ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি এবং পঞ্চাশেও কোনো গণ্ডগ্রামে দাঙ্গা হয়েছে- এমন শুনিনি। আমি না শুনলেও অন্য কেউ শোনেনি বা দেখেননি এমন কথা বলার অধিকার অবিশ্যি আমার নেই। তাই, এ-ব্যাপারে কারো সঙ্গে আমি তর্ক জুড়ে দেব না। কারণ আমিও তো আমার একান্ত ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ পরিমণ্ডলে সেই বালক বয়সেই এমন অনেক ব্যতিক্রমী ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি, সেগুলোকে কিছুতেই বাঞ্ছিত বা স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া যায় না।
এক গৃহস্থের গরু আরেক গৃহস্থের ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলেছে, কিংবা এ-বাড়ির একটি নাবালক ছেলে ও-বাড়ির আরেকটি ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে বাপ-মা তুলে গাল দিয়েছে, কিংবা এ-গাঁয়ের একটি কিশোরীকে জলের ঘাটে একলা পেয়ে ও-গাঁয়ের একটি উঠতি বয়সের ছোকরা ওর উদ্দেশ্যে কিছু আদিরসাত্মক বাক্য উচ্চারণ করেছে বা গানের কলিতে সুর ভেজেছে- এমন তো গৈ গেরামে হরহামেশাই হয়ে থাকে। এসব নিয়ে 'ঘোলা জলের ডোবার মতো নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে যে তরঙ্গ জাগে তার অভিঘাতে কমেডি ও ট্র্র্যাজেডি দুই-ই সৃষ্টি হয়। দতবে এতকাল পর্যন্ত এসবের কোনো কিছুতেই সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া লাগেনি। কিন্তু এখন সবকিছুই হয়ে গেল সাম্প্রদায়িক। গরু ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছে, সেটা বড় কথা নয়, আসল বিবেচ্য হয়ে উঠল কার গরু, আর কার ক্ষেত। গরুর মালিক আর ক্ষেতের মালিকের মধ্যে কে হিন্দু আর কে মুসলমান। হরমুজ আলীর গরু মনীন্দ্র দাসের ক্ষেতের কচি চারাগুলো খেয়ে ফেলেছে, তো কী হয়েছে? গরু তো অবলা প্রাণী, সে যেখানে খাবার পাবে সেখানেই খাবে, মনীন্দ্র তার ক্ষেত পাহারা দিয়ে রাখে না কেন? কিন্তু মনীন্দ্রর গরু যদি যায় হরমুজের ক্ষেতে? তা হবে কেন? বেটা মালাউন তো ইচ্ছে করেই তার গরুটাকে হরমুজের ক্ষেতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। এ নিয়েই মনীন্দ্রর ওপর চলবে হম্বিতম্বি, আর বারবার তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে যে, এ-দেশটা এখন পাকিস্তান, মনীন্দ্রদের তাদের নিজের দেশ হিন্দুস্থানে চলে যেতে হবে। অবোধ বালকদের ঝগড়াঝাঁটি-মারপিটও এখন আর আগের মতো ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের ধারক নয়; বালকরা তাদের অতি বুদ্ধিমান অভিভাবকদের মুখ থেকে শুনে শুনে নানা সাম্প্রদায়িক বুলি রপ্ত করে নিয়েছে, আপন আপন সম্প্রদায়-পরিচয় সম্বন্ধে তারা সচেতন হয়ে উঠেছে এবং সেই সচেতনতার অস্ত্রই তারা সময়ে-অসময়ে প্রয়োগ করে ভিন্ন সম্প্রদায়ের সমবয়সীদের ওপর। সে-অস্ত্রের ঘা এসে লাগে তাদের অভিভাবকদের মনেও, এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় প্রচন্ড উত্তেজনার এবং সে-উত্তজেনায় পাকিস্তান-সৃষ্টির সাম্প্রদায়িক তাৎপর্য বড় বিশ্রী রকমে প্রকট হয়ে পড়ে। স্বভাবতই সবচেয়ে বেশি স্পর্শকতার হয়ে দেখা দেয় মেয়েদের নিয়ে ঘটনাগুলো। হিন্দু বাড়ির বৌ-ঝিদের জলের ঘাটে যাওয়া তো বন্ধই, বাড়িতেও চলাফেরা করা দুস্কর। এ রকম ম্যালা ঘটনা ও রটনার কথা নিয়ে হাতিল গাঁয়ের হিন্দুরা আসে আমার মাসিমার শ্বশুর দীনবন্ধু দেবের কাছে। দীনবন্ধু দেব ছোট ভাই দিগিন্দ্র দেবের মতো নামকরা ব্যায়ামবীর না হলেও শারীরিক শক্তি-সামর্থ্যে মোটেই খাটো ছিলেন না। তাঁর যৌবনকালীন দুর্ধর্ষতার অনেক গল্প গাঁয়ের লোকেদের মুখস্থ। কিন্তু বৃদ্ধ দীনবন্ধুর অন্য রূপ। তিনি এখন সাধক বৈষ্ণব। গলায় কণ্ঠী, কপালে তিলক, মুখে সর্বদা 'রাধেকৃষ্ণ' বোল। যে যে কথাই বলতে আসুক তাঁর কাছে, সব কথাতেই তাঁর এক রকমের জবাব।
