
জীবন জেগে থাকবে
উন্নতি ও অগ্রগতির বন্ধন চাই
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

পুঁজিবাদের বিশ্বময় বাজারি কারবারে সর্বত্রই আজ এক ত্রাহি ত্রাহি দশা। বিশ্বজুড়ে এই পুঁজিবাদের অতিসাম্প্রতিক অবদানটা হচ্ছে করোনাভাইরাস। পুঁজিবাদের সে প্রতিনিধি এবং নিজেও সে পুঁজিবাদী চরিত্রসম্পন্ন। পুঁজিবাদীদের একটি গণমুখপত্র হচ্ছে আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন। করোনা মহামারির তাণ্ডব দেখে সে পত্রিকা মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছে যে, এই আক্রমণ ইতোমধ্যেই Ôis challenging our assumptions about humanity, about society, about greed and selfishness, about the need to cooperate[...]]।' খুবই খাঁটি কথা। বিপদে পড়লে অনেক সময় খাঁটি কথা বের হয়ে আসে বৈকি। প্রাণের টানে। মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যসমাজ সম্বন্ধে আমরা অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতাম। আমরা অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিশ্বের সুবিধাভোগীরা এবং তাদের প্রভাবে পড়ে সুবিধাবঞ্চিতরাও। করোনার আক্রমণে সেসব ধারণার ভূলুণ্ঠিত হওয়ার দশা। সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে আত্মস্বার্থকেন্দ্রিকতা ও লোলুপতা। ওগুলো অবশ্য ছিল, যতই সভ্য হওয়ার চেষ্টা করুক, মানুষ তো প্রাণীই বটে, প্রাণী-জগতেরই এক সদস্য; আত্মস্বার্থকেন্দ্রিকতা ও ভোগলিপ্সা তো তার থাকবেই, আর ওগুলো জয় করেই তো সভ্যতার অগ্রগতি। কিন্তু জয় করা যে মোটেই সম্ভব হয়নি, করোনা এসে এক নিমেষে সেই খাঁটি সত্যটাই উন্মোচিত করে দিল। বলল বাঁচতে হলে পালাও, গুহার ভেতর ঢোকো। অন্যের সঙ্গে মিলবে না। দূরে দূরে থাকবে। মনে করবে সবাই তোমার শত্রু। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলো। শারীরিক দূরত্বকে যে সামাজিক দূরত্ব বলা হচ্ছে এটা নিতান্ত আপতিক নয়, ঘটনা আসলে সামাজিক দূরত্বই। মানুষ যদি মানুষকে দেখে ভয় পায়; পরস্পরের হাত ধরবে কি, বরং হাত যাতে না ধরতে হয় তার বন্দোবস্ততে যদি সে সর্বক্ষণ উদগ্রীব থাকে, তাহলে তো বুঝতেই হবে যে, মানুষ তার সামাজিকতার সবটাই খুইয়েছে। আর সামাজিকতা না থাকলে তো মানুষ আর মানুষই থাকে না, পশুতে পরিণত হয়। সেটাই ঘটছে। রোগী দেখলে প্রতিবেশী সাহায্য করবে কি দৌড়ে পালাচ্ছে। রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ পিতামাতা মারা গেলে কাফন-দাফন করতে হবে ভয়ে পরিচয়ই দিতে চাচ্ছে না সন্তানরা; এমনও হয়েছে লাশ ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুত সটকে পড়েছে। অবিশ্বাস্য? হ্যাঁ, অবিশ্বাস্যতাই ঘটছে।
