অমর একুশে

একুশে ফেব্রুয়ারি কতটা আন্তর্জাতিক

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২১ । ০০:০০ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২১ । ০৩:০২ | প্রিন্ট সংস্করণ

দাউদ হায়দার

আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মূলে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন। ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশে দেশে মাতৃভাষা অক্ষুণ্ণ, রক্ষণাবেক্ষণে আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার জন্য, ভিত আরও পোক্ত করার আশায়। বলা ভালো, বাসনায়। অর্থাৎ, মাতৃভাষা চর্চার। হচ্ছে কি?

পৃথিবীজুড়ে এথনিক কালচারের মতো মাতৃভাষাও (এথনিক কালচারেই যুক্ত মাতৃভাষা) দুয়োরানী এখন। নিতান্তই আঞ্চলিক। বিশ্ববাজার, বিশ্ব-অর্থনীতি, বিশ্ব করপোরেটের দাপটে ভাষারও ত্রাহি মধুসূদন। ভুবনপল্লির ঘরদুয়ারে-হেঁশেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো ক্রমশ অসম্ভব।

ইউনেস্কোরই এক রিপোর্টেই প্রকাশিত, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন দেড় হাজারের বেশি 'এথনিক ল্যাঙ্গুয়েজ বিলুপ্ত। ঢুকে পড়ছে ভিনদেশি ভাষা, যে ভাষায় ব্যবসা, আর্থিক সুরাহা সহজতর। ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে।

মাতৃভাষা সঠিক না জানলে ভিনদেশি ভাষা, ভিনদেশি সংস্কৃতি আত্তীকরণ অনেকটাই দুরূহ, বিষয়টি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নর্ডিক দেশে, প্রাথমিক স্কুল থেকেই দুটি ভাষা শিক্ষা জরুরি। যে দেশে বাস সেই দেশের ভাষা এবং মাতৃভাষা।

সুইডেন, নরওয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেখানে প্রাথমিক স্কুল এবং ভিনদেশি ভাষা সংস্কৃতির মানুষের বাস (মূলত আশ্রিত, রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে), মাতৃভাষা পঠনীয়।

সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডের কয়েকটি মফস্বলে দেখেছি বাংলা পাঠ্য। পড়ুয়া প্রাথমিক স্কুলে। পড়ুয়ার বাবা-মা রাজনৈতিক আশ্রিত। শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকাংশই বাংলাদেশের। পশ্চিমবঙ্গেরও কেউ কেউ।

ইদানীং জার্মানিরও কোনো কোনো রাজ্যে এই ব্যবস্থা চালু। তুর্কিদের আবেদনেই শুরু, ২০১৫ থেকে আরবের উদ্বাস্তুদের জন্যও। বাংলা হিন্দি উর্দু তামিল অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সমস্যা ছাত্রছাত্রী কম এবং উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া। আসল কারণ অন্যত্র। আমাদের উপমহাদেশ থেকে উদ্বাস্তুরা দ্রুত কমতির দিকে। কড়া নিয়মাবলিতে উদ্বাস্তুর ঠাঁই হচ্ছে না। ব্রিটেনে এমনিতেই বাঙালির বাস দীর্ঘকালীন, উপরন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ কমনওয়েলথভুক্ত। বহু বাংলাদেশি ব্রিটেনের সংসদে সাংসদ। যদিও ব্রিটিশ নাগরিক। খোদ লন্ডন থেকেই এক ডজনের বেশি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত। চারটি টিভি চ্যানেল (একটি সিলেটি ভাষায়)। ছয়টি বাংলা রেডিও স্টেশন (এমএফ)। ব্রিটেনের পর ইতালিতে বাঙালিরা রমরমা। বাংলা সংবাদপত্র, টিভি, রেডিও জনপ্রিয়। গোটা ফ্রান্সে প্রায় এক লাখ বাঙালি, এর মধ্যে ৭৫ হাজারই বাংলাদেশের। ফ্রান্সের পর পর্তুগাল গ্রিস বেনেলুক্স (বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ডস-লুক্সেমবুর্গ)। দুই বাংলা মিলিয়ে সাকল্যে কুড়ি হাজার। উত্তর আমেরিকার কথা ছেড়ে দিলাম। নিউইয়র্ক থেকেই দেড় ডজনের বেশি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত। রেডিও টিভি আছে। নিউইয়র্কে বাংলা বইমেলা থেকে হরেক বঙ্গীয় অনুষ্ঠান, আমেরিকায় বঙ্গ সম্মেলন। কানাডার টরন্টোয় বাংলার সংস্কৃতির কদর, দুই বাংলা থেকেই গায়ক-গায়িকা-সাহিত্যিকের উপস্থিতি। টরন্টোয় একটি অঞ্চলের নামই 'বেগমপাড়া'। বাংলাদেশের ধনীরা গড়েছেন।

বিশ্বময় বাঙালি। বাংলা ভাষা কি নিজের গণ্ডির বাইরে প্রচারে সফল? আদৌ নয়। বিদেশি কতজন আগ্রহী? সংখ্যা কত? ২১ ফেব্রুয়ারি এলে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের ধুয়া তোলে একাধিক অনুষ্ঠান, কিন্তু বাঙালি ছাড়া বিদেশি কতজন শামিল? আগ্রহী?

