উত্তরা আবাসিক শহর প্রকল্প: তৃতীয় পর্ব

উৎকোচের বিনিময়ে ২৯ প্লট বরাদ্দ

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০ । ০৩:২৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

অমিতোষ পাল

ছবি: ফাইল

রাজউকের উত্তরা আবাসিক শহর (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্পের বাণিজ্যিক প্লটের আকার ছোট করে, বিলুপ্ত করে ও গোলচত্বরের জায়গা কমিয়ে আবাসিক প্লট আকারে বরাদ্দ দিচ্ছে রাজউক। অনেকটা গোপনে এ কাজ চলছে। গত ১০ বছরে উৎকোচের মাধ্যমে এ রকম ২৯টি প্লট বরাদ্দের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজউকের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বহিরাগত দালালরা যোগসাজশ করে এ কাজ করে চলেছেন। বিনিময়ে বরাদ্দপ্রাপ্তের কাছ থেকে পেয়েছেন আর্থিক সুবিধা। ফলে প্রকল্পের মূল নকশা তছনছ হওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংস্থাটি। রাজউকের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী দালাল মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়ার পর এসব কাহিনি বেরিয়ে এসেছে। কিছু প্লটের কারসাজির সঙ্গে গোল্ডেন মনিরও যুক্ত ছিলেন। রাজউক থেকে এসব প্লটের তালিকা নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ প্রকল্পে বাণিজ্যিক প্লট ছিল ৩৫টি। এসব প্লটের বেশিরভাগেরই আয়তন কমবেশি এক বিঘা। রীতি অনুযায়ী রাজউক এসব প্লটের বিপরীতে বরাদ্দের আবেদনপত্র আহ্বান করে। আবেদনকারীদের মধ্যে লটারি করে সেগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি কাঠার দর থাকে ৩৫ লাখ টাকা। বিপরীতে আবাসিক প্লটের প্রতি কাঠার দর থাকে তিন লাখ টাকা।

রাজউক সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে মোট প্লটের সংখ্যা আট হাজার ৫৪৪টি। এর মধ্যে এক বিঘা আয়তনের বাণিজ্যিক প্লট বর্তমানে আছে মাত্র ২২টি। বাকি ১৩টি প্লট ভেঙে আবাসিক হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ অনেক আগেই রাজউক থেকে আবাসিক প্লট বরাদ্দের কাজ পুরো সম্পন্ন হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। তারপরও এখানে আবাসিক প্লট বরাদ্দের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ ৬/২০২০ বোর্ড সভায় একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেটা পেয়েছেন রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম। এ ছাড়া সাবেক দুই চেয়ারম্যান আবদুর রহমান ও জয়নাল আবেদিনের সময়ও এভাবে প্লট বরাদ্দের ঘটনা ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বর্তমান চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। আর আবদুর রহমান সমকালকে জানান, তার যতটুকু মনে পড়ে, তিনি চেয়ারম্যান থাকার সময় উত্তরা তৃতীয় পর্বে কোনো বাণিজ্যিক প্লটকে আবাসিক হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। আর সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিনের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলে তার মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

লোকসান হয় রাজউকের, সুবিধা পায় অন্যরা :জানা যায়, এক দশক আগে উত্তরা তৃতীয় পর্বের সব আবাসিক প্লট বরাদ্দ দেওয়া শেষ হলে কিছু বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্লট রয়ে যায়। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি রাজউকের দালালদের শরণাপন্ন হন। কিছু 'খরচ' (উৎকোচ) দিয়েও তারা প্লট নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন ওই দালালরা রাজউকের চেয়ারম্যান বরাবর প্লটের জন্য আবেদন করার পরামর্শ দেন। ঢাকায় থাকার কোনো নিজস্ব জায়গা নেই বলে তারা প্লট প্রাপ্তির আবেদন করেন। অনেকে সরকারের প্রভাবশালী কর্মকর্তা, স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী বা পূর্তমন্ত্রীর সুপারিশও আবেদনে যুক্ত করেন। এর পরই শুরু হয় লেনদেন। আবেদনকারীর কাছ থেকে মোটা উৎকোচ নিয়েই দালালচক্র রাজউকের চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হন। তারা বলেন, বাণিজ্যিক প্লটগুলোর আকৃতি ছোট বানিয়ে বা বিলুপ্ত করে কিংবা গোলচত্বরের জায়গা কমিয়ে সেখানে প্লট দেওয়া যেতে পারে। আবেদনকারী ও দালালরা শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও উৎকোচ দিয়ে হাত করেন। তখন শীর্ষ কর্মকর্তারাও নমনীয় হয়ে যান। এরপরই রাজউকের প্লট বরাদ্দ বিধিমালার ১৩/১ ধারায় তাদের প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যারা রেখেছেন, তাদের রাজউক চাইলে প্লট বরাদ্দ দিতে পারে। তখন প্রকল্পের নকশা কাটাছেঁড়া করে একেকটি বাণিজ্যিক প্লটকে বিভিন্ন আয়তনে ভাগ করে দেওয়া হয় প্লট বরাদ্দ। অনেকে দালাল ছাড়া সরাসরিও তদবির করে এভাবে প্লট পেয়েছেন। এসব প্লটের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৩০ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত উৎকোচ বাণিজ্য হয়েছে বলে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

