
বিজয় দিবস
বিজয়ী জাতিকে যেতে হবে আরও অনেক দূর
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০ । ১৭:০৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
ড. মো. আবু তাহের

১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির অনন্য গৌরবের দিন। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, ত্রিশ লাখ শহীদ, অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও দুই লাখ মা-বোনকে, যাদের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে; ইতিহাসে রচিত হয় বীর বাঙালির এক গৌরবময় বিজয়গাথা। বাঙালির এ বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে রয়েছে অশ্রু-বেদনার এক সংমিশ্রণ। তবু এসেছে স্বস্তি, এসেছে মুক্তি; যে মুক্তির জন্য আমাদের পূর্বসূরিরা যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করেছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্ব মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়ানো একটি দেশের নাম। জনসংখ্যার ঘনত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনা মহামারি মোকাবিলা করে ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরামহীন অগ্রযাত্রা চলমান রয়েছে। এখন বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এতদঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য অনেকে স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেজন্য জীবনের ১১ বছর কেটেছে জেলে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিজেও পাননি; পরিবারকেও দিতে পারেননি। কিন্তু স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। তিনি বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন, সৃষ্টিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। এ জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দিয়েছেন। এ জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক অনন্তকাল বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী থাকবে।
এটা সত্য, ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণ ও ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালিরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও চরম বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষণ-দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে বাঙালিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। এতদসত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা নয়, দেশকে মার্চেই যেন স্বাধীন করে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের সাউথ এশিয়ান রিভিউ জার্নালে উল্লেখ করা হয়, 'বিচারকের অনুসরণ করে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের কর্মচারীরা যখন মুজিবের প্রতি সমর্থন জানায়, তখনই বাংলাদেশের ভেতরে ক্ষমতা কার্যত হস্তান্তর হয়ে যায় এবং ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহের মধ্যেই তা ঘটে। পরের তিন সপ্তাহে মুজিবের বাড়ি কার্যত বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েটে পরিণত হয়।' উত্তাল মার্চের পথ বেয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবস নিয়ে এম আর আখতার মুকুল রচিত 'আমি বিজয় দেখেছি' গ্রন্থ প্রসঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, 'আমার বন্ধু (আখতার মুকুল) বিজয় দেখেছেন, আমি যুদ্ধজয় দেখেছি, বিজয় দেখিনি। শত্রুরা সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আপাতত বিবরে লুকিয়েছে। তারা সামরিক পরাজয়বরণ করেছে, রাজনৈতিক যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। সময় ও সুযোগমতো তারা আবার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে। নতুন মুখোশ ধারণ করবে। নতুন স্লোগান দেবে। আমাদের মিত্রদের শত্রু বলে প্রচার চালাবে। শত্রুদের মিত্র বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। সেদিনই হবে আমাদের জয়-পরাজয়ের আসল যুদ্ধ। এই রাজনৈতিক যুদ্ধে যেদিন আমরা জয়লাভ করব, সেদিন হবে আমাদের যথার্থ বিজয় লাভ। বলতে পারব, আমরা বিজয় দেখেছি।'
মূলত ১৬ ডিসেম্বর ছিল আমাদের রণক্ষেত্রে বিজয়; জাতীয় বিপ্লবের সূচনামাত্র। বিপ্লব যে অসমাপ্ত রয়ে গেছে, আমরা যে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করিনি, এটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্যই তিনি স্বাধীনতা অর্জনের তিন বছর পূর্তি না হতেই দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী গণশত্রুরা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পাল্টা আঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগীয় মৌলবাদী শক্তি। এই দ্বিতীয় বিপ্লবের রণক্ষেত্রই বঙ্গবন্ধুসহ তার চার বিশিষ্ট সহকর্মী ও পরিবারের অধিকাংশ সদস্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল স্তম্ভগুলো অনেকাংশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এমনকি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের গতিপথও পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব যদি সফল হতো, তাহলে বাংলাদেশের অসমাপ্ত জাতীয় বিপ্লব সমাপ্ত হতো। আমরা চূড়ান্ত বিজয়ের অধিকারী হতাম। আমাদের স্বাধীনতার শত্রুশিবির এখন যতই রটাক, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি ও বিপ্লব সমাপ্ত হলে বাংলাদেশের চেহারা আজ অন্যরকম ধারণ করত।
বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের 'রোল মডেল'। কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা সত্ত্বেও গত অর্ধশতাব্দী ধরে আমাদের অর্জনও কম নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ৯১ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, তৈরি পোশাক, প্রবাসী জনশক্তি, রেল-নৌ ও যোগাযোগ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ও মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, বিনামূল্যে বই প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, শিশু-মাতৃমৃত্যু হ্রাস, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি ও বিচার চলমান রয়েছে; বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার ও শাস্তি হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির মূলোৎপাটন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এখন সবাই বুঝতে পারছেন কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়; অনিয়ম-দুর্নীতি করে আর পার পাওয়া যাবে না।
ইতোমধ্যে শত বছরের 'বদ্বীপ পরিকল্পনা, ২১০০' বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রা আজ পৃথিবীর সব প্রান্তের উন্নয়ন অর্থনীতির আলোচনার বিষয়। আমার বিশ্বাস, বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও প্রাপ্তি নিয়ে আগামী প্রজন্ম সুখী ও সমৃদ্ধ এক উন্নত বাংলাদেশে বসবাস করবে। আর তা সম্ভবপর হয়েছে আজ থেকে ৪৯ বছর আগের এ দিনটির জন্য। আমরা যেন কোনো অবস্থাতেই ভুলে না যাই, এ স্বাধীনতা ৩০ লাখ শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা। এ রক্তের ঋণ উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোধ করতে হবে। আগামীতে স্বাধীনতাকে আরও অর্থবহ এবং এর সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সর্বোচ্চ সততা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করে সামনের দিকে দীপ্তগতিতে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিয়ে মাতৃভাষার সম্মান রেখেছে, স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, এখন তার সুফলও ভোগ করছে। অনেক ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে, আরও সাফল্যের জন্য যেতে হবে অনেক দূর।
'আমার এ দেশ সব মানুষের'- এ স্লোগানকে ধারণ করে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা একদিন পৃথিবীর বুকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে- এটাই হোক এবারের বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।
সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন; বোর্ড অব ডিরেক্টরস, জীবন বীমা করপোরেশন, ঢাকা
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্ব মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়ানো একটি দেশের নাম। জনসংখ্যার ঘনত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনা মহামারি মোকাবিলা করে ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরামহীন অগ্রযাত্রা চলমান রয়েছে। এখন বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এতদঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য অনেকে স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেজন্য জীবনের ১১ বছর কেটেছে জেলে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিজেও পাননি; পরিবারকেও দিতে পারেননি। কিন্তু স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। তিনি বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন, সৃষ্টিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। এ জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দিয়েছেন। এ জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক অনন্তকাল বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী থাকবে।
এটা সত্য, ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণ ও ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালিরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও চরম বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষণ-দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে বাঙালিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। এতদসত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা নয়, দেশকে মার্চেই যেন স্বাধীন করে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের সাউথ এশিয়ান রিভিউ জার্নালে উল্লেখ করা হয়, 'বিচারকের অনুসরণ করে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের কর্মচারীরা যখন মুজিবের প্রতি সমর্থন জানায়, তখনই বাংলাদেশের ভেতরে ক্ষমতা কার্যত হস্তান্তর হয়ে যায় এবং ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহের মধ্যেই তা ঘটে। পরের তিন সপ্তাহে