টাইম ম্যাগাজিন 'কোঅপারেশন'-এর আবশ্যকতার কথা বলেছে। কার বিরুদ্ধে? টাইমওয়ালারা অবশ্যই বলবে করোনার বিরুদ্ধে। বলে ক্ষান্ত দেবে। করোনা একটা ভয়াবহ রোগ, তার হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে হবে, সে জন্য সমবায়ী উদ্যোগে টিকা আবিস্কার চাই। কিন্তু আসল ব্যাধি তো করোনা নয়, সেটির নাম তো পুঁজিবাদ। সেই ব্যাধিই তো এই রোগকে পাঠিয়েছে। আর পুঁজিবাদের যেটা আসল স্বভাব- উন্নত করার নাম করে মানুষকে মারার ব্যবস্থা করা, পুঁজিবাদ সেটিই করছে। সে জন্যই বলা দরকার যে, ঐক্য চাই কেবল করোনাকে নয়, পুঁজিবাদকে পরাভূত করার লক্ষ্যেও। মেহনতিরা মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান যে বস্তু সেই প্রাণটিই দিয়ে দিচ্ছে। দিতে বাধ্য হচ্ছে। হ্যাঁ, ধনীরাও আক্রান্ত হচ্ছে বৈকি। ব্রিটেনের যুবরাজ, সেখানকার প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী- এরাও আক্রান্ত হয়েছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, যিনি সদাসর্বদা গর্জন করেন ফিলিস্তিনিদের গিলে খাবেন বলে, তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন সস্ত্রীক। ব্রাজিলের ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট করোনা কিছু না, ইনফ্লুয়েঞ্জা মাত্র, তাই ভয় করার কিছু নেই বলে তুড়ি বাজিয়েছেন এবং দম্ভভরে বলেছেন তার নিজের জন্য কোনো পরোয়াই নেই কারণ বয়স যদিও পঁয়ষট্টি তবু তিনি একজন ক্রীড়াবিদ; শেষ পর্যন্ত তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন। বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শ মতো ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক ওষুধের ওপর তিনি ভরসা করেছিলেন, কাজ হয়নি। জার্মানরা মনের শক্তিতে বিলক্ষণ বলীয়ান বলে পরিচিত, কিন্তু জানা গেছে তাদের অর্থমন্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। যা দেখেছেন ও দেখবেন বলে ভয় পেয়েছেন তা সহ্য করতে পারেননি। সব মৃত্যুই দুঃখজনক ও শোকাবহ। কিন্তু আমরা বিশিষ্টজনের মৃত্যুর খবরই শুধু জানতে পারি। মেহনতিদের প্রাণ ত্যাগের খবর কে রাখে? তারা মারা যাচ্ছে হাজারে হাজারে। যারা বাঁচছে তারাও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছে। কিন্তু তারা তো পরিসংখ্যানের অকিঞ্চিৎকর সংখ্যা মাত্র; সম্পদ বলতে আছে শুধু একটা প্রাণ, আক্রান্ত হয়ে ওটি ত্যাগ করেই কোনোমতে যন্ত্রণামুক্ত হচ্ছে।
দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে আর দরিদ্ররা আরও দরিদ্র। এটি সামাজিক সমস্যা। এই বৈষম্যের মীমাংসা করতে হলে সমাজকে বদলাতে হবে। দেশের উন্নতি হচ্ছে কিন্তু অগ্রগতি হচ্ছে না। দুটি একসঙ্গে না হলে বৈষম্য কমবে না। করোনা এসে বৈষম্যের এই সামাজিক ব্যধিকে চূড়ান্তভাবে উন্মোচিত করে তুলেছে। বেকার সমস্যার কোনো আশানুরূপ সমাধান হয়নি। মহামারির কারণে বেকার সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বেকারদের এই বড় অংশ বাইরে রেখে দেশের সার্বিক উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। প্রথমত, বেকার সমস্যা দূরীকরণে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দেখতে চাই। দ্বিতীয়ত, হ্রাস চাই বৈষম্যের ক্ষেত্রে।
