
অনলাইন সংলাপে শিশুরাই বলল নিজেদের কথা
বাল্যবিয়েতে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে উড়ে চলার ডানা
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০ । ০৩:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সমকাল প্রতিবেদক

শিশুদের মনের কথা অনেকেই শুনতে চান না। তাদের মতপ্রকাশের সুযোগও কম। শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকলেও মনের কথা কেউ জানতে চান না। অথচ আগামীর এই প্রজন্ম প্রাণ খুলে কথা বলতে পারলেই উঠে আসবে নতুন নতুন বাস্তবতা। কিন্তু বর্তমান সমাজে শিশুদের মতপ্রকাশের সুযোগ কম হওয়ায় তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাল্যবিয়ে, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো সহিংসতার শিকার হচ্ছে। নানা প্রতিবন্ধকতায় তাদের যুক্ত হতে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে।
এবার সেই শিশুরাই শুনিয়েছে তাদের মনের কথা। তুলে ধরেছে সমস্যা। নিজেদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা, মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা চেয়েছে সবার। গতকাল সোমবার 'এবার শুনবো শিশুদের কথা' শীর্ষক এক অনলাইন সংলাপে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের একঝাঁক শিশুর কণ্ঠে উঠে আসে বাল্যবিয়ে, করোনাকালের শিক্ষা পরিস্থিতি, মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার, নিরাপত্তা, শিশুশ্রম, প্রবেশগম্যতা, নিরাপদ যাতায়াত, ধর্ষণ, পরিবেশগত পরিবর্তন ও প্রভাব, পাঠ্যপুস্তক, নির্যাতন, সুবিধাবঞ্চিত ও বিশেষায়িতদের সমস্যাসহ নানা বিষয়।
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশের পক্ষে এই সংলাপের আয়োজন করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এতে মিডিয়া পার্টনার ছিল দৈনিক সমকাল। অনলাইন সংলাপ সঞ্চালনা করেন সমকালের সহকারী সম্পাদক শেখ রোকন। সংলাপে সারাদেশের ১৫ শিশু অংশ নেয়।
এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মুহিবুজ্জামান এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। সংলাপে স্বাগত বক্তব্য দেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের শিশু অধিকার ইউনিটের প্রকল্প সমন্বয়ক নুয়ারা সফিক দিশা।
এ সময় রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনে করি আমরাই সব জানি, আমরাই দক্ষ। তাই শিশুদের কথা শোনার ধৈর্য থাকে না। বিজয়ের মাসে আজ শিশুরা প্রাণ খুলে কথা বলেছে। তাদের মনের কথা উঠে এসেছে। আজকের সংলাপের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের সূচনা হলো। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে প্রবীণদের দায়িত্ব বেশি। প্রজন্ম যদি নানাভাবে হারিয়ে যায়, তাহলে এর ক্ষতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরেও পুষিয়ে নেওয়া যাবে না।
গণমাধ্যম যদি সুহৃদ হিসেবে থাকে, তাহলে অনেক কিছুই ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। যেমন সমকাল আজ শিশুদের কথাগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে।
মো. মুহিবুজ্জামান বলেন, আজ শিশুরা অত্যন্ত ভালো ভালো প্রসঙ্গ তুলে ধরেছে। চেষ্টা করব, তাদের বক্তব্য সংশ্নিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিতে। ১০৯ নম্বরে কল করে নির্যাতন কিংবা বাল্যবিয়ের শিকার শিশুরা প্রতিকার পাচ্ছে। এই হটলাইন পুলিশের দুটি হটলাইনের সঙ্গে সংযুক্ত। এ ছাড়া অ্যাপসের মাধ্যমেও আমরা সহায়তা দিচ্ছি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জেলা এবং উপজেলা কর্মকর্তাদেরও সহায়তা নেওয়া যাবে। এত পদক্ষেপের পরও যদি কোনো শিশু বিপদে পড়ে তাহলে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশুদের কথা কেউ শুনতে চায় না। তাদের মানসিক সমস্যা আছে কিনা, সেটা কেউ জানতে চায় না। মা-বাবাও তাদের কথা শোনে না। তাদের মনের যত্ন নেওয়া হয় না।
শেখ রোকন বলেন, নিজেদের শিক্ষা, দর্শন, চিন্তা সব আমরা শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার।' তোমার যা ভালো লাগে সেটাই করো। বাকিদের কাজ বাকিরা করবে। কিন্তু অনেক ভারই সরকারের হাতে থাকে। সব ভার হয়তো তাদের আমরা দেব না। কিন্তু তাদের কিছু ভার নিতে হবে। আমরা শিশুদের কথা শুনলাম। তারা তাদের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছে। একটি মুখের হাসির জন্য আমরা অস্ত্র ধরেছি। আমরা শিশুদের কথা শুনেছি, কিন্তু তাদের মুখে হাসি নেই। শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে পারব। তিনি বলেন, সমকাল সব সময় শিশুর অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। 'ঘাসফড়িং' নামে শিশুদের জন্য একটি পাতা আছে সমকালে- সেখানে শিশুরা তাদের মনের কথা তুলে ধরতে পারে।