-"আরে, সবই হলো গিয়ে লীলাময়ের লীলা। তুমি আমি তো তাঁর হাতের পুতুল মাত্র। ...পৃথিবী পাপে ছেয়ে গেছে। পাপের ভরা পূর্ণ হলেই নারায়ণ পৃথিবীতে নেমে আসবেন। নৃসিংহ রূপ ধরে তিনি আসেননি অত্যাচারী দানব হিরণ্যকশিপুকে বধ করতে? রামরূপে রাবণকে আর শ্রীকৃষ্ণ রূপে বধ করেননি কংসকে, জরাসন্ধকে তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখ, তিনি অগতির গতি, তিনিই দুর্বলের একমাত্র ভরসা"- এসব কথা বলেই বারবার যুক্তকর কপালে ঠেকাতেন।
কিন্তু সব কিছুকেই লীলাময়ের লীলা বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা, কিংবা অগতির গতির ওপর ভরসা রেখে সব দুর্গতিকে তুচ্ছ করা- গাঁয়ের মানুষের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। তারা নিজেরাই বর্তমানের বাস্তব ও ভবিষ্যতের কল্পিত দুর্গতির হাত থেকে রেহাই পাবার পথ খুঁজতে লাগলো। সে পথ তো আপাতত একটাই- মুসলমানের দেশ পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দুস্থানে পাড়ি দেয়া।
পাকিস্তানে থাকতে চাইলে মুসলমান হয়েই থাকতে হবে, হিন্দুদের মনে এমন একটা ধারণা তখনকার পল্লীর কিছু কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখেও জন্মে গিয়েছিল। হাতিলেই সে সময় এক দিন একটা যাত্রাপালার অভিনয় দেখেছিলাম। কী এক বাদশাহর নামে পালাটির নাম। তার কাহিনিটা আজ আর স্মরণ করতে পারবো না। তবে এটুকু মনে আছে যে, মুসলমান বাদশাহর সঙ্গে হিন্দুরাজার ঘোরতর যুদ্ধের পর রাজা পরাস্ত হলো এবং তারপর রাজা তার রাজ্যের সব প্রজাদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো- এই ছিল সে পালার নির্যাস।
এক গৃহস্থের গরু আরেক গৃহস্থের ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলেছে, কিংবা এ-বাড়ির একটি নাবালক ছেলে ও-বাড়ির আরেকটি ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে বাপ-মা তুলে গাল দিয়েছে, কিংবা এ-গাঁয়ের একটি কিশোরীকে জলের ঘাটে একলা পেয়ে ও-গাঁয়ের একটি উঠতি বয়সের ছোকরা ওর উদ্দেশ্যে কিছু আদিরসাত্মক বাক্য উচ্চারণ করেছে বা গানের কলিতে সুর ভেজেছে- এমন তো গৈ গেরামে হরহামেশাই হয়ে থাকে। এসব নিয়ে 'ঘোলা জলের ডোবার মতো নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে যে তরঙ্গ জাগে তার অভিঘাতে কমেডি ও ট্র্র্যাজেডি দুই-ই সৃষ্টি হয়। দতবে এতকাল পর্যন্ত এসবের কোনো কিছুতেই সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া লাগেনি। কিন্তু এখন সবকিছুই হয়ে গেল সাম্প্রদায়িক। গরু ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছে, সেটা বড় কথা নয়, আসল বিবেচ্য হয়ে উঠল কার গরু, আর কার ক্ষেত। গরুর মালিক আর ক্ষেতের মালিকের মধ্যে কে হিন্দু আর কে মুসলমান। হরমুজ আলীর গরু মনীন্দ্র দাসের ক্ষেতের কচি চারাগুলো খেয়ে ফেলেছে, তো কী হয়েছে? গরু তো অবলা প্রাণী, সে যেখানে খাবার পাবে সেখানেই খাবে, মনীন্দ্র তার ক্ষেত পাহারা দিয়ে রাখে না কেন? কিন্তু মনীন্দ্রর গরু যদি যায় হরমুজের ক্ষেতে? তা হবে কেন? বেটা মালাউন তো ইচ্ছে করেই তার গরুটাকে হরমুজের