শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষকদের অধিকার

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শাহজাহান আলম সাজু

বাংলাদেশে একনাগাড়ে ২০০ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও শিক্ষা সংকোচন নীতির ফলে শিক্ষা-দীক্ষায় আমরা অনেক পিছিয়ে ছিলাম। ১৯৪৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে শিক্ষকদের কোনো বেতনই ছিল না। শুধু দেশমাতৃকার টানে নির্লোভ কিছু মানুষ সে সময় শিক্ষকতা পেশায় নিজেদের নিবেদিত করতেন। একসময় শিক্ষক বলতে বুঝাত জীর্ণশীর্ণ চেহারা, চোখে ভাঙা ফ্রেমের ফিতা ঝুলানো চশমা, পরনে মলিন জামা-কাপড়, পায়ে ছেঁড়া জুতা, হাতে তালি দেওয়া ছাতা। তখন শিক্ষকদের সম্মান জানাতে তাদের বাড়িতে শিক্ষার্থীরা শাকসবজি, ফলমূল, গাভীর দুধ, পুকুরের মাছ পৌঁছে দিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৪ সালে সর্বপ্রথম সরকারি উদ্যোগে শিক্ষকদের মাসিক পাঁচ টাকা ভাতা চালু করা হয়।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার ভিত রচনা করেছিল। সে সময় তিনি একসঙ্গে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৬২ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেছিলেন। পাশাপাশি কলেজ শিক্ষকদের জন্য মাসিক ১০০ টাকা এবং মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের ৭৫ টাকা বেতন চালু করেন। বঙ্গবন্ধু সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। নিঃসন্দেহে শিক্ষকদের জন্য এটা অনেক গর্ব ও সম্মানের।

কালের বিবর্তনে আমাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের গত ১১ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তথাপিও সুদীর্ঘ ৪০ বছরের পুঞ্জীভূত সব সমস্যার সমাধান হয়নি। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে এখনও নানা সমস্যা বিরাজমান রয়েছে।

সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে বেতন পান তা মোটামুটি সম্মানজনক। বেসরকারি শিক্ষার আবার বহু রকম বিভাজন রয়েছে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যে বেতন পান তা দিয়ে সম্মানজনক জীবনযাপন অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তারপরও তারা কোনোরকম চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এমপিওবহির্ভূত শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। এ ধন্যতা রাষ্ট্রের। এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি মর্যাদার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আবার শুধু আর্থিক সচ্ছলতার ওপরই একজন শিক্ষকের মর্যাদা নির্ভর করে না। শিক্ষকতা পেশা যেহেতু জ্ঞানচর্চা বা জ্ঞান বিতরণের, তাদের রাষ্ট্র বিনির্মাণ কিংবা পরিচালনার ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। একসময় বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানসহ অনেক শিক্ষকই জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বর্তমানে জাতীয় সংসদে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব একবারেই নগণ্য। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রাজ্য সভা এবং বিধান সভায় শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব অন্যান্য যে কোনো পেশার চেয়ে বেশি। উন্নত বিশ্বে তা আরও বেশি।

জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৮% এবং সর্বশেষ ডাকারে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের সভায় আপাতত জিডিপির ৬% বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ সরকারও এই সিদ্ধান্তে স্বাক্ষরকারী দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে জিডিপির ২.৪-২.৫%-এর বেশি বরাদ্দ সরকার দিতে পারেনি।

তবে আশার কথা হলো, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষক সদ্য প্রয়াত প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান কিংবা প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম স্যার আসন গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি নিজে আসন গ্রহণ করেন না। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের প্রতি এতটা শ্রদ্ধাশীল সে দেশের শিক্ষকরা অবহেলিত থাকতে পারেন না। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপিও একজন গর্বিত শিক্ষক মায়ের সন্তান। সুতরাং শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদার বিষয়ে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে- এই প্রত্যাশা সবার।

শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা বিশেষ করে কভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে একটি টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আজ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তাতে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য অতিরিক্ত অর্থ জোগান দেওয়ার সক্ষমতা সরকারের রয়েছে। এখন প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হলে নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তানরা স্বল্প খরচে পড়ালেখার সুযোগ পাবে। ফলে শিক্ষার হার বাড়বে; যা এসডিজি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের চাকরির নিশ্চয়তা, মর্যাদা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান বৃদ্ধি পাবে। ঐতিহাসিক মুজিব জন্মশতবর্ষেই শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক- এই প্রত্যাশা সবার।

তবে শিক্ষকদেরও মনে রাখতে হবে, শিক্ষকতা শুধু চাকরি নয়। তাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষক মানে আলোক শক্তির আঁধার। মোমবাতির মতো শেষ বিন্দু পর্যন্ত জ্বলে সমাজকে আলোকিত করাই তার ব্রত, মহত্ত্ব।

লেখক

সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ,

ফার্স্ট সেক্রেটারি, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব টিচার্স ইউনিয়ন


© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com