নুয়ারা সফিক দিশা বলেন, দশটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার জোট চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ তাদের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ সংলাপ করছে। শিশুদের অংশগ্রহণে এ সংলাপের মধ্য দিয়ে তাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার কাজ এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
সংলাপে কুড়িগ্রামের শিশু মেহজাবিন মোনিরা বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি তুলে ধরে বলে, করোনাকালে বাল্যবিয়ের কারণে শিশুদের উড়ে চলার ডানা দুমড়েমুচড়ে ভেঙে যাচ্ছে। কুড়িগ্রামে বেশিরভাগ মা-বাবা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেন। পরিবারের ভার কমিয়ে তারা চান চাপ কমাতে। ফলে অনেক শিশুই বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। নিজের স্বপ্নগুলো সাজাতে না সাজাতেই এক রাশ দুঃখ শিশুকে গ্রাস করছে।
নওগাঁর শিশু মনিরা বাল্যবিয়ে নিয়ে তার গ্রামের ঘটনা তুলে ধরে বলে, আমাদের এলাকায় একটি মেয়েকে ১৫ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। সে তার বাবা-মাকে পড়াশোনার কথা বললেও তারা শোনেননি। এক পর্যায়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করে।
করোনাকালে শিশুশিক্ষা পরিস্থিতি ও সরকারের অবস্থান বিষয়ে ঢাকার গুলশানের শিশু রুবিয়া আক্তার বলে, অনলাইনে শিক্ষা শিশুদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। কারণ এ সুযোগ বহু শিশুরই নেই।
ঢাকার শিশু দোলা আক্তার রেবা জানায়, বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে আইনগত কঠোরতার পাশাপাশি মানুষের চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন জরুরি। নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মেয়েদের এই পৃথিবী দেখাতে হবে।
চট্টগ্রামের শিশু সহিদুল ইসলাম শিক্ষাকেন্দ্রে বিশেষায়িত শিশুদের প্রবেশগম্যতা বিষয়ে বলে, আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার সময় হুইলচেয়ারে চলাচল করি। অথচ স্কুলে আমাদের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। স্কুলে এলে চলাচলের জন্য উপযুক্ত সিঁড়ি পর্যন্ত নেই।
রাজধানীর শিশু শাকিব আহমেদ বলে, ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিকের কারণে শিশুদের মানসিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। শিশুরা যেন পর্নো সাইটগুলোতে প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
শিশুর নিরাপত্তা ও শিশুশ্রম বিষয়ে জেরিনা আক্তার বলে, সমাজে বর্তমানে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে। এই শিশুশ্রম বন্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। বর্তমানে শিশুদের নিজের বাসায়ও নিরাপত্তা নেই।
শিশুদের যাতায়াতের বিষয় তুলে ধরে গুলশানের শিশু শারমিন আক্তার বীথি জানায়, রাস্তাঘাটে যাতায়াতে তারা সমস্যায় পড়ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে যাওয়ার পর যাতায়াত ব্যবস্থা আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যাতায়াত খরচ দরিদ্র পরিবার সংগ্রহ করতে পারে না।
জাহিদুল ইসলাম জানায়, সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাইলেই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা তা পারে না। তাদের পড়ার উপযোগী বই প্রকাশের উদ্যোগও সীমিত।
সেতু আক্তার জানায়, যৌনপল্লির শিশুরা কোনো স্বাস্থ্য সহায়তা পায় না। তারা পড়াশোনা করতে পারে না। পড়ার পরিবেশ নেই। সরকার সহায়তা করলে তাদের সে পরিবেশ তৈরি হতো। তাতে অনেক শিশু আলোর পথে আসত।
শিশু ধর্ষণ প্রসঙ্গে বীথি মজুমদার জানায়, শিশুরা নিকটাত্মীয় ও শিক্ষকদের কাছেও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণেরও শিকার হচ্ছে। ধর্ষকরা যেন ছাড় না পায়। বাংলাদেশ যেন ধর্ষণমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে উঠে।
আহনাফ আনাম অর্ক পরিবেশগত পরিবর্তন ও শিশুদের ওপর এর প্রভাব বিষয়ে জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শিশুরা অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ দেশে বন্যার কারণে ডুবে যাওয়া এলাকার শিশুরা চরম বিপর্যয়ে পড়ছে।
শিশু নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ঢাকার সূত্রাপুরের শিশু মো. রাতুল বলে, আমি যে এলাকায় বাস করি, সেখানে শিশুরা নানা নির্যাতনের শিকার। ফলে অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে কাজ করছে। কিন্তু সেখানেও মালিকের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
মো. তরিকুল ইসলাম নাজিম বলে, নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিকার চাইতে গেলে কী করতে হবে, তা আমি জানি না। এমন ক্ষেত্রে শিশুরা কী করবে, সেটি যেন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
আফসানা কবির বলে, আমাদের দেশে সব শিশু তার অধিকার পায় না। আজকের শিশুদের হাতেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ। তাই প্রতিটি শিশু যেন তাদের অধিকার যথাযথভাবে পায়।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com