
হোঁচট খেলেও উঠে দাঁড়াবে নারী
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাশেদা কে চৌধুরী

নারীর অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে একটা বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। তিনটি ক্ষেত্রে এ অগ্রযাত্রা দৃশ্যমান। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে নারীর অবদান আজ সর্বজন স্বীকৃত। এর পরই রয়েছে উদ্যোক্তা হিসেবে নারী। নগরে-বন্দরে ক্ষুদ্র-মাঝারি-বড় অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছেন। তাছাড়া আমাদের নারীর বিশ্বব্যাপী একটা গৌরবের জায়গাও আছে। ক্ষুদ্র ঋণের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে একজন হয়তো নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু তার পেছনে ছিলেন এদেশের অগণিত নারী। তৃতীয় জায়গাটা হলো রাজনীতি। ২৯ বছর ধরে এদেশের সরকারপ্রধান নারী! আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা আর নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে সরকারপ্রধান নারী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এ সময়টায় নারীর অগ্রযাত্রা কখনও থেমে থাকেনি।
উদাহরণ হিসেবে শিক্ষা খাতের দিকে তাকালেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায়। আমরা দেখতে পাই, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আমাদের দেশে গণতন্ত্র হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ১৯৯০-এ স্বৈরাচারী সরকার পতনের মধ্য দিয়ে আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসে। নতুন নির্বাচিত সরকার নারী ও মেয়েশিশুর শিক্ষার ওপরে গুরুত্ব দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তাদের লেখাপড়া অবৈতনিক করে দেয়। মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে শুরু হয় উপবৃত্তি প্রদান। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পালাবদল হলেও এ নীতির পরিবর্তন হয়নি। অথচ আমরা সাধারণত দেখেছি সরকারের সিদ্ধান্ত ও নীতি অন্য সরকার এসে বদলে দেয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, নতুন সরকার নারী শিক্ষার এই বিষয়টি বদল তো করেনি বরং তার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি থেকে দশম এবং এখন তা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হলেও মেয়েশিশুর জন্য ইতিবাচক এই নীতির পরিবর্তন হয়নি। এর সুফল এখন আমরা পাচ্ছি।
মেয়েশিশু ও নারীর ওপর এই বিনিয়োগের ফলে তিনটি বিষয় ক্রমাগত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। একটি হলো, তথাকথিত 'দরিদ্র দেশ ও রক্ষণশীল সমাজ' থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ক্রমাগত বাড়ছে। ২০০৫ সালের মধ্যেই আমাদের প্রাথমিক স্কুলে ছেলেমেয়ের সমতা চলে আসে। পৃথিবীর বহু দেশের আগেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তারপর সমতা এলো মাধ্যমিকেও। এখন দেখছি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে প্রায় উল্টো স্রোতে যাচ্ছি আমরা- মেয়ে বেশি, ছেলে কম। মাধ্যমিকে ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী মেয়ে আর ছেলে ৪৯ শতাংশ। তখন শিক্ষা-সংশ্নিষ্টরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন- জেন্ডারের এক বৈষম্য দূর করতে গিয়ে যেন আরেক বৈষম্য তৈরি না হয়। তাই এখন দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ২০ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থীকেও উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
মেয়েশিশুর জন্য ক্রমাগত এই বিনিয়োগের ফলে এখন উচ্চশিক্ষায়ও নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মেয়েশিশু বা নারীর অগ্রযাত্রা স্পষ্টতই দৃশ্যমান তবে উচ্চশিক্ষায় এই গতি বেশ ধীর।।
এখানে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর ৪০ শতাংশ নারী হলেও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্য থেকে কি সমানভাবে শিক্ষার্থী আসছে? সেটি কিন্তু নয়। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমরা দেখেছি, বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন মেডিকেল- সেখানে মেয়ের সংখ্যা বেশি। এ ক্ষেত্রে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজের কথা আমরা উদাহরণ হিসেবে আনতে পারি। সেখানে সাম্প্রতিককালে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি উত্তীর্ণ হয়। এ পর্যায়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ পড়ল আবাসন সমস্যায়। মেয়েদের যে হল ছিল, সেখানে তাদের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। পরে মেয়েদের জন্য নতুন একটা হল তৈরি করতে হয়েছে।
