সমকাল ও গণসাক্ষরতা অভিযানের ওয়েবিনার

গৃহকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০ । ০৪:২১ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল প্রতিবেদক

বাংলাদেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরে তাদের প্রায় ৭৮ শতাংশ নারী। শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার। শুধু রাজধানী ঢাকায় গৃহকর্ম পেশায় নিয়োজিত নারীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। তাদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ পূর্ণকালীন এবং ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ খণ্ডকালীন। বিদেশেও আট লাখের বেশি গৃহশ্রমিক নিয়োজিত আছেন। আইনে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ছাড়াই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এই বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলছেন। রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আবার তাদের হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনাও বেড়ে চলেছে।

বিশিষ্টজনের মতে, গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় ২০১৫ সালে 'গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি' করা হলেও তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটি বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন এবং গৃহকর্তাদের মানসিকতা পরিবর্তনে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। গতকাল শনিবার অনলাইনে আয়োজিত 'নারী গৃহকর্মীদের জীবন দক্ষতা ও পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন :আমাদের প্রত্যাশা ও করণীয়' শীর্ষক ওয়েবিনারে বিশিষ্টজন এসব পরামর্শ দেন।

গণসাক্ষরতা অভিযান ও সমকালের যৌথ উদ্যোগে ওয়েবিনারটির আয়োজন করা হয়। সহায়তা করেছে অক্সফাম। এতে সভাপতিত্ব করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী। সমকালের সহকারী সম্পাদক শেখ রোকনের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য শিরীন আখতার, আরোমা দত্ত, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (নিবন্ধন ও সনদায়ন) সদস্য ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিম, ইনফরমাল সেক্টর ইন্ডাস্ট্রি স্কিল কাউন্সিল (আইএসআইএসসি) চেয়ারম্যান মির্জা নুরুল গণি শোভন, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ. বি. এম. খোরশেদ আলম, বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ড. মো. সাখাওয়াত আলী, অক্সফামের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর অভিনেত্রী দীপা খন্দকার, অক্সফামের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ইনক্লুশন প্রোগ্রাম প্রধান মাহমুদা সুলতানা, অক্সফামের সিকিউরিং রাইটস প্রজেক্ট সমন্বয়কারী গীতা রানী অধিকারী, নারী মৈত্রীর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আক্তার ডলি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গৃহকর্মীবিষয়ক কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলের সদস্য ড. ওয়াজেদুল ইসলাম খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. দেবাশীষ কুন্ডু।

ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাশ। তিনি বলেন, গৃহকর্মীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কভিড-১৯-এর কারণে অনেক গৃহকর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বিকল্প আয়ের উৎস না থাকায় অনেকেই আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়েছেন। দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অনেক গৃহকর্মী তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। লকডাউনের সময় কাজে যেতে পেরেছেন ৫ শতাংশ গৃহকর্মী, বেতন পাননি ২৫ শতাংশ গৃহকর্মী। মাত্র ৩৫ শতাংশ গৃহকর্মীর সঙ্গে চাকরিদাতারা যোগাযোগ রাখছেন।

রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, গৃহকর্মীর অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রধান অন্তরায় হলো এই পেশাটিই আনুষ্ঠানিভাবে স্বীকৃত নয়। এমনকি 'গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি-২০১৫' বাস্তবায়নে ধীরগতি। নেই কোনো আইনও। তাদের অধিকার রক্ষায় নীতিমালা সম্পর্কে প্র্রচারে কোনো উদ্যোগও নেই। তাই গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ইতিবাচক গল্প রয়েছে। ওগুলো প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করতে হবে। এতে গৃহকর্মীসহ গৃহকর্তারাও উৎসাহিত হবেন।

শিরীন আখতার বলেন, আন্তর্জাতিকভাবেই গৃহশ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় লড়াই চলছে। তাদের জন্য শোভন কাজ সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন-১৮৯ বিগত ২০১১ সালের আইএলও কনফারেন্সে গৃহীত হয়। বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত, শ্রমিক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তাদের সংগঠিত করতে আইএলও কনভেনশন-১৮৯ অনুসাক্ষর করা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, গৃহকর্মীদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। অনেক সময় বিনা নোটিশে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা ও বেতন কাঠামো নেই। এ অবস্থানের পরিবর্তনের জন্য সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও নীতিমালা বাস্তবায়নসহ গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন করতে হবে।

আরোমা দত্ত বলেন, গৃহকর্মীদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই তারা শহরমুখী হন। আর সহজ ভেবে গৃহকর্মীর কাজটাই বেছে নেন। অথচ যাদের দ্বারা গৃহকর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয় সেই গৃহকর্তা বা যোগাযোগ স্থাপনকারী মধ্য ব্যক্তিটি কী জানেন যে, নীতিমালায় কী আছে, বা গৃহকর্মীর অধিকার ভূলুণ্ঠিত হলে বা তার ওপর নির্যাতন করা হলে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে। এই জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। তবেই অনেকাংশে সমস্যার সমাধান মিলবে।

মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। বিদেশে যেসব গৃহকর্মী পাঠানো হয়, শুধু তাদের আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। তাদের কাজের মান উন্নয়ন এবং পরে সনদায়ন করে থাকি। তবে দেশের ভেতরে যারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন, তাদের দক্ষতা উন্নয়নের কাজটা শুরু করেছে অক্সফাম।