৩৫ লাখ টাকার জমি ৩ লাখ টাকায় বিক্রি: উত্তরা তৃতীয় পর্বে বাণিজ্যিক প্লটের প্রতি কাঠার মূল্য ৩৫ লাখ টাকা। বিপরীতে আবাসিক প্লটের প্রতি কাঠার মূল্য তিন লাখ টাকা। ফলে বাণিজ্যিক থেকে আবাসিকে পরিবর্তনের কারণে এসব প্লটের প্রতি কাঠায় রাজউকের ক্ষতি হয়েছে ৩২ লাখ টাকা। এভাবে ১৩২ কাঠা জমি বাণিজ্যিক থেকে আবাসিকে পরিবর্তন করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ খাতে রাজউকের লোকসান হয়েছে ৪২ কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার টাকা। রাজউক সূত্র জানায়, এসব প্লটের বিপরীতে রাজউক ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পেলেও এগুলোর একেকটি প্লটের বর্তমান দাম তিন কোটি থেকে সাত কোটি টাকা।

যেসব প্লট নিয়ে অভিযোগ: উত্তরার ১৫/সি ও ১৫/সি১ নম্বর সেক্টরের সাতটি প্লটের দালালি করেছেন গ্রেপ্তারকৃত গোল্ডেন মনির। তার সহযোগী ছিলেন রাজউকের হিসাব সহকারী মো. হাসান ওরফে ক্যাশিয়ার হাসান। প্লটগুলো হলো- অ্যাভিনিউ ৯-এর ২-এ, ১/এ নম্বর রোডের প্লট ২-এ, ১-এ, ১ নম্বর রোডের ১-এ, ২/সি নম্বর রোডের ২-এ, ২-বি, ২/ডি নম্বর রোডের ১-এ। এসব প্লটের আয়তন সোয়া চার কাঠা থেকে ৪ দশমিক ৭৭ কাঠা। গোল্ডেন মনির জেলে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আর এ প্রসঙ্গে ক্যাশিয়ার হাসানকে বারবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।

১৫সি, ডি, ই, এফ, জি এবং ১৬এইচ সেক্টরের অ্যাভিনিউ-৯-এর গোলচত্বরের জায়গা কমিয়ে পার্শ্ববর্তী তিন কাঠার প্রতিটি প্লটকে চার কাঠা করা হয়েছে। এ প্লটগুলো হলো- ১৫ই সেক্টরের অ্যাভিনিউ-৯-এর ৩৭-এ, ২-এ, ১৫ সেক্টরের অ্যাভিনিউ-৯-এর ৩৭-এ, ১৫-সি-১ সেক্টরের অ্যাভিনিউ-৯-এর প্লট ১১-এ, ১৫ডি সেক্টরের অ্যাভিনিউ-৯-এর প্লট ১-এ, ১৫জি সেক্টরের অ্যাভিনিউ-৯-এর প্লট ১-এ, ১৫সি সেক্টরের অ্যাভিনিউ-৯-এর প্লট ৩৪এ, ৩৩-এ, ২-এ, সেক্টর ১৬এইচ-এর অ্যাভিনিউ ৯-এর প্লট ৩৭-এ। এগুলোর তদবির করেছেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী রুহুল আমিন। তার সহযোগী ছিল রাজউকের কার্যমান সহকারী খালেদ মোশাররফ তালুকদার রুবেল ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আবদুল মমিন। এ প্রসঙ্গে রুহুল আমিন সমকালকে বলেন, 'জায়গা রাজউকের, নিয়েছে অন্যরা। আমি তো রাজউকের কেউ না। বরাদ্দ দিলে দিয়েছে রাজউক। সেখানে আমার তো কোনো প্লট নেই। এখন শুনছি, দুদক আমাকে নিয়েও তদন্ত করছে। এখন তদন্ত করে দেখুক, সত্যটা কী।'

এ ছাড়া ৭ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের ২২ নম্বর প্লট, ১৩ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের ২৯, ১২ নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর রোডের প্লট ১ ও ৩, সোনারগাঁও জনপথ রোডের প্লট ১/এ, ১৫ডি নম্বর সেক্টরের ৬ নং রোডের প্লট ১-এ, ১৫সি১ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের প্লট ২-এ, অ্যাভিনিউ-৯এর প্লট ২-এ, রোড ১-এ'র প্লট ১-এ, অ্যাভিনিউ-৯-এর প্লট ১১-এ ও ২-এ, সেক্টর ১৬এইচ-এর অ্যাভিনিউ ৯-এর প্লট ৩৭-এ। এগুলোর আয়তন সোয়া চার কাঠা থেকে আট কাঠা পর্যন্ত। এগুলোর দালালির সঙ্গে জড়িত ছিলেন শ্রমিক নেতা আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু ও এম এ মালেক। এর মধ্যে এম এ মালেক অবসরে গেছেন। নান্নু সহকারী অথরাইজড অফিসার হিসেবে রাজউকে কর্মরত। এ বিষয়ে নান্নুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com