
শ্রদ্ধা
নিসর্গ-ক্যানভাসের শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সঞ্জয় ঘোষ

জন্ম : ১ নভেম্বর ১৯৩৫; মৃত্যু : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮
বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের একজন ছিলেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর। আমাদের চিত্রকলায় আধুনিকতার পথ নির্মাণ ও সৃজনযাত্রায় তিনি অগ্রণী চিত্রকর হয়ে উঠেছিলেন। ক্যানভাসের ব্যাপ্তি ও বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে বাংলার নিসর্গ ও মানুষের নানা অনুষঙ্গ তাকে করে তুলেছিল পঞ্চাশ দশকের খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন। গত ১ নভেম্বর ছিল এই খ্যাতিমান শিল্পীর ৮৬তম জন্মদিন। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ১৯৩৫ সালের ১ নভেম্বর সাতক্ষীরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার সৃষ্টিকর্মের বেশিরভাগই গ্রামবাংলার জীবন ও নিসর্গ নিয়ে। প্রকৃতি ও ঋতু পরিবর্তন তার চিত্রকর্মের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের বিখ্যাত প্রদর্শনী ও সিরিজগুলোর মধ্যে রয়েছে- 'আত্মার উজ্জীবন', 'উল্লাস', 'ধ্বনি', 'অজানা অন্বেষা'। তার নানা চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে করা কাজ 'আত্মার উজ্জীবন' উল্লেখযোগ্য।
সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ক্যানভাসে যেমন সযত্নে উঠে এসেছে বাংলার সরল প্রকৃতি ও মানুষের নানা অনুষঙ্গ, তেমনি তার নির্মাণশৈলীতেও ছিল সহজ ছন্দ। ক্যানভাসে বিস্তীর্ণতা ও শূন্যস্থানের ব্যবহার আর রঙের সহজ প্রকাশভঙ্গি তার কাজের স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করেছে। নিসর্গ প্রাধান্যতার সঙ্গে তার ছবিতে বারবারই উঠে এসেছে মানুষের শ্রম, ভালোবাসা ও বন্ধনের দৃশ্যকাব্য। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ক্ষেত্রেই সমকালীন চিত্রকলা অঙ্গনে সৈয়দ জাহাঙ্গীর সাফল্যের স্বাক্ষর রাখলেন। তার চিত্রকর্মকে বিমূর্ত-আধাবিমূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন অনেকেই।
বাংলাদেশের গ্রামের মুক্ত আকাশ, প্রান্তরময় বিশালতার উপস্থাপনে তার বেশিরভাগ ছবিতে ক্যানভাসের জমিনজুড়ে রাজত্ব করেছে নীল ও হলুদ দুই রং। তবে ঋতুবৈচিত্র্যের নানা রংও তার ক্যানভাসে স্বতন্ত্র প্রয়োগভঙ্গিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে এসেছে। তার ক্যানভাসে একই সঙ্গে শক্তি ও ঋজুতার প্রকাশ ঘটেছে। বলা যায়, জীবনের বিপরীত অনেক ভাব ও বোধের সম্মিলন ঘটিয়েছেন তিনি তার ছবিতে।
সুদীর্ঘ ছয় দশক ধরে বিস্তৃত শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের শিল্পজীবন। বেশভূষা ও চিন্তায় তিনি চিরতরুণ। তারুণ্যের নিরীক্ষা, সাহস ও উদ্দীপনা তার ক্যানভাসে সর্বদা ভাস্বর হতে দেখা যেত। প্রথমে শুরু করেছিলেন জলরঙের মাধ্যমে। এর আগে ছিল ড্রইং। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ড্রইংনৈপুণ্য তৎকালীন শিল্পানুরাগীদের মধ্যে প্রায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক চিত্রপ্রদর্শনী তার শিল্পদক্ষতার পরিচিতি ঘটানোর মাধ্যমে তাকে একজন প্রতিনিধিত্বশীল চিত্রকর হিসেবে স্পষ্ট করে তুলেছিল।
পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান সৈয়দ জাহাঙ্গীর। এর পরপরই জাহাঙ্গীরের জলরঙের কাজে এক ধরনের নতুনত্ব প্রকাশ পেতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানতম জলরং শিল্পী জন মারিনের কাজ নতুন করে উদ্দীপিত করে জাহাঙ্গীরকে। বর্ণের উল্লাস ও উদ্দামতার বেগকে তিনি প্রকৃতির একটা আলাদা ভাব হিসেবে ধরে রাখতে চাইলেন। শৈলী বিদেশি হলেও শিল্পী মনেপ্রাণে ও উপাদান-অনুষঙ্গে স্বদেশি হওয়ার কারণে ছবিগুলো স্বাতন্ত্র্য পেতে থাকে। সত্তরের দশকের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত তিনি নিসর্গ ও গ্রামীণ জীবনোপাদান আঁকেন 'অজানার অন্বেষায়' শীর্ষক সিরিজে।
আমৃত্যু গ্রামবাংলার নিসর্গকেই নানাভাবে তার করণকৌশলের স্বাতন্ত্র্যে নির্মাণ করে গেছেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। মৃত্যুর কিছু বছর আগেও জাহাঙ্গীরের 'মাটি ও মানুষ' নামক ৩৬তম একক প্রদর্শনীর কাজগুলোতেও পাওয়া গেছে প্রকৃতি ও মানুষের নানা অনুষঙ্গ। রং ও ক্যানভাসের বুনটের সমন্বিত এক সহজ ছন্দ তার সৃষ্টিকে করে তুলেছে তাৎপর্যময়। ক্যানভাস ছাড়াও শিল্পী কাগজের ওপর অ্যাক্রিলিকের জমিন ও রেখায় কৃষি ও জেলেজীবন, ফসলের ক্ষেত, ঘাটে বাঁধা নৌকার সারি- এসব বিষয়কে উপজীব্য করেছেন।
শিল্পচর্চার প্রায় পুরোটাই সৈয়দ জাহাঙ্গীর নীল, হলুদ, সবুজ, সোনালি রঙে কম্পোজিশন ও স্পেসের ব্যবহারের মাধ্যমে পাশ্চাত্য ধারায় প্রাচ্যের গ্রামীণ আত্মাকে আমাদের শিল্পভুবনে প্রতিষ্ঠা করার কাজটি করে গেছেন, যা বাংলাদেশের চিত্রকলায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আলোয় প্রথিত হয়ে থাকবে।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর তার শিল্পজীবনে প্রায় ২২ বছর পেশাদার চিত্রকর হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭৭ সালে শিল্পকলা একাডেমির শিল্পকলা বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। সৈয়দ জাহাঙ্গীর শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এবং শিল্পকলা একাডেমিতে চারুকলা বিভাগ চালু করেন। শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ তাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ২০০০ সালে মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার এবং ২০০৫ সালে শশীভূষণ সম্মাননা লাভ করেন তিনি। ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ইকবাল রোডের নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর।
সাংবাদিক
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com