
সরাসরি যুদ্ধে পরপর দুইবার গুলিবিদ্ধ হই
বরিশাল
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০ । ০০:০০ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২১ । ১৭:২১ | প্রিন্ট সংস্করণ
মহিউদ্দিন মানিক [বীরপ্রতীক]

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারকীয় গণহত্যা চালালেও বরিশাল হানাদারমুক্ত ছিল ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে ২৫ মার্চের কালরাতের পর তৎকালীন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের নেতৃত্বে আমরা বরিশালে সংগঠিত হই এবং ২৬ মার্চ রাতে বরিশাল পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ও গুলি বের করে আনি। তৎকালীন পুলিশ সুপার গড়িমসি করলেও হাবিলদার আকবর, দবিরুল ইসলাম, মফিজসহ কয়েকজন আমাদের অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহে সহায়তা করেন। সংগ্রহ করা অস্ত্র ও গুলি আমরা একটা জিপ গাড়িতে করে নিয়ে যাই বরিশাল শহরের অদূরে লাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে। সেখানে হালিম চেয়ারম্যানের জিম্মায় ওই অস্ত্র রাখা হয়। কিছু অস্ত্র শহরতলির ব্যারিস্টার বাড়িতেও রাখা হয়।
ভোররাতে আমরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখে বরিশাল শহরে বগুড়া সড়কের নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাড়িতে আসি। সেখানে আমাদের ২০-২৫ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দলকে অজু করিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যেতে শপথবাক্য পাঠ করান নুরুল ইসলাম মঞ্জুর। শপথ পড়ানো শেষে আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন তিনি। আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের তৎকালীন দক্ষিণাঞ্চলীয় সচিবালয় বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নিই। আমাদের দলসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ইচ্ছুক আরও কিছু যুবক-তরুণকে তখন তৎকালীন বেলস পার্ক (বঙ্গবন্ধু উদ্যান) ও সরকারি বালিকা বিদ্যালয় মাঠে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন আনসার বাহিনীর আবু মিয়া ও আলেফ মিয়া। এছাড়াও শহরের আশপাশে বাঁশের লাঠি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতেন সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।
১৮ এপ্রিল আকস্মিক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বরিশালে বিমান হামলা চালায়। পুলিশ লাইন্স, হেমায়েত উদ্দিন খেলার মাঠ ও বিআইডব্লিউটিএ'র স্থাপনায় আকাশ থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। হামলায় ওই দিন একজন নিহত ও ৪-৫ জন আহত হয়েছিলেন। বিমান হামলার পর বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারা আরও সতর্ক হয়ে যান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যাতে বরিশাল শহরে ঢুকতে না পারে সেজন্য জল ও স্থলপথে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সতর্ক অবস্থান নেন। তৎকালীন ক্যাপ্টেন মেহেদির নেতৃত্বে আমিসহ ৭/৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা-বরিশাল নৌপথের সব ধরনের সিগন্যাল বিনষ্ট করি।
২৫ এপ্রিল দুপুরে জল, স্থল ও আকাশপথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বরিশালে প্রবেশ করে। স্থলপথে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ির বহর গৌরনদীর কটকস্থল অতিক্রমকালে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হাশেম, আব্দুল হাকিম ওরফে বাহরাম ও আব্দুস সালাম মন্টুর নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। সেখানে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে আধাঘণ্টাব্যাপী তুমুল যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে শহীদ হন আলাউদ্দিনসহ ৩ জন। পাকিস্তানি বাহিনীর ৮ সদস্য নিহত ও ১০-১২ জন আহত হয়। হানাদার বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। বিশাল গাড়ির বহর নিয়ে হানাদাররা সড়কপথে সন্ধ্যার আগে বরিশাল শহরে এসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোয়ার্টারে (ওয়াপদা কোয়ার্টার) অবস্থান নেয়। নৌপথে হানাদার বাহিনী আসে তালতলী হয়ে। তালতলী নেমে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ২৫ এপ্রিল থেকেই বরিশাল শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে।
আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিরাপদ এলাকায় চলে যাই। আমি বানারীপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি। বানারীপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা বেণী লাল দাসগুপ্তের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠন করি। সেখানে মুক্তিবাহিনী গঠনের পর পরই আমরা বানারীপাড়া থানা অবরুদ্ধ করে রাখি। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট গ্রুপগুলো বরিশালের বিভিন্ন থানায় অবস্থান নিয়ে স্থানীয় রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ শুরু করে। আগস্ট মাস পর্যন্ত ছোট ছোট যুদ্ধ হয় জেলার বিভিন্ন স্থানে। এরমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর (বীরউত্তম) পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বরিশালের উজিরপুরের বড়াকোঠা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেন। প্রতি থানায় একজন বেইজ কমান্ডার নিযোগ দেওয়া হয়। আমি ক্যাপ্টেন ওমরের সঙ্গে থেকে যাই। বেইজ কমান্ড গঠনের পর প্রতি থানায় ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