দেশে সার্বিকভাবে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা, গুম, হত্যাকা, ছিনতাই, গণধর্ষণ, শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রটা গড়ে উঠেছে বৈষম্যমূলকভাবে। এর মধ্যে নতুন এই করোনাভাইরাস যোগ করেছে সীমাহিন অনিশ্চয়তা। এ অনিশ্চয়তা হয়তো একদিন কেটে যাবে; কিন্তু যা কাটবে না তা হলো শিক্ষার এই বৈষম্যমূলক কাঠামো। সমাজের বৈষম্যকে যা প্রতিনিয়ত আরও গভীর ও সুদূরপ্রসারী করে তুলছে।
দেশের স্বাধীনতার জন্য যে অসামান্য মূল্য দিতে হয়েছে, আমরা তার প্রকৃত অর্থ খুঁজব কোথায়? খুঁজতে যদি হয় তবে খুঁজতে হবে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের পথে অগ্রসর হওয়ার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেই সম্ভাবনার মধ্যে। অগ্রসর হওয়ার পথে অন্তরায় আছে অনেক, দুস্তর অন্তরায় আছে দারিদ্র্য ও শোষণে; কিন্তু তার চেয়েও নিকটবর্তী অন্তরায় বোধ করি যথার্থ শিক্ষার অভাব।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে তিনটি- চাকরিজীবী সৃষ্টি করা, সংস্কৃতিবান ভদ্রলোক সৃষ্টি করা এবং বিবেকবান ও সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টি করা। দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাটি পত্তন করা হয়েছিল চাকরিজীবী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। কিন্তু চাকুরে নয়, ভদ্রলোকও নয়, মানুষ সৃষ্টি করাই যে শিক্ষার মূলকথা হওয়া উচিত- এ সত্যটা সকলেই মান্য করেন। কিন্তু ওই সত্য মান্য করা আর সত্যিকার মানুষ সৃষ্টি করা এককথা নয়। দারিদ্র্যের যে হৃদয়হীন বন্ধনে আমরা আটকা পড়েছি, তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আজ ভীষণভাবে দরকার কারিগরি কৌশলের; দরকার দক্ষ, কর্মনিপুণ, বুদ্ধিমান মানুষের। এ প্রয়োজনের সত্যটি আমাদের চোখের সামনে রাখতে হবে অবশ্যই। কিন্তু রাখতে গিয়ে খেয়াল রাখা আবশ্যক হবে, যাতে মুহূর্তের জন্যও চোখ ফিরিয়ে না নিই অন্য একটি সত্য থেকে। সেটি হলো এই যে কৌশলজ্ঞান, দক্ষতা, কর্মনিপুণতা- এসব ব্যাপার চালু রাখার ব্যাপার, সৃষ্টিশীলতার ব্যাপার নয়। কিন্তু শুধু সৃষ্টি নয়, হৃদয়ের চর্চার মধ্য দিয়ে একাকিত্বের বোধ কেটে যায় মানুষের। এক হৃদয়ের সঙ্গে অন্য হৃদয়ের মমত্ব যখন গড়ে ওঠে, তখন আর আমরা ক্ষুদ্র থাকি না, সামান্য থাকি না- তখন ব্যাপ্ত, বিস্তৃত, বৃহৎ হয়ে পড়ি। তখন শুধু মানুষ নয়, যুক্ত হই প্রতিপার্শ্বের সঙ্গেও। যখন বুঝি আমরা একা নই, তখন হতাশা আসে না সহজে, বিষণ্ণতা আসে না স্বল্পসুযোগে। এই বাংলাদেশে মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টির কাজে যত কায়দা-কৌশল চালু আছে, অন্য কোনো কিছু সৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমন আছে বলে মনে হয় না। বিচ্ছিন্নতার জায়গা মিলনকে প্রতিষ্ঠার জন্য হৃদয়ের পরিচর্যা করা খুব বেশি করে প্রয়োজন।
অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বন্ধন থেকে মুক্তি চাই, ভাগ্য পরিবর্তনের বিপুল-প্রবল উদ্যম, আর সে জন্যই হৃদয়ের শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে চাই বুদ্ধির শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে, যাতে করে অনুভব ও ধারণা, আবেগ ও জ্ঞান, কল্পনা, বুদ্ধি একত্রে কাজ করতে পারে, যাতে করে হৃদয় ও মস্তিস্কের সুবর্ণ সংযোগে আমরা নতুন জীবনের পথে অগ্রসর হতে পারি সবল ও সমর্থ পদক্ষেপে। পানির প্রবল স্রোতকে বশ করে যেমন আমরা বিদ্যুৎশক্তি এনেছি, তেমনি করে আবেগ থেকে অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা আনতে হবে, নইলে বন্যা আসবে দুর্গতিকে মাথায় নিয়ে।
তথাকথিত আদর্শবাদের আমরা বিস্তর প্রশংসা করি, কিন্তু এই আদর্শবাদের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার যদি থাকে, তবে সেই আদর্শবাদে হৃদয়ের অপকার ভিন্ন উপকার হয় না। আমাদের দেশে হৃদয়কে অবজ্ঞা করার অভ্যাস অতিশয় পুরাতন। শুধু অবজ্ঞা নয়, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই ব্যবস্থা আছে অতিশৈশবে আমাদের হৃদয়কে ক্ষীণপ্রাণ করার। শিশুকে আমরা প্রায় কখনোই শিশু হিসেবে বিবেচনা করি না। শিশু যাতে শৈশবে শিশু থাকে, তার ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দার্শনিক রুশো দিয়েছেন। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ সেই পরামর্শ মেনে নিয়েছে, আমরা পারিনি। শিশুর জগৎ কাচের চেয়েও ভঙ্গুর। এই অতিভঙ্গুর জগতের ওপর সমাজ ও সংসারের দোর্দ প্রতাপেরা এমন বিক্রম ও নিষ্ঠুরতায় ঘা দিতে থাকে যে, জগৎটা ভেঙে খানখান হয়ে যায় অচিরে, আনন্দ ও কল্পনার মূল্যবান উপকরণগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে এখানে-সেখানে। শত বছরের বঞ্চনা ও দুর্গতির বোঝা শিশুর দুর্বল হৃদয়ের ওপর চেপে বসে দয়ামায়া না করে। পিতামাতার দুর্বহ দুঃখ, সংসারের দুঃসহ বীভৎসতা, চারপাশের মর্মভেদী ক্রন্দন- এসবের শক্ত বোঝা বইতে গিয়ে সামান্য শিশুর ছোট্ট হৃদয়টি একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়ে। হৃদয়ের বাকি জীবনটা কাটে পঙ্গুত্বের ভেতরই। জীবন মানে তখন ক্ষয়রোগীর মতো ধুঁকতে থাকা, ধুঁকতে ধুঁকতে অকালমৃত্যুর দিকে এগোতে থাকা, যতটা পারা যায় বিলম্বিত করা অন্তিম মুহূর্তের আগমনকে। হৃদয়হীন সংসার হৃদরোগের খোঁজও করে না। অথচ হৃদরোগই আসল রোগ- ব্যক্তির জীবনে যেমন, সমাজের জীবনেও তেমনি। সংসারে যাদের অনেক আছে, তাদের সন্তানরা আদর-যত্ন যথেষ্ট পায়, দেহের খাদ্য পায় প্রচুর পরিমাণে, কিন্তু সেখানেও শিশুর শৈশব মারা যায় শৈশবেই। দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্কদের ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার চাপে সেখানেও শিশু তার সারল্যকে রক্ষা করতে পারছে না কোনোমতেই। বাস্তুহারা শিশু আশ্রয় খুঁজছে বয়স্কদের স্বাস্থ্যহীন জগতে।