তিনি আরও বলেন, দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন যারা ফুলটাইম গৃহে অবস্থান করেন তারা। আর যারা খণ্ডকালীন কাজ করেন, তাদের ওপর সহিংসতার মাত্রা অনেকাংশেই কম। এসব ক্ষেত্রে গৃহকর্তাকে সচেতন করে তুলতে হবে।

মির্জা নুরুল গণি শোভন বলেন, গত পাঁচ বছরেও গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় নীতিমালার বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ দেশের অর্থনৈতিক খাতে তাদের অবদান রয়েছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

এ. বি. এম. খোরশেদ আলম বলেন, গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় দুটো বিষয়ে, যেমন তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, গৃহকর্মীরা দক্ষতা অর্জন করলে নির্যাতন ও সহিংসতা অনেক ক্ষেত্রেই কমে যাবে। কারণ, গ্রাম থেকে আসা মেয়েটাও শহুরে পরিবারগুলোতে মাইক্রোওভেন, গ্যাসওভেন, ওয়াশিংমেশিন ব্যবহারসহ অন্যান্য কাজ সহজেই করতে পারবে।

ড. মো. সাখাওয়াত আলী বলেন, গৃহকর্মীদের প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। এর পরও তাদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি জনশক্তি ও কর্মসংস্থানের ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে তাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিগগির তাদের সেই প্রশিক্ষণ শুরু হবে।

ড. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, গৃহকর্মীরা তাদের নিজেদের নাম হারিয়ে ফেলেছে। সমাজে তাদের বুয়া বলে ডাকা হয়। বুয়া বলে ডাকা থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি সবাইকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

দীপা খন্দকার বলেন, গৃহকর্মীদের কর্মস্থল নিরাপদ করতে হবে। তারা যেন নির্ভয়ে সব কাজ করতে পারে। কারও অনুমতি নিয়ে যেন খেতে না হয়। যেন চিন্তা না করতে হয়, এখন আমি কী করব। গৃহকর্মীদের শুধু শারীরিকভাবে নয়, অনেক সময় মানসিকভাবেও নির্যাতন করা হয়।

মাহমুদা সুলতানা বলেন, গৃহকর্মীর যেমন অধিকারের জায়গা আছে, তেমনি তার কর্তব্য পালনের জায়গাটাও আছে। তাই উভয়কেই নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে কাজ করতে হবে।

ড. দেবাশীষ কুণ্ডু বলেন, গৃহকর্মীদের নিয়ে প্রচুর লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে। কিন্তু সেই গবেষণা বাস্তবায়ন হয়নি। এই আলোচনায়ও গৃহকর্মীদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিনিধি নেই। ফলে তাদের কী অনুভূতি বা প্রয়োজন, সেটাও তাদের কাছ থেকে জানতে পারছি না।

শাহীন আক্তার ডলি বলেন, গৃহকর্মীদের নিয়ে মূল্যায়ন কমিটি করা হয়েছে। সেখানে তাদের উপস্থিত রাখা হয়। সরকার যে সেল গঠন করেছে, সেখানেও থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর নেই।

শেখ রোকন বলেন, আমরা অনেক সময় কায়িক শ্রমের মাত্রা বোঝানোর ক্ষেত্রে 'উদয়াস্ত' শব্দবন্ধ ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু গৃহকর্মীদের উদয়াস্ত বলে কিছু নেই। যতক্ষণ জেগে থাকে, ততক্ষণ তাদের কাজ করতে হয়। তাদের পর্যাপ্ত ঘুমের নিশ্চয়তাও নেই। তারা বঞ্চিতের মধ্যেও সবচেয়ে বঞ্চিত, শোষিতের মধ্যেও সবচেয়ে শোষিত। তাদের কোনো সংগঠন নেই, নূ্যনতম মজুরি নেই; ঘরের কোণে তাদের মানবাধিকার কতখানি রক্ষা পায়, তা দেখার সুযোগও নেই বললেই চলে। কেবল নির্যাতিত হলেই তাদের বঞ্চনা ও শোষণ পাদপ্রদীপে আসে। এমনকি তাদের নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে খুব বেশি আলোচনাও নেই। তিনি বলেন, সমকাল তার সম্পাদকীয় নীতি ও সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবই গৃহকর্মীদের অধিকার, মর্যাদা ও সুরক্ষার প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। গণসাক্ষরতা অভিযান ও অক্সফামের সঙ্গে এই ওয়েবিনার সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।

প্রসঙ্গত, গণসাক্ষরতা অভিযান অক্সফামের সহায়তায় গৃহকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও শোভন কর্মসংস্থান এবং তাদের কল্যাণ ও সুরক্ষার লক্ষ্যে 'সিকিউরিং রাইটস অব উইমেন ডোমেস্টিক ওয়ার্কার ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের আওতায় গণসাক্ষরতা অভিযান জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)-এর তত্ত্বাবধানে গৃহকর্মীদের জন্য দক্ষতামান, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল ও উপকরণ উন্নয়নের পাশাপাশি এই পেশাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com