আত্মসূত্র

ধুতি-লুঙ্গি দ্বন্দ্বসমাস ও দ্বিজাতিতত্ত্ব

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

--

গ্রামবাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পোশাক কী ছিল? প্রশ্নটির উত্তর-সন্ধানের আগেই বলে নিই যে, 'সংখ্যাগরিষ্ঠ' এবং এর বিপরীতে 'সংখ্যালঘিষ্ঠ' বলতে আমি কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কথা বোঝাতে চাচ্ছি না। সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সাধারণভাবে যারা 'সাধারণ মানুষ' বলে পরিচিত, অর্থনৈতিক বিচারে যারা বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত বা স্বল্পবিত্ত, তারাই 'সংখ্যাগরিষ্ঠ'; এর বিপরীত অবস্থান যাদের তারাই 'সংখ্যালঘিষ্ঠ'।

উত্তরে যদি বলি 'ন্যাংটি', তা হলে অনেকেই হয়তো এটিকে ঠাট্টা বলে মনে করবেন। কিন্তু আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না, একেবারে আক্ষরিক অর্থে যাকে ন্যাংটি বলে তা হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের সকলের পোশাক ছিল না, তবু কোমরে যেটুকু কাপড় জড়িয়ে রেখে কোনো রকমে লজ্জা-নিবারণের ব্যবস্থা করা হতো তাকে ন্যাংটিরই একটুখানি শোভন সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। (ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে 'ন্যাংটি' শব্দটা তো 'লেঙ্গটা' বা 'লেঙ্গটি' শব্দেরই উচ্চারণভেদ মাত্র। আর 'লেঙ্গট' শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতি 'লিঙ্গপট্ট' থেকে, যার আভিধানিক অর্থ দাঁড়িয়েছে- 'পুরুষের লজ্জাস্থান মাত্র আবৃত করে এমন কৌপীন বিশেষ।')

সচেতন পরিকল্পনামাফিক তৈরি গান্ধীজির সংক্ষিপ্ত পরিধেয় তো ছিল একান্তই শৈল্পিক, তবু সাম্রাজ্যবাদী চার্চিল গান্ধীকে বলতেন 'আধা-ন্যাংটা ফকির'। সে-বিচারে গ্রামবাংলার মেহনতি কৃষকদের অনকেকেই 'সিকি ন্যাংটা'র বেশি কিছু বলা যেত না নিশ্চয়। ছেলেরা তো আট/নয় বছর বয়স পর্যন্ত ন্যাংটিও পরতো না, ন্যাংটাই থাকতো।

'ভদ্রলোক'দের রীতিনীতি 'ছোটলোক'দের কাছে সব যুগেই অনুকরণযোগ্য বিবেচিত হয় বলে, গ্রামবাংলার 'ছোটলোক'রা যে পোশাকে-আশাকে ভদ্রলোকদেরই অনুকরণ করবে, তেমনটিই তো স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিক অনুকরণ-মূলক আচরণ থেকেই সমস্ত বাঙালি জাতির জন্যে সর্বজনমান্য না হলেও বহুজনমান্য একটা পোশাক রূপ পেয়ে যায়। সংখ্যালঘু ভদ্রলোকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি, ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে, যে-পোশাক পরতো তার নাম ধুতি। কালের বিবর্তনে এই ধুতিই ইতর-ভদ্র সকল বাঙালির স্ট্যান্ডার্ড পোশাক হিসেবে মান্যতা পেয়ে যায়। প্রথমে এই ধুতির সঙ্গে ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত করার জন্যে ছিল চাদর নামক অপর একটি বস্ত্রখণ্ড, পরে তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয় পাঞ্জাবি। অনেক কাল ধরে ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদরের কম্বিনেশনই 'ভদ্র' বাঙালির পরিচিতিকে ধারণ করে এবং 'ইতর' সাধারণও এই পরিচ্ছদকেই জাতে ওঠার জন্যে মনে করে অপরিহার্য।

ধুতি বোধ হয় ন্যাংটিরই সম্প্রসারিত রূপ, তাই এখনও ন্যাংটি হচ্ছে ধুতির একান্ত অনুষঙ্গ। ধুতিটাকে কোমরে পেঁচিয়ে এর বাঁ দিকের যে-অংশটাকে সামনে থেকে পেছনে নিয়ে গুঁজে দেয়া হয়, সেটি আসলে ন্যাংটিরই ভদ্র সংস্করণ হয়ে নাম পেয়েছে কাছা (সংস্কৃত 'কচ্ছ' শব্দের তদ্ভব রূপ)। কাছারই বিপরীত কোঁচা। অর্থাৎ, ধুতির ডান দিকের যে-অংশটাকে পাট করে সামনের দিকে ঝুলিয়ে দেয়া হয় তারই নাম কোঁচা।