ফলে প্রায় কোনো শিশুই শিশু থাকে না শৈশবে; বয়স্ক মানুষের অপ্রাপ্তবয়স্ক সংস্করণ হয়ে ওঠে, প্রাপ্তবয়স্কদের দুঃখ ও দুশ্চিন্তা, ঘৃণা ও ভয় তার ভেতরটাকে লোলচর্ম বৃদ্ধে পরিণত করে। বয়স যখন বাড়ে, তখন এই নিরীহ ও অপমানিত শৈশব স্বভাবই বড় রকমের প্রতিশোধ নেয় প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনের নানান জায়গায় হানা দিয়ে সে যখন তখন, যা তা উৎপাত উপদ্রবের সৃষ্টি করে। এই জন্যই বয়স্ক শিশুর এত বেশি প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে। যতই চেষ্টা করুক, শিক্ষাব্যবস্থা কিছুতেই পরিণত, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তৈরি করে উঠতে পারে না। গলদ থেকে যায় একেবারে গোড়াতেই। নাজুক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তির ওপর উচ্চশিক্ষার যে নিতান্ত নড়বড়ে ব্যবস্থাটি আমরা গড়ে তুলেছি, তা খুব একটা কাজে লাগে না। তার চেয়েও বড় কথা, সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থার সব মহল ঘুরে এসেও প্রাণের খোঁজ পাওয়া যায় না।
শিক্ষা তো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপার নয়, ব্যাপার পরিবার ও সমাজেরও। সমাজই শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত করে সবকিছুকে। শিক্ষক যখন পড়াতে বাধ্য হন যে, রাজনীতি মহাপাপ; তখন দেখা যায় যে সমাজে কল্যাণকর পরিবর্তন যা আসছে তা ওই মহাপাপের পথ ধরেই। শিক্ষা ও সমাজের মাঝখানে এ রকমের ফাঁক থাকলে সেই ফাঁকে শিক্ষাদানের সমুদ্দেশ্য তলিয়ে যেতে বাধ্য। অন্যদিকে আবার এও সত্য যে, বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করার জন্য সমাজের শিক্ষাকে ভুলে যাওয়া আবশ্যক। সমাজ যদি মানুষে মানুষে অসাম্য শেখায়, তাহলে বিদ্যালয়ে সাম্যের শিক্ষা পত্তনের আগে প্রয়োজন হবে সামাজিক কুশিক্ষার দুষ্ট চারা উপড়ে ফেলা। এটা একটা অতিরিক্ত কর্তব্য। চারুকলা বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে একবার তার দায়িত্বের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, ছাত্রদের আঁকতে শেখানোর আগে তার কাজ হয় যে, ভুল আঁকা তারা বাইরে থেকে শিখেছে, সেটা ভুলতে শেখানো। এই দায়িত্বটা সকল শিক্ষকেরই। সমাজ প্রতিনিয়ত ভুল শিক্ষা দিচ্ছে, বিশেষ করে হৃদয়কে- শিক্ষা দিচ্ছে স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, ঈর্ষা, ভীতি।
আমরা বলি শিক্ষকরা আদর্শ নাগরিক তৈরি করবেন। কথাটার তাৎপর্য বিবেচনা করে দেখার মতো। আদর্শ নাগরিক বলতে আমরা বুঝি যোগ্য, দক্ষ, প্রশংসাভাজন মানুষ। অর্থাৎ কিনা এমন মানুষ, যার সঙ্গে সমাজের কোনো বিরোধ বাধবে না, সমাজের ব্যবস্থাটাকে যে মেনে নেবে, মেনে নিয়ে খারাপ স্কুলের ভালো ছাত্রের মতো দেদীপ্যমান হয়ে উঠবে। তাই এ কথা বলা দরকার যে, এটা পর্যাপ্ত নয়। আমরা শুধু আদর্শ নাগরিক চাই না, চাই উপযুক্ত মানুষও। উপযুক্ত মানুষেরাই যে কোনো পরিস্থিতিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতির উপযুক্ত বন্ধন ঘটাতে পারবে।
লেখক
প্রাবন্ধিক
শিক্ষাবিদ
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com