ভাষাকন্যার 'বহিস্কারাদেশ' বাতিল হোক

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২১ । ০৩:০১ | প্রিন্ট সংস্করণ

সুপা সাদিয়া

ছালেহা বেগম

'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়...'

কতজন জীবন দিয়েছেন এই বাংলাকে আমাদের করতে। কতজনের কত আত্মত্যাগ। কতজনের কথাই-বা আমরা জানি। আর তেমনি এক অপরিচিতার কথাই বলতে এসেছি আজ। সর্বকনিষ্ঠ এক কন্যাকে হারাতে হয়েছিল তার শিক্ষা গ্রহণের অধিকার। তিনি ভাষাকন্যা ছালেহা বেগম। ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের মেধাবী ও সাহসী ছাত্রী। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাঁতারেও তিনি ছিলেন পারদর্শী।

১৯৫২ সালে ছালেহা বেগম দশম শ্রেণির ছাত্রী। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলিবর্ষণে শহীদ হওয়ার খবর পৌঁছে যায় ময়মনসিংহ শহরেও। ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীরা সেদিন ক্লাস বর্জন করে। পরদিন ছালেহা বেগমসহ আরও বেশ কয়েকজন স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। কালো পতাকা হাতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে মিছিল প্রদক্ষিণ করে; যার নেতৃত্ব দেন কিশোরী ছালেহা বেগম। স্টেশন রোড হয়ে বিদ্যাময়ী স্কুলের সামনে এসে ওই স্কুলের ছাত্রীদেরও মিছিলে যুক্ত করেন। বিদ্যাময়ী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা খানমের কঠিন প্রহরা ভেঙে সেই স্কুলের ছাত্রীদের ও ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীদের সম্পৃক্ত করায় নেতৃত্ব দেন ছালেহা বেগম। কালো পতাকা হাতে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন- 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই, রাজপথে গুলি কেন, জবাব চাই, জবাব চাই...।'

২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ঢাকায় ভাষার জন্য শহীদ হওয়ার খবর পৌঁছে যায় ময়মনসিংহে। পরদিন শুক্রবার সারাদেশে সব প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভের মতো ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়; যার নেতৃত্ব দেন ছালেহা বেগম। স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বেগম মেহেরুননেছা এবং জেলা প্রশাসক এম এ মজিদ যৌথভাবে ছালেহা বেগমকে তিরস্কার করেন। আর নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গের কঠিন শাস্তিস্ব্বরূপ ছালেহা বেগমকে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিস্কার ঘোষণা করা হয়। তখন ওই অল্প বয়সেই তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এর থেকে আন্দোলনরত অবস্থায় গুলি খেয়ে তিনি যদি শহীদ হতেন, সেটিকে শ্রেয় মনে করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ছালেহা বেগম কষ্ট-অপমান নিয়ে ছাত্রত্ব হারিয়ে স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ছালেহা বেগমকে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিস্কার করা হলে তিনি ক্ষোভে আর লেখাপড়া করেননি। তিনি প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে হন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। ১৯৫৮ সালে বোনদের সঙ্গে গড়ে তোলেন কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষকতাও করেন। ১৯৬৩ সালে কুষ্টিয়ার চাঁদ সুলতানা হাইস্কুলে বিনা বেতনে বাংলা, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে পাঠদান করাতেন। নারীর ক্ষমতায়নে তিনি কাজ করেছেন। ১৯৭৮ সালে গড়ে তোলেন বয়স্ক নারী শিক্ষাকেন্দ্র।

আমাদের প্রত্যেকের জানা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রত্ব থেকে বহিস্কার করা হয়। ৬১ বছর পর ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিস্কারাদেশ বাতিল করে। ভাষাকন্যা এবং মুক্তিযুদ্ধে সোচ্চার ছালেহা বেগমকে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুল থেকে যে তিন বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হোক। ইতোমধ্যে বিষয়টি নজরে এনেছেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার। আশা করছি, অতি দ্রুত বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।

গবেষক-লেখক ও সংগঠক
supasadia@yahoo.com

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com