এই কোঁচাটি তো শুধু পাট করা কাপড় মাত্র নয়, সমাজে এটি অহংকার ও মর্যাদার প্রতীক। সমাজে, বিশেষ করে ভূসম্পত্তিকেন্দ্রিক সমাজে, ব্যক্তির অহংকার ও মর্যাদা নির্ধারণ হয় মূলত বংশ পরিচয় দিয়ে। এরপর বিত্ত ও বিদ্যার স্থান। এ-সবের অনেক কিছুই ঘাটতি আছে যাদের তারাও যখন অহেতুক অহংকারবশে মর্যাদাসম্পন্ন হতে চায়, তখন আশ্রয় নেয় ওই সমাজ-স্বীকৃত প্রতীকটির। প্রতীকটি দিয়েই আসলটি না-থাকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায়, প্রতীকের প্রদর্শনী দিয়েই অপরকে বিভ্রান্ত করে নিজে তৃপ্ত হতে চায়। সব সময় যে সবাইকে বিভ্রান্ত করে রাখা যায় তা অবশ্যই নয়। লোকের কাছে প্রতারণটা ধরা পড়ে যায় বলেই তো ওই ধরনের কপটাচারী পোশাকধারীদের সম্পর্কে প্রবাদ তৈরি হয়েছে- 'বাইরে কোঁচার পত্তন, ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন'।

এ-রকম কপটাচারী যারা নয়, তারাও অবিশ্যি তথাকথিত ভদ্র সমাজ-নির্ধারিত প্রতীকগুলোকে মান্য না করে পারে না। আটপৌরে জীবনে যেমন-তেমন করে চালিয়ে দিলেও বিশেষ দিন-ক্ষণে বা বিশেষ স্থানে ওই প্রতীকাশ্রয়ী তাদের হতেই হয়। কিন্তু সঙ্গতিতে কুলোয় না বলে ওই প্রতীকটিকে তারা কখনো ধরতে পারে না। তখন তারা প্রতীকেরও প্রতীক বানিয়ে তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়, এবং সেটাই তাদের সামাজিক প্রথায় দাঁড়িয়ে যায়।

কথাগুলো খুবই অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে গেল। বাস্তব দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট করে নেয়া যাক।

গ্রামের একজন সাধারণ গৃহস্থ কৃষক বা স্বল্পবিত্ত মানুষের চোখেও ধুতি-চাদর-জুতা পরা ভদ্রলোকরা সল্ফ্ভ্রমের উদ্রেক করে। কিন্তু সে নিজে ওই পোশাকটি পরতে পারে না। কেবল যে আর্থিক অসংগতির জন্যেই পারে না, তা নয়। জীবিকার জন্যে তাকে যেভাবে সব সময় জলকাদায় ধূলিমাটিতে গড়াগড়ি দিতে হয়, তাতে ওই পোশাকটি পরে 'বাবু' সেজে বসে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। অথচ, বাবুর প্রতীক ওই পোশাকটির প্রতি তার ভারি দুর্বলতা।

উৎসবের দিনে বা কুটুম বাড়িতে গেলে, এ-পোশাকটি পরে সে বাবু হওয়ার খায়েশ মেটায়। সকলে অবিশ্যি তা-ও পারে না, দারিদ্র্যই সে-ব্যাপারে বাধা। তারা অনেকেই, আমি দেখেছি, খাটো একটা ধুতি পরে, কারও কাছ থেকে চেয়ে-চিস্তে-আনা একটা পাঞ্জাবি বা শার্ট (তা-ও আবার হয়তো ছেঁড়া) কাঁধের ওপরে ফেলে (গায়ে দিয়ে নয়) আত্মীয় বাড়ি যায়। এটিতেই তার বাবুত্বের শখ মেটে এবং এটিকেই আমি বলছি প্রতীকের প্রতীক সৃষ্টি। সারা রাস্তা জলে-কাদায় খালি পায়েই হেঁটে যায়, জুতা জোড়া থাকে হাতে। তারপর কুটুম বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে কোনো পুকুরে বা ডোবায় পা ধুয়ে নিয়ে জুতা জোড়া পায়ে দেয় ও কুটুম বাড়িতে গিয়ে ওঠে। গ্রামাঞ্চলে এমন দৃশ্য, চল্লিশ/পঞ্চাশ বছর আগেও, অনেকেরই নিশ্চয় চোখে পড়েছে।