ক্ষেতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। এ নিয়েই মনীন্দ্রর ওপর চলবে হম্বিতম্বি, আর বারবার তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে যে, এ-দেশটা এখন পাকিস্তান, মনীন্দ্রদের তাদের নিজের দেশ হিন্দুস্থানে চলে যেতে হবে। অবোধ বালকদের ঝগড়াঝাঁটি-মারপিটও এখন আর আগের মতো ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের ধারক নয়; বালকরা তাদের অতি বুদ্ধিমান অভিভাবকদের মুখ থেকে শুনে শুনে নানা সাম্প্রদায়িক বুলি রপ্ত করে নিয়েছে, আপন আপন সম্প্রদায়-পরিচয় সম্বন্ধে তারা সচেতন হয়ে উঠেছে এবং সেই সচেতনতার অস্ত্রই তারা সময়ে-অসময়ে প্রয়োগ করে ভিন্ন সম্প্রদায়ের সমবয়সীদের ওপর। সে-অস্ত্রের ঘা এসে লাগে তাদের অভিভাবকদের মনেও, এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় প্রচন্ড উত্তেজনার এবং সে-উত্তজেনায় পাকিস্তান-সৃষ্টির সাম্প্রদায়িক তাৎপর্য বড় বিশ্রী রকমে প্রকট হয়ে পড়ে। স্বভাবতই সবচেয়ে বেশি স্পর্শকতার হয়ে দেখা দেয় মেয়েদের নিয়ে ঘটনাগুলো। হিন্দু বাড়ির বৌ-ঝিদের জলের ঘাটে যাওয়া তো বন্ধই, বাড়িতেও চলাফেরা করা দুস্কর। এ রকম ম্যালা ঘটনা ও রটনার কথা নিয়ে হাতিল গাঁয়ের হিন্দুরা আসে আমার মাসিমার শ্বশুর দীনবন্ধু দেবের কাছে। দীনবন্ধু দেব ছোট ভাই দিগিন্দ্র দেবের মতো নামকরা ব্যায়ামবীর না হলেও শারীরিক শক্তি-সামর্থ্যে মোটেই খাটো ছিলেন না। তাঁর যৌবনকালীন দুর্ধর্ষতার অনেক গল্প গাঁয়ের লোকেদের মুখস্থ। কিন্তু বৃদ্ধ দীনবন্ধুর অন্য রূপ। তিনি এখন সাধক বৈষ্ণব। গলায় কণ্ঠী, কপালে তিলক, মুখে সর্বদা 'রাধেকৃষ্ণ' বোল। যে যে কথাই বলতে আসুক তাঁর কাছে, সব কথাতেই তাঁর এক রকমের জবাব।
-"আরে, সবই হলো গিয়ে লীলাময়ের লীলা। তুমি আমি তো তাঁর হাতের পুতুল মাত্র। ...পৃথিবী পাপে ছেয়ে গেছে। পাপের ভরা পূর্ণ হলেই নারায়ণ পৃথিবীতে নেমে আসবেন। নৃসিংহ রূপ ধরে তিনি আসেননি অত্যাচারী দানব হিরণ্যকশিপুকে বধ করতে? রামরূপে রাবণকে আর শ্রীকৃষ্ণ রূপে বধ করেননি কংসকে, জরাসন্ধকে তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখ, তিনি অগতির গতি, তিনিই দুর্বলের একমাত্র ভরসা"- এসব কথা বলেই বারবার যুক্তকর কপালে ঠেকাতেন।
কিন্তু সব কিছুকেই লীলাময়ের লীলা বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা, কিংবা অগতির গতির ওপর ভরসা রেখে সব দুর্গতিকে তুচ্ছ করা- গাঁয়ের মানুষের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। তারা নিজেরাই বর্তমানের বাস্তব ও ভবিষ্যতের কল্পিত দুর্গতির হাত থেকে রেহাই পাবার পথ খুঁজতে লাগলো। সে পথ তো আপাতত একটাই- মুসলমানের দেশ পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দুস্থানে পাড়ি দেয়া।
পাকিস্তানে থাকতে চাইলে মুসলমান হয়েই থাকতে হবে, হিন্দুদের মনে এমন একটা ধারণা তখনকার পল্লীর কিছু কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখেও জন্মে গিয়েছিল। হাতিলেই সে সময় এক দিন একটা যাত্রাপালার অভিনয় দেখেছিলাম। কী এক বাদশাহর নামে পালাটির নাম। তার কাহিনিটা আজ আর স্মরণ করতে পারবো না। তবে এটুকু মনে আছে যে, মুসলমান বাদশাহর সঙ্গে হিন্দুরাজার ঘোরতর যুদ্ধের পর রাজা পরাস্ত হলো এবং তারপর রাজা তার রাজ্যের সব প্রজাদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো- এই ছিল সে পালার নির্যাস।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com