মুজিবের বাড়ি কার্যত বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েটে পরিণত হয়।' উত্তাল মার্চের পথ বেয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবস নিয়ে এম আর আখতার মুকুল রচিত 'আমি বিজয় দেখেছি' গ্রন্থ প্রসঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, 'আমার বন্ধু (আখতার মুকুল) বিজয় দেখেছেন, আমি যুদ্ধজয় দেখেছি, বিজয় দেখিনি। শত্রুরা সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আপাতত বিবরে লুকিয়েছে। তারা সামরিক পরাজয়বরণ করেছে, রাজনৈতিক যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। সময় ও সুযোগমতো তারা আবার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে। নতুন মুখোশ ধারণ করবে। নতুন স্লোগান দেবে। আমাদের মিত্রদের শত্রু বলে প্রচার চালাবে। শত্রুদের মিত্র বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। সেদিনই হবে আমাদের জয়-পরাজয়ের আসল যুদ্ধ। এই রাজনৈতিক যুদ্ধে যেদিন আমরা জয়লাভ করব, সেদিন হবে আমাদের যথার্থ বিজয় লাভ। বলতে পারব, আমরা বিজয় দেখেছি।'
মূলত ১৬ ডিসেম্বর ছিল আমাদের রণক্ষেত্রে বিজয়; জাতীয় বিপ্লবের সূচনামাত্র। বিপ্লব যে অসমাপ্ত রয়ে গেছে, আমরা যে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করিনি, এটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্যই তিনি স্বাধীনতা অর্জনের তিন বছর পূর্তি না হতেই দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী গণশত্রুরা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পাল্টা আঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগীয় মৌলবাদী শক্তি। এই দ্বিতীয় বিপ্লবের রণক্ষেত্রই বঙ্গবন্ধুসহ তার চার বিশিষ্ট সহকর্মী ও পরিবারের অধিকাংশ সদস্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল স্তম্ভগুলো অনেকাংশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এমনকি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের গতিপথও পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব যদি সফল হতো, তাহলে বাংলাদেশের অসমাপ্ত জাতীয় বিপ্লব সমাপ্ত হতো। আমরা চূড়ান্ত বিজয়ের অধিকারী হতাম। আমাদের স্বাধীনতার শত্রুশিবির এখন যতই রটাক, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি ও বিপ্লব সমাপ্ত হলে বাংলাদেশের চেহারা আজ অন্যরকম ধারণ করত।
বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের 'রোল মডেল'। কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা সত্ত্বেও গত অর্ধশতাব্দী ধরে আমাদের অর্জনও কম নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ৯১ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, তৈরি পোশাক, প্রবাসী জনশক্তি, রেল-নৌ ও যোগাযোগ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ও মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, বিনামূল্যে বই প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, শিশু-মাতৃমৃত্যু হ্রাস, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি ও বিচার চলমান রয়েছে; বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার ও শাস্তি হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির মূলোৎপাটন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এখন সবাই বুঝতে পারছেন কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়; অনিয়ম-দুর্নীতি করে আর পার পাওয়া যাবে না।
ইতোমধ্যে শত বছরের 'বদ্বীপ পরিকল্পনা, ২১০০' বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রা আজ পৃথিবীর সব প্রান্তের উন্নয়ন অর্থনীতির আলোচনার বিষয়। আমার বিশ্বাস, বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও প্রাপ্তি নিয়ে আগামী প্রজন্ম সুখী ও সমৃদ্ধ এক উন্নত বাংলাদেশে বসবাস করবে। আর তা সম্ভবপর হয়েছে আজ থেকে ৪৯ বছর আগের এ দিনটির জন্য। আমরা যেন কোনো অবস্থাতেই ভুলে না যাই, এ স্বাধীনতা ৩০ লাখ শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা। এ রক্তের ঋণ উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোধ করতে হবে। আগামীতে স্বাধীনতাকে আরও অর্থবহ এবং এর সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সর্বোচ্চ সততা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করে সামনের দিকে দীপ্তগতিতে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিয়ে মাতৃভাষার সম্মান রেখেছে, স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, এখন তার সুফলও ভোগ করছে। অনেক ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে, আরও সাফল্যের জন্য যেতে হবে অনেক দূর।
'আমার এ দেশ সব মানুষের'- এ স্লোগানকে ধারণ করে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা একদিন পৃথিবীর বুকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে- এটাই হোক এবারের বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।
সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন; বোর্ড অব ডিরেক্টরস, জীবন বীমা করপোরেশন, ঢাকা
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com