মেয়েদের দৃশ্যমান অগ্রযাত্রার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলো এভাবেই উঠে আসছে। আমরা মেয়েদের এগিয়ে নিতে চাচ্ছি, সেখানে সরকারের ইতিবাচক নীতিমালা রয়েছে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে ওপরের দিকে নারী শিক্ষার্থীর হার ক্রমাগত কমতে থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশে তৃণমূল থেকে হিমালয় শিখর- সর্বত্র নারীর দৃপ্ত পদচারণা দৃশ্যমান। দু'জন ছেলের পাশাপাশি বাংলাদেশের দু'জন নারী ও কিন্তু এভারেস্ট জয় করেছেন। ক্রীড়ার ক্ষেত্রে চমক লাগানো কলসিন্দুরের মেয়েরা, ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়েরা গ্রাম থেকে উঠে এসেছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে এখন আমরা সবাই তাদের সম্পর্কে জানি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার চাহিদা তৈরি হয়ে গেছে। এটা এদেশের মানুষের বিশাল অর্জন। আমি যদি যে কোনো রিকশাওয়ালা ভাইকেও জিজ্ঞাসা করি, তিনিও বলবেন তার ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে চান। কেউ 'না' বলবেন না। অথচ আমি চার বছর আগে ভারতের বিহারে ঘুরতে গিয়ে মাঠের কৃষকদের যখন তাদের সন্তানের লেখাপড়ার কথা বলেছি, সোজা বলেছেন, 'কিয়া ফায়দা'! আমাদের দেশে কিন্তু এখন কেউ বলেন না 'লেখাপড়া করে কী হবে'। এই যে মানুষের অর্জনগুলোকে আমরা সামনে নিয়ে আসতে পেরেছি এবং ছেলেমেয়ে সবার ক্ষেত্রে শিক্ষার সর্বজনীন চাহিদা তৈরি হয়ে গেছে, এর ইতিবাচক ফল অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমরা পাচ্ছি। ক্রীড়ার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সেটি কিন্তু ঘর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসেনি, প্রধানত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের মেয়েরা তো ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হতে পেরেছে। কারাতে, ভারোত্তোলন- এগুলোতেও বাংলাদেশের মেয়েরা সফল হচ্ছে, পদক নিয়ে আসছে। এভাবেই অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও মেয়েরা কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে।
সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। নাট্য নির্দেশক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র পরিচালক পর্যন্ত এখন অনেক নারীকেই দেখতে পাচ্ছি যা আমরা ২০-২৫ বছর আগে চিন্তাও করতে পারতাম না। সংগীত জগতেও এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে বাংলাদেশের কৃতী নারীর বিচরণ নেই। ফিরোজা বেগম, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফরিদা পারভীন, ফেরদৌস আরার মতো সংগীতশিল্পীর সুনাম বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও চলে গেছে। সাহিত্যের দিকে যদি তাকাই, একসময় অবিভক্ত বাংলায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, কুসুম কুমারী দাশ, মহাশ্বেতা দেবী বা আশাপূর্ণা দেবী অথবা এদেশে বেগম সুফিয়া কামাল, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেনের মতো অনেক যশস্বী নারীর নাম আমরা জানি। এখন কথাসাহিত্য বা কবিতায় নবীন-প্রবীণ অনেক নারীর দৃপ্ত পদচারণা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তারা খ্যাতি অর্জন করেছেন, অনেকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননাও পেয়েছেন। প্রশাসনেও নারী এখন বেশ ভালোভাবেই দায়িত্ব পালন করছেন। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে পুলিশ বাহিনী ও সামরিক বাহিনীতে অনেক নারী নিয়োজিত আছেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নারীরা যাচ্ছেন, এমনকি মিশনপ্রধান হিসেবেও তারা সফলভাবেই দায়িত্ব পালন করছেন। নারীর অগ্রযাত্রা এখানেও দৃশ্যমান।
