অফিসারদের উচ্ছৃঙ্খলতার ক্যু ও সিপাহিদের শৃঙ্খলার অভ্যুত্থান

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০ । ১৯:৫৯ | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০ । ২০:১৫

জিয়াউল হক মুক্তা

প্রথম ক্যু

একক 'জাতীয় দল' বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল পলিটব্যুরোর পাঁচ নম্বর সদস্য ও বাকশাল মন্ত্রিসভার চার নম্বর সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয় সেনা কর্মকর্তার অবিমৃষ্যকারিতায় সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুহত্যা বিচার আদালতের বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঘোষিত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতায় এ ক্যু সংঘটিত হতে পেরেছিল। একে তিনি সেনাবাহিনীর জন্য 'চিরস্থায়ী কলঙ্ক' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিচার আদালতের সাক্ষ্য-ভাষ্য এবং ওই সময়ের সেনা কর্মকর্তাদের লেখা আত্মজীবনীমূলক বইপত্রে প্রকাশিত তথ্য বিশ্নেষণ করলে প্রমাণিত হয় সেনাপ্রধানের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা এবং সেনাবাহিনীর প্রায় সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্মতি এবং সংশ্নিষ্টতার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়েছে এ ক্যু। স্বাধীন দেশের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-জনপ্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগে ১৯৭২ সালের শুরু থেকে পুনর্বাসিত পাকিস্তানপন্থা এবং সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের এক অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটে এ ক্যুর মাধ্যমে।

দ্বিতীয় ক্যু

১৫ আগস্ট ক্যু হিসেবে সফল হবার পর প্রাপ্তিযোগের হিসাব-নিকাশে জিয়াউর রহমান লাভবান হলেন আর খালেদ মোশাররফ ও তার অনুসারীরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করলেন। দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আরেকটি ক্যু সংঘটিত হলো। এদিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও সেটি না জানার ভান করে বঙ্গভবন বনাম সেনানিবাসের দিনমান দরকষাকষির মধ্য দিয়ে বঙ্গভবনে আশ্রয় নেওয়া আগস্ট হত্যাকাণ্ডের খলনায়কদের ভিসার ব্যবস্থা করে বিশেষ বিমানের আয়োজন করে রাতে নিরাপদে দেশ ত্যাগের সুযোগ করে দেওয়া হলো।

বঙ্গভবনে অবস্থান করে মোশতাক-খালেদের দরকষাকষি শুরু হলো প্রমোশন ও ক্ষমতা নিয়ে; খালেদ নিজের জন্য সেনাপ্রধানের পদ আদায় করে নিলেন, আর সরকার-ক্ষমতায় আরোহণের জন্য উপায় খুঁজতে লাগলেন। ৩ নভেম্বরের ক্যুর সহযোগী সেনাকর্মকর্তারা খালেদ মোশাররফকে যে বেতার ভাষণ লিখে দিয়েছিলেন তা তিনি জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন না। বরং বেতার-টেলিভিশন-বিমানবন্দরসহ অন্যান্য যোগাযোগ অবকাঠামো বন্ধ থাকল। দেশবাসী চার দিন ধরে জানতে পারলেন না সেনানিবাস ও বঙ্গভবনে কী হচ্ছে, কারা দেশ পরিচালনা করছেন বা দেশে আদৌ কোনো সরকার আছে কিনা। দেশব্যাপী জনমনে তীব্র উৎকণ্ঠা দেখা দিল- দেশে কী হচ্ছে!

কাউন্টার-ক্যুর পরিকল্পনা

তথ্যটি বেশ পুরোনো কিন্তু চিত্তাকর্ষক। এ নিয়ে কেউ কখনও কোথাও কোনো আলোচনা করেননি যে, ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর তারিখে ৩ নভেম্বর ক্যুর মাত্র তিন দিনের মাথায় পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওই ক্যুর মূল সংগঠক কর্নেল গফফার ও মেজর নাসিররা রক্ষীবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে কর্নেল সাফায়াত জামিলকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে আরেকটি ক্যু সংগঠনের পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে ৩ নভেম্বরের ক্যুর অন্যতম সংগঠক অবসরপ্রাপ্ত মেজর নাসির উদ্দিনের স্মৃতিকথা 'গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী' বইয়ের ১৩৬-১৩৭ নম্বর পৃষ্ঠায়।