দুই বাংলা মিলিয়ে বাঙালির সংখ্যা, ভাষাগত, পৃথিবীতে সপ্তম। অথচ বাংলার কোনো কদরই নেই। জার্মানির হাইডেলবার্গে এশিয়ান বিভাগে বাংলা আছে বটে, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দশও নয়। বার্লিন ফ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পাঠের ক্লাস ছিল, তুলে দিয়েছে। ছাত্রছাত্রীর অভাব। বাংলা পড়ে বিদেশে চাকরি নেই। বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী নয়। রবীন্দ্রনাথের পরে জার্মানিতে কোনো বাংলা কবি-সাহিত্যিক ঠাঁই পেলেন না পাঠককুলে।

পশ্চিমবঙ্গের জন্য আরও দুঃখের। বাংলা ভাষার কথা যারা জানে, নিশ্চিত ধারণা, বাংলা বাংলাদেশের ভাষা। পশ্চিমবঙ্গ, ভারতের ভাষা হয়তো হিন্দি। ধারণার খুব দোষ দেওয়া যায় কি? পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাতেই ৫৩ ভাগ হিন্দিভাষী। কলকাতার নানা মহল্লায় বাংলার বদলে হিন্দি/ইংরেজি সাইনবোর্ড।

আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস, পৃথিবীর ক'জন, কত দেশ জানে? যত জানে এইডস দিবস, পিতা-মাতা দিবস এবং ভ্যালেন্টাইন্স দিবস। এই ভ্যালেন্টাইন্স দিবসই বেশি জানে তরুণ-তরুণী। ভ্যালেন্টাইন্স দিবস উপলক্ষে নানা পণ্যের বিক্রয়ে ২০-২৫ ভাগ ছাড়, হরেক চকলেট, পানীয়। ইউরোপে।

ভাষা দিবসের কথা জানে না। কোনো পত্রপত্রিকায় লেখা হয় না, মিডিয়ায় (বৈদ্যুতিক) উচ্চারিত নয়।

২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস নিয়ে দুই বাংলার বাঙালির প্রেম-উচ্ছ্বাস উথলে পড়ে, একটি দিনেই। তাও আবার মিডিয়ায়, রাজনৈতিক বাহাসে।

লক্ষ্য করুন বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে। ইংরেজি স্কুলে সন্তানকে পড়ানোর জন্য বাবা-মায়ের যতটা আকুতি, বাংলা পড়ানোয়, শিক্ষা দেওয়ায় কি তৎপর? না। কারণ, আর্থিক এবং ভুবনপল্লির (গ্লোবাল ভিলেজ /বৈশ্বিক) রাজনীতি।

হুজুগে বাঙালি, মিথ্যা প্রবাদ নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিজেকে বাঙালি, বাংলাভাষী বলে জাহির করলাম, ব্যাস, ল্যাটা চুকে গেল। পরদিন 'সব বাংলা শব্দ ঠিক মুখে আসে না'। শুনেছি অনেকের মুখে। ঢাকার বাংলা একাডেমি পরিভাষার অভিধান প্রকাশিত করেছে, কেউ কেনে কিংবা পড়ে কি?

২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য আত্মত্যাগের দিন, শোকের দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কয়েক বছর পরই এই দিন উৎসবের দিনে পরিণত। ভুলে যায় মূল আদর্শ। দোষ দেওয়া বৃথা। ২১ উপলক্ষে, ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে তিন দিনব্যাপী কবিতা পাঠের আসর, সাহিত্য আসর এবং বইমেলা। মাসব্যাপী বইমেলা। এত দীর্ঘদিনের বইমেলা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয় না। এর সঙ্গে আবেগ। আবেগের নানা প্রকাশ। তরুণ-তরুণী সেজেগুঁজে বইমেলায় যাবে, কিনুক না কিনুক, বইমেলার 'কালচারে' আচ্ছাদিত। এটাই বা কম কি?

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস দেশে-দেশে গুরুত্ব পায়নি এখনও। পালিত নয়। বাংলাদেশ চেষ্টা করছে, সরকারি পর্যায়ে সফলতায় ঘাটতি। ইউনেস্কো ঘোষণা করেই চুপ। অবশ্য, কোনো দেশ যদি না করে, দোষ নেই ইউনেস্কোর।

২১ ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষা আন্দোলন নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার উন্মেষ, জাগরণ। একুশের উদ্দীপনায় জাগ্রত। এতটাই জাগরূক, ভুলে যাই নিজের জন্মদিন। ছিল শোকের দিন, হলো উৎসবের।

বন্ধুরা বলেন, আজ তোমার জন্মদিন। উৎসব করব, নাকি শোক? তোমার জন্ম ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, পাবনার দোহারপাড়ায়। তোমার জন্মদিনেই বাংলা ভাষার শুরু।

কথামালার উদ্দীপনায় মজা করে কবিতায় লিখি 'বাংলা ভাষার সমান বয়সি আমি/বাংলা ভাষা আমার বয়সি।' ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে জন্ম, ভাষা দিবসে, দিবস আন্তর্জাতিক।

কবি

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com