তবে এখন যে বিষয়টা উঠে এসেছে, সেটি হলো- অংশগ্রহণ দৃশ্যমান, কিন্তু অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে নারী এখনও তেমনভাবে এগোতে পারেনি। রাজনীতির কথাই যদি বলি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের কমিটিতে এবং বিভিন্ন নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ পদে নারী মনোনয়ন দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। নারী দলপ্রধান, নারী সরকারপ্রধান থাকা সত্ত্বেও সেটি হয়নি। কবে হবে তাও জানি না। আমরা আশা করেছিলাম অন্তত সংসদ সদস্য পদে নারী নির্বাচনে কোটা থাকলেও তারা সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসবেন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী সংসদ সদস্য সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের একটা প্রতিশ্রুতি ছিল কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পরে আর রাখা হয়নি। সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্যের সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০ জনে উন্নীত হলেও সরাসরি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসলেন না। তারা তো নির্বাচনী এলাকা থেকে নারী কোটায় সরাসরি ভোটেই নির্বাচিত হতে পারতেন কিন্তু সেটি আর হলো না, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ল।
পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র- কোনো জায়গাতেই নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অংশীদারিত্বের জায়গাটা এখনও শক্ত হয়নি। পরিবারের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুব কম নারীই নিয়ে থাকেন। তিনি যদি উপার্জনক্ষম হন তবুও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাকে বাড়িতে যে পুরুষ সদস্য- স্বামী, শ্বশুর আছেন তাদের মতামতের ওপর নির্ভর করতে হয়। নারীর অগ্রযাত্রায় এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে একসময় আমরা দেখেছি, নারীরা ঋণ নিতেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতেন বাড়ির পুরুষ। এখানে এখন অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। নারীরা নিজেই স্বাবলম্বী হতে এগিয়ে এসেছেন। এই এগিয়ে আসার পেছনে রয়েছে শিক্ষা। গবেষণা বলছে, নারী যদি নূ্যনতম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ পায়, তাহলে তার সন্তান কখনও নিরক্ষর হয় না, অপুষ্টিতে ভোগে না। কিন্তু সমান শিক্ষা পাওয়া পুরুষের ক্ষেত্রে তার পরিবারে সেটি সবসময় সত্য নাও হতে পারে। বাংলাদেশেও আমরা এমনটি দেখেছি।
নারীর অগ্রযাত্রার কথা বলতে যেয়ে প্রায়শ আমাদের দৃষ্টিগোচরে আসে প্রধানত অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি- গার্মেন্ট, শিল্পকারখানা, চা শ্রমিক ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক জায়গাতে। কিন্তু এর বাইরেও নারীর অবদানের বড় একটা ক্ষেত্র হলো ইনফরমাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে।
টিকাদান কর্মসূচি বাংলাদেশের একটি সর্বজনীন সফল কার্যক্রম। এর পেছনেও রয়েছে নারী। আমরা পোলিও নির্মূল করতে পেরেছি। ডায়রিয়া হলে পানিশূন্যতায় শিশুর জীবন বাঁচাতে খাবার স্যালাইন বানানো ও খাওয়ানোর কাজটা প্রধানত মায়েরা করেছেন। এক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছে বেসরকারি সংগঠন, সরকার নীতিমালা দিয়েছে এবং নানাভাবে সহায়তা করেছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ঘরে ঘরে খাবার স্যালাইন বানানো শেখা ও কাজে লাগানো, এখানে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। এই রকম বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বড় বড় অনেক মাইলফলক- সেটি ক্ষুদ্রঋণ, টিকাদান বা খাবার স্যালাইন যা-ই বলি না কেন- এখানে প্রধানত কাজ করেছেন ঘরের নারীরা। এমন অনেক ক্ষেত্রই অনেক সময় আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়।
কিন্তু ঘরে-বাইরে নিরাপত্তাজনিত হুমকি নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে এখন বিশাল বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। অর্থ, বিত্ত, পেশিশক্তির কারণেই হোক অথবা পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতার জন্যই হোক, অথবা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়েই হোক- সন্ত্রাসীদের দ্বারা নারী ও মেয়েশিশুর লাঞ্ছিত হওয়ার ক্রমবর্ধমান ঘটনা আমরা নিয়মিত দেখতে পাচ্ছি, কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পরেও যদি এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে, তবে নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