এক ক্যুর ভেতরে আরেক ক্যু

ঠিক একই সময় খালেদ মোশাররফও রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য আবারও ক্যুর পরিকল্পনা করছিলেন এবং ঢাকায় শক্তিসমাবেশ করছিলেন। এ বিষয়ে রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সারোয়ার হোসেন মোলল্গার বই থেকে সেনাবাহিনীর তথ্য ও সেনা কর্মকর্তাদের বিশ্নেষণটি দেখা যাক। ব্রিগেডিয়ার সাবিহউদ্দিন এবং অন্যান্য সেনাকর্মকর্তার বক্তব্যের মর্মার্থ হিসেবে কর্নেল সারোয়ার জানাচ্ছেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ যদি শুধু সেনাপ্রধান হতে চাইতেন, তা তিনি সহজেই হতে পারতেন। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিল সেনাপ্রধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধানের পদও দখল করা। বিশ্নেষণ বলছে যে, সে লক্ষ্যে খালেদ মোশাররফ ব্যক্তিগত শক্তি সুসংহত করতে সচেষ্ট ছিলেন।

সেনা কর্মকর্তাদের এমন চিন্তার পেছনে প্রথম কারণ হলো- ৩ নভেম্বর সকালেই ক্যুর সপক্ষে কারণগুলো ব্যাখ্যা করে একটি ঘোষণাপত্র লিখে খালেদ মোশাররফের হাতে দেওয়া হয় বেতারে পাঠ করার জন্য; বলা হয়, যাতে করে দেশের মানুষ অন্ধকারের মধ্যে না থেকে প্রকৃত অবস্থাটা জানতে পারেন। কিন্তু বারবার অনুরোধের পরও তিনি তা বেতারে পাঠ করেনি। শেষের দিকে একসময় খালেদ জানান যে, ঘোষণার কপিটি তিনি আর খুঁজে পাচ্ছেন না। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেনাবাহিনীতে খালেদের অনুগত দ্বিতীয় সেক্টরের অফিসারদের ঢাকায় একত্রিত করা। অনেক পর্যবেক্ষক এমনও মত পোষণ করেন যে, খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বরের ক্যুর ভেতরে আরেকটা ক্যু সংঘটনের চেষ্টা করছিলেন। ২ থেকে ৬ নভেম্বর সারাদেশের মানুষ থাকে অন্ধকারে। ঢাকা শহর পরিণত হয় গুজবের শহরে।

সিপাহী-জনতার মহান বিপ্লবী অভ্যুত্থান

এভাবে খন্দকার মোশতাক, মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক গংয়ের ১৫ আগস্টের ক্যু, খালেদ মোশাররফ ও সাফায়াত জামিলদের ৩ নভেম্বরের ক্যুর পর ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে আরেকটি ক্যুর পরিকল্পনা; এবং ক্ষমতারোহণের জন্য ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে নতুন করে ক্যুর ভেতরে আরও একটি ক্যু পরিকল্পনার প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের নেতৃত্বে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার উদ্যোগে, বিপ্লবী গণবাহিনীর সহায়তায় ও জাসদের সমর্থনে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান।

সিপাহী-জনতার এ অভ্যুত্থান সংঘটনের প্রধানতম অনুপ্রেরণা বা স্ম্ফুলিঙ্গটি ছিল 'বিপল্গবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা'। গত ৪৫ বছর ধরে বহু রাজনৈতিক সাহিত্যে ও গবেষণাকর্মের পরিশিষ্টে এই ১২ দফা প্রকাশিত হয়ে চলেছে, কিন্তু কোথাও আজ পর্যন্ত তা পুরোপুরিভাবে বিশ্নিষ্ট হয়নি। ১২ দফার চারটি দফা ছিল রাজনৈতিক ও আটটি দফা ছিল সিপাহিদের পেশাগত ও অর্থনৈতিক দাবি। ১২ দফার প্রথম দফায় বলা হয়েছে, 'ধনিক শ্রেণি তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাদের ব্যবহার করেছে। পনেরোই আগস্টের ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের এবারের বিপ্লব ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়।' এ রকম প্রকাশ্য-মুদ্রিত স্পষ্ট বক্তব্য থাকার পরও যারা ৭ নভেম্বরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে যড়যন্ত্র করেন, তাদের প্রতি করুণা বর্ষণ করা ছাড়া উপায় নেই।

