
কূটনীতি
মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচন ও রোহিঙ্গা ইস্যু
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন। ১৯৬২ সালে এক সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী তৎকালীন বার্মার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর তথাকথিত 'বহুদলীয় গণতন্ত্রের' নামে মিলিটারি ডিক্টেটরদের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের ২৭ মে। তবে, একটি গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট গঠন করা এ নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য ছিল না। এটা ছিল মূলত একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য পার্লামেন্টের-সাইজের একটি কনস্টিটিউশনাল কমিটি গঠন করা। সে নির্বাচনের অন সাং সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৪৯২টি আসনের মধ্যে ৩৯২টি আসনে জয় লাভ করে। কিন্তু মিলিটারি জান্তা নির্বাচনের এ ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং মিলিটারির নেতৃত্বে একটি 'স্টেট পিস এবং ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল' গঠন করে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনা করে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালেও মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে আরও একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এনএলডি সে নির্বাচন বয়কট করে। তবে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত বাই-ইলেকশনে এনএলডি অংশ নিয়ে ৪৫টি খালি আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়লাভ করে। এরপর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর, যা বিশ্বব্যাপী এক ধরনের স্বীকৃতি পায়। এ নির্বাচনই সত্যিকার অর্থে সু চি এবং তার দল এনএলডিকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন করে কেননা এ নির্বাচনে তাদের 'ভূমিধস বিজয়' অর্জিত হয়। সংসদের প্রায় ৮৬% আসনে ('হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ' বা লোয়ার হাউস বা পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ২৩৫টি আসনে এবং 'হাউস অব ন্যাশনালিটিজ' বা আপার হাউস বা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে ১৩৫টি আসন) এনএলডি জয়লাভ করে।
এত বড় বিজয়ের পরও সু চি মিয়ানমারের হেড অব গভর্নমেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। কারণ সু চির স্বামী এবং সন্তান ব্রিটিশ নাগরিক এবং তাই মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী সু চি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অযোগ্য। কিন্তু সু চির জন্য 'স্টেট কাউন্সিল' নামে একটা পদ সৃষ্টি করা হয়, যা প্রকারান্তরে সু চিকে মিয়ানমারের 'ডি-ফেক্টো' সরকারপ্রধানে পরিণত করে। ৮ নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিপুল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এ নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ নতুন করে আরও একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যদি নতুন সরকার গঠিত হয়, তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে। যেহেতু এনএলডিই পুনরায় নির্বাচিত হবে বলে নিশ্চিত এবং সু চিই আবারও অঘোষিত সরকারপ্রধান হবেন, সেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের মিয়ানমারের অবস্থান কী আগের মতোই থাকবে, নাকি রাষ্ট্রীয় নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিদ্ধান্তে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসবে প্রভৃতি বিষয়ও বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মোটাদাগে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নির্বাচন কতটা জরুরি?
মিয়ানমারের অন্যান্য রাজ্যে নানান ধরনের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব এবং ভিন্নমত দমনের নানান সমালোচনার বাইরেও রাখাইন রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রার্থীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অজুহাতে রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপ থেকে ৯টির নির্বাচন বাতিল করা; সংখ্যাগুরু বার্মার ছাড়া অন্যান্য সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার ভোট বাতিল ঘোষণা করা; আরাকান আর্মি দমনের নামে রাখাইনের বিস্তৃত আরাকান অধ্যুষিত এলাকাকে ভোটার আওতার বাইরে রাখা (মূলত আরাকান ন্যাশনাল পার্টির জেতার সম্ভাবনা বাতিল করা!); শুধু যেসব টাউনশিপে এনএলডি বা সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি এবং ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা আছে, সেসব টাউনশিপে নির্বাচন করার পরিকল্পনা করা; প্রভৃতি কারণে আন্তর্জাতিকভাবেই এ নির্বাচন ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। ৫ অক্টোবরে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, 'এ নির্বাচন মৌলিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ।' নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত রাখাটা বিশ্বব্যাপী ২০২০ সালের পুরো নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকানে, যা এখন রাখাইন রাজ্য নামে পরিচিত, বংশ পরম্পরায় বসবাস করলেও ২০২০ সালে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের যেমন কোনো প্রার্থী নেই, তেমনি তাদের কোনো ভোটাধিকারও নেই। অথচ ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫১ সালের নির্বাচনে মংডু (উত্তর) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন সুলতান আহমেদ এবং বুথিডং থেকে নির্বাচিত দু'জন সংসদ সদস্য ছিলেন আব্দুল গাফ্ফার (উত্তর বুথিডং) এবং আবুল বাশার (দক্ষিণ বুথিডং)। ১৯৫৬ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন ছয়জন এবং ১৯৬০ সালে রোহিঙ্গাদের নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন পাঁচজন। অথচ, ২০২০ সালে এসে মিয়ানমারে বসবাসরত অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ক্যাম্পের প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার আর উত্তর-দক্ষিণ রাখাইনে বসবাসরত প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার কোনো ভোটাধিকারই নেই। তাই, এই নির্বাচনে কোনো পর্যায়েই রোহিঙ্গাদের কোনো ধরনের হিসাব-নিকাশের মধ্যে রাখা হয়নি। বরং নির্বাচন উপলক্ষে মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে 'এমভোটার ২০২০ অ্যাপস' নামে একটি নির্বাচনী অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। এ অ্যাপসটি সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত সংঘাত, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মান্ধতাকে উস্কে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে বলে দেশে-বিদেশে তুমুল সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এ অ্যাপসে রোহিঙ্গাদের 'বাঙালি' হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে উপস্থাপন করা এবং অফিসিয়াল ডকুমেন্টে রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে লিপিবদ্ধ করা প্রকারান্তরে রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি, সরকারি নীতি এবং সম্ভাব্য বিজয়ী সু চি ও এনএলডির হিসাব-নিকাশকেই প্রকারান্তরে প্রতিভাত করে।
এদিকে মানবিক কারণে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ পড়েছে বড় বিপদে। দুই দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরও মিয়ানমারের অনাগ্রহ, অপ্রস্তুতি এবং চরম অসহযোগিতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে তৃতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার কোনো প্রস্তুতি এখনও পর্যন্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ মিয়ানমারকে ছয় লাখ রোহিঙ্গার একটা তালিকা হস্তান্তর করেছে অথচ মিয়ানমার মাত্র ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে যাচাই-বাছাই করে শনাক্ত করতে পেরেছে বলে জানিয়েছে। আবার রোহিঙ্গাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলোতে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা তুলে রোহিঙ্গাদের গ্রামের নামগুলো পর্যন্ত মুছে ফেলা হচ্ছে। এভাবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিতে মিয়ানমার নানা টালবাহানা করছে এবং নানা কৌশল অবলম্বন করে রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। এ ছাড়া উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানোর পেছনেও মিয়ানমারের মদদ আছে বলে বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে, যার কারণে বাংলাদেশে আরসাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে বলে জাতিসংঘে মিয়ানমার মিথ্যাচার করেছে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ একেবারেই নিজস্ব অর্থায়নে তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয় করে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য নানা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি করেছে। রোহিঙ্গারা নানা বাস্তব-অবাস্তব যুক্তি দেখিয়ে ভাসানচরে যেতেও রাজি হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াতেও প্রত্যাশিত সহযোগিতা করছে না, আবার ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারেও আপত্তি তুলছে। এদিকে ১১ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় মানুষকেও নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তাজনিত এবং প্রতিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সব মিলে বাংলাদেশে বসবাসকারী 'রোহিঙ্গা শরণার্থী' ক্রমান্বয়ে একটি বড় সমস্যা আকারে আবির্ভূত হচ্ছে।
তাই, একটি মুক্ত এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে মিয়ানমারে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসে, রোহিঙ্গাদের প্রতি যদি রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি যদি সরকারের পলিসির ইতিবাচক রূপান্তর ঘটে, তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যেমন ত্বরান্বিত হবে, তেমনি রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যেও একটা নির্ভয়-আস্থার পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
মনে রাখা জরুরি, পাঁচ বছর অন্তর একটা নির্বাচন করলেই গণতন্ত্র ফিরে আসে না; সরকারের নানা পলিসি, দৃষ্টিভঙ্গি, অনুশীলন এবং দর্শন পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে সমাজে গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমরা আশা করব, সু চির দল এনএলডি পুনরায় নির্বাচিত হয়ে মিয়ানমারকে গণতন্ত্রায়ণের দিকে পরিচালিত করবে, যা ধর্মীয়, জাতিগত এবং ভাষাগত সংখ্যালঘুদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি আরও সংবেদনশীল এবং দায়িত্বশীল করে তুলবে। মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ণের ভেতরেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান নিহিত আছে। নির্বাচন মিয়ানমারকে অধিকতর গণতান্ত্রিক করে তুলবে, এটাই বাংলাদেশের প্রত্যাশা।
অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com