তবে সরকার এর মাধ্যমে দুটি বার্তা দিয়েছে। প্রথমত, নারী ও মেয়েশিশুর সুরক্ষায় সরকারের শক্ত একটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই আইন একটা দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে, যেটা আমরা অ্যাসিড সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে দেখেছি। একটা ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরই এই অ্যাসিড সন্ত্রাস প্রায় থেমে গেছে। তাই বাংলাদেশের জন্য এই আইনটার হয়তো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এর পরও অনেক কথা আছে। আদালত পর্যন্ত তো বিচার প্রক্রিয়া আসতে হবে। তার আগের যে প্রক্রিয়া যেমন নথিপত্র, সাক্ষী-সাবুদ তৈরি করা- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্নিষ্ট সবাই যদি ঠিকমতো তৈরি করে দিতে না পারে, তাহলে তো আদালতও অসহায় হবে। আমরা দেখেছি, প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও সাক্ষী-সাবুদের অভাবে নারী নির্যাতনের মামলাগুলো মাত্র চার শতাংশের মতো বিচার হয়। কিছু বহুল আলোচিত মামলা, মানবাধিকার সংগঠন ও মিডিয়া যেটার সঙ্গে লেগে থাকে, অনেক সময় সেগুলোর বিচার শেষ পর্যন্ত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। যারা আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে এমন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে তথ্য আছে যে, অনেক ক্ষেত্রে আপস-মীমাংসা হয়ে যায়। গরিব ঘরের মেয়ে নির্যাতিত হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে, দেখা যায় টাকার বিনিময়ে মিটমাট করা হয়ে গেছে। নির্যাতিতার পরিবার আদালত পর্যন্ত আর যায় না। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণে বাল্যবিয়ের প্রবণতাও কমছে না। মা-বাবা মনে করছে, মেয়ে বড় হয়েছে, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে অথবা অন্য কোথাও বিপদ হতে পারে। এর চেয়ে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া ভালো। আর সে কারণেই বিশ্বে বাল্যবিয়ের হারে আমরা 'শীর্ষ দশের' মধ্যে আছি! নারীর এত অগ্রগতি সত্ত্বেও প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো এই বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতা আমাদের একটা জায়গায় থামিয়ে দিয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে পুরো সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সব সদিচ্ছাকে।
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা যা আমাদের ঘাড়ে এখনও চেপে বসে আছে- নারীর প্রতি সহিংসতার একটি বড় কারণ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের দেওয়া তথ্যমতে, এদেশের ৮০ শতাংশ নারী তার জীবনের কোনো না কোনো সময় নিজের ঘরেই নির্যাতিত হন। এটা অবশ্য এর আগে ৮৬ শতাংশ ছিল। এগুলোর বেশিরভাগই জনসমক্ষে আসে না। কারণ সামাজিকভাবে হেয় হতে হবে এই ভয়েই নারী তা প্রকাশ করে না। নির্যাতন সহ্য করেও সন্তানের জন্য অথবা সমাজের ভয়ে আমাদের দেশের অনেক নারী কোনো আইনি লড়াইয়ে যান না অথবা বিয়ে বিচ্ছেদ চান না। সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে নীরবে নির্যাতন সহ্য করে যান।
সমকালের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মুহূর্তে, যে সময়টা আমরা পৃথিবীব্যপী একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছি, একটা টর্নেডোর মতো সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে- সেখানে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতাগুলোও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার বা সমাজে নিরাপত্তার জায়গা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান। নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতার একটা চিত্র দৃশ্যমান।
মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যে দেখতে পাই, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০- এই নয় মাসে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অর্থৎ প্রতি মাসে একশ'র ওপরে, প্রতিদিন তিন থেকে চারজন নারী ধর্ষিত হয়েছেন! এর বাইরে আরও ধর্ষণের ঘটনা নেই, তা বলা যাবে না। সেসব খবর হয়তো মিডিয়ায় আসেই না।
