
স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০ । ১৭:০৭
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার

বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর অডিওবার্তাটি মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। যার শেষাংশে তিনি বলেছেন, 'আমরা এই দেশকে একটি উন্নত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত করার মাধ্যমে লাখ লাখ শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।' প্রশ্ন হলো- এই বার্তার সঙ্গে বাস্তবতা কতটা সংগতিপূর্ণ? গত এক যুগে সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশটির উন্নয়ন খুব দ্রুত ত্বরান্বিত হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু দুর্যোগ বা বিপর্যয় মোকাবিলায় শক্তিশালী সেক্টরাল কন্টিনজেন্সি পরিকল্পনার ভিত ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন কাঠামো ভালোভাবে তৈরি হয়নি। উদাহরণস্বরূপ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসংলগ্নতা ও সমন্বয়হীনতার কথা বলা যায়। তা সত্ত্বেও করোনা পরিস্থিতির মতো একটি জটিল বৈশ্বিক সংকটকে বাংলাদেশে সামগ্রিক ও চূড়ান্তভাবে মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্ব ও দৃঢ়তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
প্রধানমন্ত্রীর সুবিবেচনার কারণে গত প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের বাজেটে স্বাস্থ্য খাত একটি অগ্রাধিকার বরাদ্দের বিবেচিত হয়ে আসছে এবং আমাদের অনেক ভালোমানের চিকিৎসকও আছেন। কিন্তু দুর্নীতি গবেষণাপত্র, ভুক্তভোগীদের মতামত ও জনমানুষের সাধারণ ধারণা থেকে এটি প্রকাশ পায় যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়টির মূল সমস্যা বাজেট বা অর্থ-সংকট নয়; বরং সিস্টেম লস, ক্রয় সম্পর্কিত আমলাতান্ত্রিক স্বার্থ, উপকরণগত সীমাবদ্ধতা, কর্তব্যে অবহেলা, দুর্বল জনস্বাস্থ্য পরিষেবা, মানসম্মত জবাবদিহি কাঠামো তৈরিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং সংকটজনক পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভালো কন্টিনজেন্সি পরিকল্পনার অভাব।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের যথেষ্ট আন্তরিকতার পরও দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা চিকিৎসা সেবা-অব্যবস্থাপনা ও অপ্রতুলতায় সুস্থ থাকার কঠিন বাস্তবতা দেখা গেল। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার না করে সরকারের শীর্ষ ও নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে কীভাবে স্বাস্থ্য-সেবা-অব্যবস্থাপনার অশুভ সিন্ডিকেট ভেঙে কার্যকরী অর্থে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন করা যায়, সেদিকে গভীর মনোযোগ দেওয়া সময়ের দাবি ও আবশ্যক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সেটা সম্ভবপর হবে বলে বিশ্বাস করি। অবশ্য তার জন্য চিকিৎসক ও নার্সদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। সামনে সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং পৃথিবীও প্রায়ই বিরূপ ভাবাপন্ন থাকবে। তাই এখনই এটি করতে হবে।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বাস্তবতা আমরা দেখছি। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর যখন দেশ প্রস্তুত সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে, তখন এখানে দেখা যাচ্ছে ধর্মের কথা বলে অসহিষুষ্ণতা তৈরি করার চেষ্টা; একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী সম্মানিত আলেম-সমাজকে বিতর্কিত করার এবং শান্তির ধর্ম 'ইসলাম'কে অসহিষুষ্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। ধর্মের ভাবতাত্ত্বিক কোনো বিষয়কে হঠাৎ সামনে নিয়ে আসার, রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড় করানোর এবং এরূপ ইস্যুতে আন্দোলন ও জবরদস্তি করার উদ্দেশ্য কী? রাষ্ট্র চলে তার সংবিধান এবং আইন ও বিধিবিধানে। ধর্মীয় বিষয়টিকে রাজনীতির মাঠের খেলা না বানিয়ে তাদের কোনো দাবি বা প্রস্তাবনা থাকলে তারা তা সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে করতে পারত। তা ছাড়া ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে জবরদস্তির তো কোনো সুযোগ নেই। এরূপ মুভমেন্টে প্রতিহিংসা ও অস্থিরতা ছড়ানো ছাড়া মানুষের মুক্তির, অধিকার রক্ষার বা জনকল্যাণের তো কোনো সম্পর্ক নেই।
এখন আসা যাক উন্নত এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের কথায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তিনি বাবার দেখানো আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করছেন এবং দেশটিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়েছে। এর আগে বিশ্বব্যাংক নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 'আইসিটি বিপ্লব থেকে স্যাটেলাইট বিপ্লবে উত্তরণ' তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ উন্মোচিত করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন- যা দেশটিকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। প্রথম আলো (১৩ ডিসেম্বর ২০২০) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে- 'এই সেতু শুধু যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করবে না, অর্থনৈতিক সুফল পাবে ২১ জেলার মানুষ। জিডিপি বাড়বে ১.২৩%।'
কিন্তু আমার কাছে এটি শুধু একটি সেতু নয়, দেশের একটি চ্যালেঞ্জিং স্বপ্ন বাস্তবায়ন; বিশ্বব্যাংক ও দাতাদের চ্যালেঞ্জ করা- সাহায্য করতে হলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে যথাবিহীত সম্মান এবং তার নীতি ও কৌশলপত্র মেনেই করতে হবে- অসম শর্তযুক্ত ঋণ বা দাদাগিরির উন্নয়ন সহায়তা আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে ও হাঁটতে শিখেছি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে এটি আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ সেতু বন্ধন। এটি বলছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে অমিত সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেন, দেখান এবং তা বাস্তবায়ন করেন। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু- যার অপেক্ষা ২০ বছরের। ১৯৯৯ থেকে ২০২০। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতুর প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ২০২০ সালে বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন করে।
বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরিতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। অধিকন্তু এর রেল সংযোগে ব্যয় হবে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ব্যয়সমূহ জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়াবে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)'র ২০০৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন (ইআরআর) দাঁড়াবে বছরে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ, যা সময়ের ব্যবধানে আরও বাড়তে পারে। সেতু বিভাগের মতে, সেতুটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর পাশাপাশি বাগেরহাটের মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করবে। এটি হবে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের একটি মাইলফলক অবকাঠামো।
সরকারের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন সাফল্য ও প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্বীকৃতি প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সেরা পাঁচজন নীতিমান নেতার একজন, বিশ্বের ৫০ জন মহান নেতার মধ্যে দশম। বিশ্বের শীর্ষ ১০০ চিন্তাবিদের তালিকায় রয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বমানবতারও প্রতীক। তিনি তার বাবা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ, প্রজ্ঞা, সততা ও রাজনৈতিক দর্শনকে অনুসরণ করে হাঁটছেন। তাই তিনি দেশটিকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিতে পেরেছেন। তার এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে সবার, বিশেষ করে সাধারণ জনগণের অব্যাহত সহযোগিতা প্রয়োজন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com