অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সুরক্ষার বাইরে

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস আজ

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০ । ০৩:২২ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজবংশী রায়

ছবি: ফাইল

স্বাস্থ্যসেবায় গত কয়েক বছরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হলেও দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাইরে রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ, পথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিককে মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করে তা অন্যান্য দেশকে গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে এসব উন্নয়নের পরও সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। এ অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত চিকিৎসা খরচের কারণে সেবা নিতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে, সরকারি হাসপাতালে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের বিনামূল্যে চিকিৎসাপ্রাপ্তিতে নানামুখী সংকট রয়েছে। এ কারণে মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাইরে রয়েছে। দরিদ্র থেকে বিত্তবান সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নূ্যনতম মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্থাৎ, ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গ্রামাঞ্চলে থাকা কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতাল এবং নগরাঞ্চলে থাকা নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, নগর প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ডেলিভারি সার্ভিসেস প্রজেক্ট এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারিভাবে মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। বাকি প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে এখনও সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে আসছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক। তিনি সমকালকে বলেন, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি বা স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় কম হওয়ায় চিকিৎসা ব্যয়ের একটি বড় অংশই রোগীকে বহন করতে হয়। এই ব্যয় বহন করতে গিয়ে বছরে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। আবার অনেকে ব্যয় মেটাতে না পারায় চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন। এসব সমস্যার সমাধান করতে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

এবারে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য সুরক্ষা'। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব জনগণকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে ২০১২ সালে 'সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা' কর্মসূচি চালু করা হয়। ২০১২ থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে সবাইকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আট বছর ধরে এই কর্মসূচি চলছে। এই কর্মসূচির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ডা. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ সমকালকে বলেন, ২০১২ সালে বলা হলেও কর্মসূচিটি মূলত তিন বছর পর ২০১৫ সালে চালু হয়। সারাদেশের মানুষের তিনটি ক্যাটাগরি করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার একটি রোডম্যাপ হাতে নেওয়া হয়। এর প্রথম ধাপ ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। এরই অংশ হিসেবে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের আওতায় টাঙ্গাইলের তিন উপজেলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়। এটি সফল হলে ধাপে ধাপে সারাদেশে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ওই প্রকল্পের যে ধরনের অগ্রগতি প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা হয়নি। কর্মসূচিটি মূল্যায়ন করে দেখা যায়, মানুষের জন্য এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। কার্ড থাকলেও অনেকে তা ব্যবহার করেন না। আবার ভর্তি রোগী ছাড়া ওই কার্ডের সুবিধা অন্যরা পান না। এর পরও কাজ হয়েছে। বিশেষ করে যে কোনো প্রকল্প শুরু হলে তাতে ভুলত্রুটি থাকে। এটি বিন্যাস করে আরও ভালো কিছু করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসক সংকটের কারণে সেবা ব্যাহত হচ্ছিল। এখন প্রকল্পের আওতায় চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে করে মানুষের সেবাপ্রাপ্তির হার বেড়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন এবং তারা দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে চার কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছেন। প্রতি বছর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ৬৪ লাখ মানুষ আর্থিক সংকটে পড়েন।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের হিসাব অনুযায়ী, যে কোনো পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা নিতে ৬৭ শতাংশ ব্যয় রোগীকেই বহন করতে হয়। সরকার ২৬ শতাংশ এবং এনজিও, প্রাইভেট সেক্টর ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি অবশিষ্ট ব্যয় বহন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ সমকালকে বলেন, টাকার অঙ্কে বড় হলেও প্রতি বছর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে। তবে করোনা মহামারির কারণে বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ে নয়। বাংলাদেশে জনপ্রতি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ মাত্র ৩৭ ডলার। কিন্তু প্রয়োজন ৮৫ থেকে ১১২ ডলার। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে জনপ্রতি স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দ ৬১ ডলার, থাইল্যান্ডে ২৮৫ ডলার, মালয়েশিয়ায় ৪১০ ডলার ব্যয় হয়। বাংলাদেশের আশপাশে নেপাল ৩৬ ডলার এবং পাকিস্তান ৩৯ ডলার ব্যয় করে। এ বিষয়ে সরকারকে চিন্তা করতে হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা সম্ভব নয়। বিত্তবানরা অর্থ ব্যয় করে যে কোনো জায়গায় চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু যাদের টাকা নেই, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ টাকার অভাবে যেন চিকিৎসাবঞ্চিত না হয়, সেদিকে আমাদের নজর। করোনা মহামারির মধ্যে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবন বাজি রেখে চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। ফলে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম। সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা করে ব্যয় হচ্ছে। এই টাকা সরকার জোগান দিচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে অন্যান্য রোগব্যাধির বিষয়গুলো ততটা ফোকাসে নেই। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ বসে নেই। করোনার পাশাপাশি অন্যান্য রোগব্যাধির প্রতিও সমান ফোকাস করে স্বাস্থ্যসেবা এগিয়ে চলছে বলে জানান তিনি।

এদিকে দিবসটি উপলক্ষে আজ রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে ডায়াবেটিক সমিতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, কিডনি ফাউন্ডেশন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভাসহ সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com