নারীর ওপর সহিংসতার এই যে চিত্র, এটাই কিন্তু নারীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সহিংসতা যদি বাড়ে, নারীর অমর্যাদার ক্ষেত্রটা যদি বাড়ে এবং সেখানে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য বিষয়ও যুক্ত হয় যেমন- খাদ্য নিরাপত্তা, আয় নিরাপত্তার একটা নেতিবাচক প্রভাবে পড়ছে বাড়ির শিশুটি বিশেষ করে মেয়েশিশুর ওপর, ঘরের নারীর ওপর। তাই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিও এই করোনাকালে মানসিকভাবে ভালো নেই, বিপর্যস্ত অবস্থায় আছেন। এই মনো-সামাজিক নেতিবাচক প্রভাবগুলো এখন সারা পৃথিবীতেই ক্রমাগত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু করোনার অজুহাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এই করোনাকালে নারীর স্বাস্থ্য বেশিরকম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে জাতিসংঘ সাবধান করেছে। করোনাকে সামাল দিতে গিয়ে সব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই নাজুক হয়ে পড়েছে। আমাদের এখানেও আমরা দেখতে পেয়েছি, নারীর সাধারণ স্বাস্থ্যসহ প্রজনন স্বাস্থ্যের জায়গাটা অনেক বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে। এ বিষয়ে ইউএনএফপিএর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার মিটফোর্ড এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ- এই দুটি হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে একলাম্পশিয়ার রোগী এই করোনাকালে অনেক বেড়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে তারা আবিস্কার করেছে যে, প্রসূতি মায়েরা অন্য সময় যে চিকিৎসাসেবাগুলো পেত, সেগুলো এখন তাদের কাছে সহজলভ্য হচ্ছে না। যেমন নিয়মিত ব্লাডপ্রেশার চেক করা, খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা, পরামর্শ পাওয়া ইত্যাদি তারা পাচ্ছেন না। ফলে একলাম্পশিয়া রোগী বাড়ছে এবং এ কারণে সন্তান প্রসবের সময় সেই মায়ের মৃত্যুর আশঙ্কাও বাড়ছে। ইতোপূর্বে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার মতো বাংলাদেশের এই অর্জনের জায়গাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
আমরা যে অর্জনগুলো করেছিলাম, সেগুলো ধরে রাখা এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে ঝুঁকি প্রশমন করা, অর্জনগুলো ধরে রাখা এবং যেটুকু করোনার কারণে হারিয়েছি, তা পুনরুদ্ধার করা। সেটা শিক্ষায় হোক, স্বাস্থ্যে হোক আর অর্থনীতিতে হোক। বড় বড় এই তিনটা খাতে একটি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা গ্রহণ, যথাযথ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করা জরুরিভাবে প্রয়োজন। সেটা করা গেলে এদেশের নারীর অর্জনের যে উদাহরণগুলো আছে, সেগুলো সামনে রেখে বলতে পারি, নারী হোঁচট খেতে পারে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই উঠে দাঁড়াবে এবং এগিয়ে যাবে।
লেখাটা শেষ করতে চাই গত বছর নভেম্বরে মৌলভীবাজারের একটা ঘটনা দিয়ে। বাল্যবিয়ে বন্ধে আমরা মেয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের নিয়ে একটা আলোচনা শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছিলাম, স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। মৌলভীবাজারে এমন একটি আলোচনায় বসেছি, সেখানকার জেলা প্রশাসকও উপস্থিত ছিলেন। তিনি মেয়েদের বললেন, তোমরা স্টু্কলে যাওয়া-আসার পথে বখাটেদের নানা রকম উত্ত্যক্তের শিকার হও, অনেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দাও। আমরা এ বিষয়ে স্কুলে স্কুলে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা সমস্বরে বলে ওঠে, 'আমাদের পরামর্শক লাগবে না স্যার। আমরা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চাই, বাল্যবিয়ে চাই না। আপনারা কাউন্সেলিং করলে আমাদের মা-বাবাদের করেন, আর ওই বখাটে ছেলেদের করেন।' গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়েরা যখন সম্মিলিতভাবে এরকম কথা বলে, আমি তাদের জন্য আশান্বিত হই। নতুন প্রজন্ম এভাবে পথ দেখাচ্ছে, জীবন জেগে থাকবে। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com