গোপন ষড়যন্ত্র বনাম ঘোষিত অভ্যুত্থান

মহান সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান অফিসারদের নেতৃত্বে ক্যু সংঘটনের মধ্যে কোনো গোপন ও ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা ছিল না; এ অভ্যুত্থান সংঘটিত করতে আগে থেকেই ব্যাপকভাবে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে, সৈনিকদের পাশাপাশি অফিসাররাও তা পেয়েছেন। এ ছিল শক্তি সমাবেশ ও ক্ষমতা দখলের একটি প্রকাশ্য ঘোষিত লড়াই। ৭ নভেম্বর সকালেই খন্দকার মোশতাক চক্র বেতারকেন্দ্রে গিয়ে ভাষণ দেওয়ার চেষ্টা করে; তাদের সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। অভ্যুত্থানে গণসমাবেশের দিকটি বানচাল করতে গোয়েন্দা বাহিনীগুলো ৮ নভেম্বর শহীদ মিনারে ট্রাকে করে খন্দকার মোশতাকের ছবি নিয়ে হাজির হয় ও জাসদের প্রতিরোধের মুখে গোলাগুলি করে জনসভা বানচাল করে দেয়; ৯ নভেম্বর বায়তুল মোকাররমের জনসভাও গোয়েন্দা বাহিনী বানচাল করে দেয়।

পাকিস্তানপন্থার ও পাকিস্তানফেরত অফিসাররা জিয়ার সহায়তায় ক্রমে অভ্যুত্থানের বিজয় বানচাল করে দেন। ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহের ও জাসদ নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭৬ সালে কর্নেল তাহের ও জাসদ নেতাদের গোপন সামরিক আদালতে বিচার প্রহসনের মাধ্যমে দণ্ড ঘোষণা করা হয় কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশসহ। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা হয়। সারাদেশে জাসদের ওপর নেমে আসে নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন-গুম-খুন।

পাকিস্তানপন্থার উত্থান

বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার 'ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেমোক্রেসি' বইয়ে স্বীকার করেন যে, কর্নেল তাহের সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছেন। ১৯৭৬ সালে সশস্ত্র বাহিনীর পাকিস্তান প্রত্যাগত ৪৬ জন অফিসার জিয়াউর রহমানের ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করেছিলেন বিচারে কর্নেল তাহেরের প্রাণদণ্ড দেওয়ার জন্য। তিনি জানান যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মোশতাকের অপসারণের পর জিয়ার মধ্যে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা তাদের নতুন মিত্র খুঁজে পেলেন। উভয় পক্ষের অর্থাৎ জিয়ার ও পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের পরস্পরকে দরকার হয়ে উঠেছিল দেশের সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক-কাঠামোর মধ্যে 'শ্রেণি' হিসেবে ও 'শক্তি' হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। কারণ পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে জিয়া 'সশস্ত্র বাহিনী'তে এবং দেশের 'ক্ষমতা'য় নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাইছিলেন।

উপসংহার

রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানপন্থা ও ব্যক্তিগতভাবে সেনাকর্মকর্তাদের ক্ষমতালিপ্সার ঐক্যের বিরুদ্ধে ৭ নভেম্বর মহান সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান ছিল দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে ফিরিয়ে নেওয়া ও সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান সাধারণ সিপাহিদের এক বিপ্লবী প্রয়াস। ২০০৯ সালে ১৪ দলের সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে পাকিস্তানপন্থা কিছুটা পিছু হটলেও পাকিস্তানপন্থা ও ব্যক্তিস্বার্থের ঐক্য ও ষড়যন্ত্র এখনও বিরাজমান। এ ঐক্য বিচূর্ণ করে মুক্তিযুদ্ধের গণআকাঙ্ক্ষার আলোকে বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পালিত হোক এবারের ৪৫তম মহান সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com