প্রথম সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। এক রাতে বাবুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করি। ওহাব খান ও সুলতান মাস্টারের গ্রুপ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাবুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর। ওই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ওমর গুরুতর আহত হন। শহীদ হন উজিরপুরের আলতাফ (বীরবিক্রম)। ওই রাতে ১৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। দুই ঘণ্টা যুদ্ধ শেষে আমরা ফিরে যাই।
দ্বিতীয়বার সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেই পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থানার ইন্দেরহাটে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আমরা ইন্দেরহাটে সন্ধ্যা নদীতে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের গানবোট আক্রমণ করি। তবে ওই আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদাররা গানবোট নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরপর ঝালকাঠির গাবখান নদী দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গানবোট যাওয়ার সময় আমরা অতর্কিত আক্রমণ চালাই। ওই আক্রমণে কাউখালীর পনাউল্লাহ পনার গ্রুপ অংশ নেয়। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সম্মুখযুদ্ধে গৌরনদীর মনোরঞ্জনসহ ২ জন যোদ্ধা শহীদ হন।
ঝালকাঠির শ্রীমন্তকাঠি থেকে আমরা ৭০-৮০ জনের মুক্তিযোদ্ধার দল নৌকার বহর নিয়ে রওনা দিই ঝালকাঠির নলছিটির উদ্দেশে। খালে পানি কম থাকায় আমাদের সবাইকে নৌকা ঠেলে নিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা নলছিটির মানপাশার একটি খালে নৌবহর থামাই ভোররাতে। সবাই ক্লান্ত ছিলাম। দিনটি ছিল ১৩ নভেম্বর। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দু'জন লোক এসে আমাদের জানান, পার্শ্ববর্তী চাচৈর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদাররা এসেছে। এ খবর ক্যাপ্টেন ওমরকে জানালে তার নেতৃত্বে আমরা চাচৈরের দিকে রওনা হই। দূর থেকেই দেখতে পাই গ্রামে আগুন জ্বলছে। আমরা আগুন নেভানোর কাজ শুরু করলে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ঘেরাও করে ফেলে। এক পর্যায়ে আমাদের দলের জিয়াউদ্দিন পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে মর্টার চার্জ করলে হানাদারদের ১১ সৈন্য নিহত হয়। এরপর শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। দিনভর যুদ্ধ হয়। সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানি হানাদাররা বেপরোয়া ব্রাশফায়ার করতে থাকে। আমাদের সঙ্গে গোলাগুলির সময় পাকিস্তানি হানাদারদের ছোড়া একটি গুলি আমার কপালের ডান পাশে লেগে চলে যায়। এতে আমি রক্তাক্ত হই। আহত হন সহযোদ্ধা কাজেম আলী। শহীদ হন আউয়াল। আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে এলে আমরা যুদ্ধ প্রত্যাহার করে বাকেরগঞ্জের পাদ্রিশিবপুর যাই। পাদ্রিশিবপুর মিশনারি হাইস্কুলের তৎকালীন ফাদার আমাকে এবং কাজেম আলীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেন।
চাচৈর যুদ্ধে আমাদের গোলাবারুদ শেষ হলে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ করি। খবর পাই আগৈলঝাড়ার কোদালধোয়ায় মুজিব বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রধান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ঘাঁটিতে বিপুল গোলাবারুদ আছে। ক্যাপ্টেন ওমরের নেতৃত্বে আমিসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কোদালধোয়া গিয়ে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কাছ থেকে গোলাবারুদ সংগ্রহ করে পাদ্রিশিবপুর নিয়ে আসি। পরবর্তীকালে ঝালকাঠির রাজাপুর থানা আক্রমণ করে দখল করি।
দ্বিতীয়বার গুলিবিদ্ধ হই বাকেরগঞ্জ থানা দখল করতে গিয়ে। ৭ ডিসেম্বর বাকেরগঞ্জের জাফর-নাসির বাহিনী বাকেরগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। এ খবর পাওয়ার পর আমি পাদ্রিশিবপুর থেকে ১০ সহযোদ্ধাকে নিয়ে বাকেরগঞ্জে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেই। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে থানার মধ্যে ঢুকে দু'জন অফিসারের রিভলবার কেড়ে নিই এবং তাদের আটক করি। এ সময় পাকিস্তানি হানাদারদের একটি গুলি এসে আমার হাঁটুতে বিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লে কলসকাঠির প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক তালুকদার মনু কাঁধে করে আমাকে থানা থেকে বের করেন। আবারও পাদ্রিশিবপুরের মিশনে গিয়ে ফাদার জার্মানের চিকিৎসা নেই এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি।
৮ ডিসেম্বর বরিশাল হানাদারমুক্ত হয়। জেলার সর্বত্র মুখরিত হয় জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে। মুক্তিযোদ্ধারা শহরের সড়কে সড়কে এবং থানা পর্যায়ে উল্লাস শুরু করেন। তবে আমরা ক্যাপ্টেন ওমরের নেতৃত্বে বাকেরগঞ্জের পাদ্রিশিবপুর থেকে বরিশালে আসি ১০ ডিসেম্বর। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে হারালেও মুক্ত বরিশালে ফেরার দিন আমাদের চোখেমুখে ছিল আনন্দের হাসি।
লেখক : খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখন :: পুলক চ্যাটার্জি, ব্যুরো প্রধান, বরিশাল ব্যুরো
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com