যাই হোক, বলছিলাম ধুতির কথা। ধুতিই হয়ে উঠেছিল হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল বাঙালির স্বীকৃত পোশাক। কাজী নজরুল ইসলামের মতো সমন্বয়বাদী কবি যেমন ধুতি পরতেন, তেমনি পরতেন আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মতো মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী লেখক, সাংবাদিকও। কোট-প্যান্ট পরা সাহেব বাঙালিও অবশ্যই ছিলেন, তবু বাঙালি মাত্রেরই ধুতির প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগ। তাই, রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতার' অতি-আধুনিক বিলাতফেরত নায়ক অমিত রায় বা অমিট্রেকেও অতি যত্নে ধুতি-পাঞ্জাবি পরতে দেখি। 'আধুনিক' বলে যাঁরা পরিচিত হতে চাইতেন তাঁরাও, চল্লিশের দশকেও, কোট-প্যান্টের চেয়ে ধুতি-পাঞ্জাবিকেই বেশি মর্যাদা দিতেন। এরই প্রমাণ পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রকাশিত কোনো এক অজ্ঞাতনামা কবির একটি ব্যঙ্গ কবিতাতেও। তখনকার একটি রম্য পত্রিকায় 'আধুনিক' শিরোনামে এই কবিতাটি ছাপা হয়েছিল। একজন যুবককে 'আধুনিক' হতে হলে কী কী করতে হবে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে তারই বর্ণনা দিয়ে কবি লিখেছিলেন,-



রোগা লিকলিকে চেহারাটা হবে,

বুকের পাঁজরা সব দেখা যাবে।

দিতে হবে চুলে বিশিষ্ট ছাঁট,

বিলিতি সেলুনে ইংলিশ কাট।

গোঁফদাড়ি হবে অলওয়েজ সাফ,

পায়েতে নাগরা, নিউকাট বাফ।

গোড়ালি অবধি আদ্দি চড়াবে,

ফিনফিনে ধুতি ধূলায় ছড়াবে।

পায়ে নাগরা জুতো, পরনে নিম্নাঙ্গে ধুতি ও ঊর্ধ্বাঙ্গে আদ্দির পাঞ্জাবি- এ-রকম যুবকটির চলন-বলন ও প্রেম করার ধরন-ধারণ কেমন হবে, সে-সবের ফিরিস্তি দিয়ে কবি কবিতাটি শেষ করেছেন এ-ভাবে-

লিখিলাম যা যা ফলো করো ঠিক,

হাতে যদি চাও 'আ-ধু-নি-ক'।

কিন্তু চল্লিশের দশকের মাঝামাঝিতে এসেই দেখা গেল এই আধুনিকতার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভক্তি ঘটে গেছে। এক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ধুতি বিদায় নিয়ে এসেছে পায়জামা, পাঞ্জাবির ওপর চেপে বসেছে শেরওয়ানি। এটা অবিশ্যি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত সংখ্যালঘুদের বেলায়। সে-সম্প্রদায়ের গাঁও-গেরামের বাসিন্দা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের পক্ষে পায়জামা মোটেই সহজলভ্য বা সর্বদা ব্যবহার্য হয়ে ওঠেনি। তাদের পোশাক বদলটা আধুনিকতার চর্চার জন্যে নয়, পাকিস্তান-আন্দোলনের সমর্থনে সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যকে স্পষ্ট করে তোলার জন্যে। তারা তাই ন্যাংটি বা কাছা পরিত্যাগ করে হয়ে গেল বিকচ্ছ- ধুতি ছেড়ে ধরলো লুঙ্গি। বাংলার সমাজ-ব্যাকরণে যুক্ত হলো একটি নতুন অধ্যায়- ধুতি-লুঙ্গি দ্বন্দ্বসমাস।

ছেচল্লিশ সনের নির্বাচনের সময়ই ব্যাপারটা স্পষ্ট রূপ ধরলো বলা চলে। আমাদের রামপুর প্রাইমারি ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সোনাফর উদ্দিন সাহেবকে ধুতি পরতেই দেখে এসেছি এতদিন, কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল ধুতি ছেড়ে তিনি লুঙ্গি ধরেছেন। এ-রকম আশপাশের সবাই। কোনো মুসলমানকে ধুতি পরতে দেখলে তাকে নিয়ে রীতিমতো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুরু হয়ে যেত।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com